গলাগলি। ভাইব্র্যান্ট গুজরাতের উদ্বোধন মঞ্চে মার্কিন বিদেশ সচিব জন কেরির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। রবিবার। ছবি: এএফপি
মুখিয়া বদলে গিয়েছেন, কিন্তু মুখ বদলায়নি।
গত ১২ বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা গুজরাতের বাণিজ্য-বান্ধব মুখটিকে সম্বল করে গোটা ভারতের স্বপ্ন ফেরি করলেন দেশের নতুন মুখিয়া নরেন্দ্র মোদী। চনমনে (ভাইব্র্যান্ট) গুজরাত সম্মেলনে ১২টি সহযোগী দেশের রাষ্ট্রনেতা ও ১০০টি দেশের শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিনিধিদের সামনে প্রধানমন্ত্রী আজ গুজরাতের কথা বললেন নামমাত্র। বরং নিজ রাজ্যের সাফল্যের ব্র্যান্ডকে ভিত হিসেবে ব্যবহার করে দেশের আর্থিক কর্মকাণ্ডে গতি ফিরিয়ে আনার কাজে এই সম্মেলনকে ব্যবহার করলেন তিনি। মনমোহন সিংহের গত এক দশকের জমানায় নীতিপঙ্গুত্বের গ্রাসে চলে যাওয়া দেশের অর্থনীতিকে টেনে তোলার চেষ্টা চালালেন।
মনমোহন সিংহের মতো শরিকি পিছুটান না থাকায় মোদী ভোগেন না নীতিপঙ্গুত্বে। বিরোধিতার নামে সংসদে বিশ্ৃঙ্খলা বা অচলাবস্থা তৈরি হলেও তিনি যে সংস্কারের পথ থেকে সরবেন না, তার প্রমাণ দিতে প্রয়োজনীয় আইন সংশোধনে অর্ডিন্যান্স জারি করতেও পিছপা হননি। বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের কিছু নেতা অবশ্য নানা রকম মন্তব্য করে বা ধর্মান্তরণে তৎপর হয়ে সরকারের অস্বস্তি বাড়াচ্ছে। সেখানেও সমস্যা মেটাতে তৎপর হয়েছেন মোদী। কিন্তু এ সবের পরেও আর্থিক ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে চাই আরও কিছু। তার মধ্যে সবচেয়ে জরুরি ব্যবসায়ী ও আন্তর্জাতিক মহলের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন। তাদের বার্তা দেওয়া, ভারত পাল্টাচ্ছে। এখন সে ঘুরে দাঁড়াতে প্রস্তুত। সেটার জন্য গুজরাতের চেয়ে ভাল মঞ্চ কোথায় পাবেন মোদী!
মনমোহন জমানায় কেন্দ্রর সরকার যখন শরিকদের নানা মুখী স্বার্থের টানে এগোতে ব্যর্থ হচ্ছিল বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ঠিক সেই সময়েই দেশের এক কোণে নিজের রাজ্যকে শিল্প-বাণিজ্য ও উন্নয়নের মরূদ্যান করে তোলার কাজ চালিয়ে গিয়েছেন মোদী। বাণিজ্য বা উন্নয়ন, বহু ক্ষেত্রেই এগিয়ে ভাবার সাহস দেখিয়েছে তাঁর রাজ্য। প্রথম বেসরকারি বন্দর ও রেল লাইন তৈরি হয়েছে এখানে। রাজ্য সড়কে প্রথম টোল আদায়েরও শুরু এ রাজ্যেই। ২০০২ সালের গোধরা-পরবর্তী হিংসা নিয়ে কংগ্রেস ও বাকি ধর্মনিরপেক্ষ দল যখন নিন্দেমন্দ আর ধুন্ধমার বিতর্কে ব্যস্ত ছিল, সেই সময়েও এগিয়ে ভেবেছেন মোদী। সলতে পাকিয়েছেন, ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এর। পরের বছর ২০০৩-এ ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এর আয়োজন করেন মুখ্যমন্ত্রী মোদী। বুঝিয়ে দেন, রাজ্যের আর্থিক উন্নতিই তাঁর অগ্রাধিকার। তার পর থেকে সাতটি সম্মেলন হল। এ বারের সম্মেলন নামে ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’ হলেও আসলে হয়ে উঠল উত্তরণের সমাবেশ। এতগুলি দেশের রাষ্ট্রনেতা ও শিল্প প্রতিনিধিদের সামনে গোটা দেশের স্বপ্ন তুলে ধরার লক্ষ্যেই যে মোদী আমদাবাদে এসেছেন, সেটা আজ নিজের বক্তৃতার ছত্রে ছত্রে বুঝিয়ে দিলেন তিনি। চনমনে ভারতের যে স্বপ্নটি তিনি আঁকলেন, সন্দেহ নেই উপস্থিত সকলেরই মন ছুঁয়েছে তা।
মোদীও তাঁর বক্তৃতায় বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রধান জিম ইয়ং কিমকে মনে করিয়ে দিলেন, “শেষ বার নয়াদিল্লি সফরে এসে আপনি জানিয়েছিলেন এ দেশে লগ্নির প্রক্রিয়া সরল করতে হবে। সরলীকরণের ক্ষেত্রে ভারত এখন ১৫০-এর ও নীচে। তার উন্নতি দরকার।” এর পরই প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস, “আমি কথা দিচ্ছি, পুরনো জমানা শেষ। এ বার আপনারা এক কদম এগোলে আমরা দু’কদম এগিয়ে আসব। আসুন এ দেশে বিনিয়োগ করুন।” উপস্থিত রাষ্ট্রনেতা ও প্রতিনিধিদের উদ্দেশে মোদীর আহ্বান, “আও, হাম সাথ চলে।” বিনিয়োগকারীদের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি, “এ দেশের লগ্নির জন্য ঝঞ্ঝাটমুক্ত পরিবেশ আমি তৈরি করবই।” আত্মবিশ্বাসী মোদীর এই শপথ শুনে মহাত্মা মন্দিরে যতটা সময় ধরে হাততালি চলল তাতে একটি ইঙ্গিত বেশ স্পষ্ট, মোদীর ‘ভাইব্র্যান্ট ইন্ডিয়া’-র স্বপ্নে ভরসাই রাখতে চাইছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা প্রতিনিধিরা। প্রথম দিনেই ৩১টি মউ স্বাক্ষরেও মিলেছে একই ইঙ্গিত। আক্ষরিক অর্থেই তাই দেশের এক অঙ্গরাজ্যের মঞ্চ হয়েও ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’ হয়ে উঠল গোটা দেশের স্বপ্ন বিপণনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন।
প্রধানমন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতিতে ভরসাই রাখতে চাইছেন উপস্থিত রাষ্ট্রনেতা ও শিল্প-বাণিজ্য জগতের প্রতিনিধিরা। যেমন বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রধান জিম ইয়ং কিম বললেন, “বিশ্ব অর্থনীতিতে আর্থিক বৃদ্ধির মাঝারি হারের মধ্যে ভারত এক উজ্জ্বল স্থান।” পণ্য-পরিষেবা কর (জিএসটি) চালু করাটা তাঁর মতে সাহসী সিদ্ধান্ত। সেইসঙ্গে কিমের পরামর্শ, ভর্তুকি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। তাঁর কথায়, “আমার আশা গরিবি দূরীকরণ অভিযানে ভারতই বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে। তার জন্য ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-ই হবে অন্যতম মাধ্যম।”
ভরসার ছবিটা ধরা পড়েছে মার্কিন বিদেশসচিব জন কেরির বক্তব্যেও। কেরিরও বিশ্বাস মোদীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ আহ্বান সারা বিশ্বের কাছে দ্রুত গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। তাঁর মতে, মোদীর অসামান্য নেতৃত্ব প্রমাণ করছে ভারত এখন গরিবি দূরীকরণ থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়ে সারা বিশ্বের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করতে প্রস্তুত।”
রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব বান কি মুনও গরিবি দূর করার প্রশ্নে মোদী সরকারের কর্মসূচির প্রশংসা করেন। সেই সঙ্গে তিনি সমাজের নিচু তলাতেও আর্থিক বৃদ্ধির লাভ পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করার ডাক দেন ভারতীয় শিল্পপতিদের উদ্দেশে। আগামী কাল অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির নেতৃত্বে দিনভর আলোচনার আসর বসবে ভারতে বিনিয়োগ নিয়ে।
প্রথম দিনের মূল আলোচ্য ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রসঙ্গে কী বললেন মোদী? তিনি ঘোষণা করলেন, “আমরা পরিবর্তনের এক নতুন পথে যাত্রা শুরু করেছি। তার জন্য কর্মসংস্কৃতি ফেরানোর জোর চেষ্টা হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকেও ঢেলে সাজা হচ্ছে। উন্নয়নের সুফল গরিবদের কাছে পৌঁছে দেওয়াই হবে প্রথম কাজ।”
কী ভাবে হবে সেই কাজ? জবাবে মোদী স্পষ্ট করতে চাইলেন, ইউপিএ জমানার মতো থমকে থাকতে রাজি নন তিনি। তাঁর কথায় “আর্থিক সংস্কারের কাজ থামবে না। সরকার সে কাজ দ্রুত শেষ করবে। নীতি-পঙ্গুত্ব থেকে বের করে আনা হবে সরকারকে। কর কাঠামো ব্যবস্থা যাতে স্থিতিশীল থাকে তাই আমি নিরন্তর কাজ করছি। বেশ কিছু পদক্ষেপও হয়েছে।”
সুষ্ঠু প্রশাসনের আশ্বাস দিয়ে লগ্নিকারীদের কাছে মোদীর প্রশ্ন, কেন ভারত আপনাদের কাছে আকর্ষণীয় জানেন? তাঁর জবাব, “আমাদের শক্তি লুকিয়ে থ্রি-ডিতে। ডেমোক্র্যাসি, ডেমোগ্রাফি আর ডিমান্ড। বিবিধের মাঝে মহান মিলনের তত্ত্ব তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বুঝিয়েছেন, এই ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাতে’র মধ্যেও তা লুকিয়ে আছে। তাঁর বক্তব্য, এই সম্মেলেনে দেশের অতি সাধারণ এক শিল্পদ্যোগীও বিশ্ব ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যানের কথা সামনে থেকে শুনছেন। যে চাষি তাঁর ফসল থেকে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের কোনও উদ্যোগের কথা ভাবছেন, তিনি শুনছেন খাদ্যসুরক্ষা সম্পর্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিবের মত। আক্ষরিক অর্থেই এই সম্মেলেন আসলে ‘দাভোস ইন অ্যাকশন’। মুকেশ অম্বানী তাই বললেন, “শ্রীকৃষ্ণ, মহাত্মা গান্ধী, সর্দার পটেলের পর গুজরাত এখন দেশকে মোদী দিয়েছে। গুজরাত মারু হোমছে। তাই আমিও গর্বিত।”
মহাত্মা মন্দির কনভেনশন সেন্টারের জায়ান্ট স্ক্রিনে নরেন্দ্র মোদীর চোখের কোণ তখন চিক চিক করছে। নতুন ভারতের স্বপ্নে!