এই ট্রলারেই আসছিল জঙ্গিরা। ছবি: পিটিআই।
উধার কি হাওয়া দেখকে কাম করনা!
বর্ষশেষের রাত। আরব সাগরের বুক চিরে এগোতে থাকা মাছধরার ট্রলারটার ওয়্যারলেস সেটে এসেছিল এই বার্তা। আড়ি পেতে শুনে ফেলেছিলেন ভারতীয় গোয়েন্দারা। তাঁরা ধরে ফেলেছিলেন, অচেনা কণ্ঠে ওই নির্দেশ আসছে করাচি থেকে। এবং পাকিস্তানের ওই বন্দর শহর থেকেই ভেসেছে ট্রলারটা।
গোয়েন্দাদের কাছ থেকে খবর পেয়েই ভারতীয় উপকূল রক্ষী বাহিনী তাড়া করেছিল ট্রলারটাকে। ঘণ্টাখানেক একটানা দৌড়ে শেষমেশ মাঝসমুদ্রে প্রবল বিস্ফোরণে উড়ে যায় ট্রলারটা। দাউদাউ করে জ্বলতে জ্বলতে সেটা তলিয়ে যায় আরব সাগরে। ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক নিশ্চিত, প্রচুর বিস্ফোরক বোঝাই করে আত্মঘাতী জঙ্গিরাই আসছিল ওই ট্রলারে চেপে। তাদের লক্ষ্য ছিল ‘উধার’, অর্থাৎ ভারতেরই কোনও শহর। কোন শহর, সেটা নিয়ে এখনও নিশ্চিত নন গোয়েন্দারা। তবে ট্রলারটির যাত্রাপথ হিসেব করে তাঁরা গুজরাতের উপকূলে এসে ওঠার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তাঁদের আরও বক্তব্য, গ্রেফতারি এড়াতে জঙ্গিরাই উড়িয়ে দিয়েছে নিজেদের ট্রলার। তার পর থেকে সমুদ্রে টানা তল্লাশি চালিয়েও জীবিত বা মৃত কাউকে উদ্ধার করা যায়নি।
হুবহু ছ’বছরের পুরনো ছক! ইংরেজি নববর্ষের দ্বিতীয় সকালে মুম্বই-সহ সারা দেশ জানল, স্রেফ নির্ভুল গোয়েন্দা তথ্য ও উপকূলরক্ষী বাহিনীর তৎপরতায় ভেস্তে গিয়েছে আরও একটা ২৬/১১। করাচি থেকে আরব সাগর বেয়েই তো এসেছিল আজমল কসাব ও তার ৯ সঙ্গী।
বেশ কিছু দিন ধরেই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কর্তাদের আলোচনায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। কেন পাকিস্তানে জেলের বাইরে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে ২৬/১১-র পাণ্ডা তথা লস্কর-ই-তইবা কম্যান্ডার জাকিউর রহমান লকভিকে? তা হলে কি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভারত সফরের আগে মুম্বই-হামলার ধাঁচে ফের হামলার ছক কষছে আইএসআই ও লস্কর? দু’মাস ধরে গোয়েন্দা রিপোর্টও আসছিল, ফের পাকিস্তানের দিক থেকে সমুদ্রপথে হামলা হতে পারে। নিয়মিত সতর্ক করা হচ্ছিল উপকূল রক্ষী বাহিনীকে।
বছর শেষের রাতে গোয়েন্দাদের সেই আশঙ্কাই অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল।
করাচির কেটি বন্দর থেকে রওনা হওয়া একটা মাছ-ধরা ট্রলারে জঙ্গিরা ভারতীয় উপকূলের দিকে এগোচ্ছে গোয়েন্দা সূত্রে খবরটা পেয়েই আরব সাগরে তল্লাশি শুরু করে উপকূল রক্ষী বাহিনীর ডর্নিয়ার বিমান। মাঝরাতের একটু আগে সেটার খোঁজ মেলে গুজরাত উপকূলের পোরবন্দর থেকে প্রায় ৩৬৫ কিলোমিটার দূরে। দ্রুত পৌঁছয় উপকূল রক্ষী বাহিনীর টহলদারি জাহাজ। তল্লাশির জন্য থামতে বলা হয় ট্রলারটিকে। কিন্তু উল্টে সেটি পালানোর চেষ্টা করে পাকিস্তানের দিকে। তাড়া করে উপকূল রক্ষী বাহিনীর জাহাজ। ট্রলারের উপরে একটানা সার্চলাইটের আলো ফেলে রাখে ডর্নিয়ার বিমানটি। প্রায় এক ঘণ্টা ধাওয়া করার পর উপকূল রক্ষীরা শূন্যে গুলি চালিয়ে ট্রলারটিকে থামান। পরে তাঁরা জানিয়েছেন, সেই সময়ে ট্রলারে চার জনকে দেখা যাচ্ছিল। ট্রলার থামানোর পরেই তারা ডেকের নীচে চলে যায়।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ! পরে উপকূল রক্ষী বাহিনীর ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল (অপারেশন) কে আর নউটিয়াল বলেন, “পয়লা জানুয়ারি ভোর সাড়ে ৬টা নাগাদ নৌকাটি পুরোপুরি আরব সাগরে ডুবে যায়। ওই চার জনেরও সন্ধান মেলেনি।” গোটা এলাকায় নজরদারি চালাচ্ছে উপকূল রক্ষী বাহিনীর জাহাজ ও বিমান।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, এই ঘটনায় আইএসআই ও লস্করের আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। লস্করই ফিঁদায়ে জঙ্গিদের ব্যবহার করে। ট্রলারটি থেকে যে ধরনের ওয়্যারলেস সেটের সিগন্যাল ধরা পড়েছে, তা পাক সেনাই ব্যবহার করে বলে গোয়েন্দাদের দাবি। কিন্তু এই জঙ্গিদের উদ্দেশ্য ঠিক কী ছিল, তারা কোথায় হামলার ছক কষছিল, স্পষ্ট নয় সেটাই। যে ধরনের জোরালো বিস্ফোরণ ঘটেছে, তাতে ট্রলারে যথেষ্ট পরিমাণ বিস্ফোরক ছিল বলেই অনুমান। গোয়েন্দাদের সন্দেহ, জঙ্গিদের লক্ষ্য ছিল ভারতীয় উপকূলের এমন কোনও গুরুত্বপূর্ণ শহর, যেখানে হামলা হলে বিশ্ব জুড়ে আলোড়ন পড়ে যাবে। কাজেই এ বারের লক্ষ্য মুম্বই, না প্রধানমন্ত্রীর রাজ্য গুজরাতের কোনও শহর সেটাই খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা। ইতিমধ্যেই গুজরাত উপকূলে ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি হয়েছে।
২৬/১১-র সময়ে করাচির কন্ট্রোল রুম থেকেই কসাবদের নির্দেশ দিচ্ছিল লকভি। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, এ বারও করাচি থেকে আসা ওয়্যারলেস বার্তার সূত্র ধরেই প্রথম সন্দেহ হয় ট্রলারটিকে। এনটিআরও (ন্যাশনাল টেকনিক্যাল রিসার্চ অর্গানাইজেশন)-র গোয়েন্দারা আড়ি পেতে শোনেন, হাওয়া বুঝে ‘কাম’ করার নির্দেশের উত্তরে নৌকা থেকে বলা হচ্ছে, “আমরা অস্ত্র পেয়ে গিয়েছি।” জঙ্গিরা এ-ও বলছিল, তাদের সঙ্গে ‘দামি জিনিস’ রয়েছে। আগুন লাগার আগে উত্তেজিত স্বরে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিল জঙ্গিরা। সেই কথোপকথন শুনেই গোয়েন্দারা মনে করছেন, আগুনটা ইচ্ছে করেই লাগানো হয়েছিল। করাচির কণ্ঠ ট্রলারের জঙ্গিদের বলেছিল, ‘পাঁচ, পাঁচ লাখ রুপিয়া দে দিয়া হামনে’। গোয়েন্দারা বলছেন, এ বারও সম্ভবত কসাবদের মতোই গরিব পরিবারের ছেলেদের আত্মঘাতী জঙ্গি হিসেবে ব্যবহার করেছিল লস্কর। অভিযানে পাঠানোর আগে তাদের পরিবারকে পাঁচ লাখ করে টাকা দেওয়া হয়।
এইখানেই লকভির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। গোয়েন্দারা বলছেন, বহু বছর ধরে লকভি জেলে বন্দি থাকলেও লস্কর সংগঠনে তার প্রভাব অনস্বীকার্য। তার কথায় এখনও যে কোনও জঙ্গি প্রাণ দিতে পারে। কাজেই ফের ২৬/১১-র ধাঁচে হামলা চালাতে হলে লকভিই সেরা যন্ত্রী। যে কারণে তাকে জেল থেকে বের করে আনার চেষ্টা চলছিল বলে গোয়েন্দাদের সন্দেহ। ২৬/১১-র হামলায় ‘যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে’ লকভি জামিনও পেয়ে যায়। কিন্তু ভারতের চাপে আপাতত অপহরণের মামলায় তাকে জেলে রাখা হয়েছে। সম্ভবত সেখান থেকেই সে যাবতীয় কলকাঠি নাড়ছে।
জঙ্গি ট্রলারেই কাহিনি শেষ হচ্ছে না। এই চিত্রের অন্য পিঠে রয়েছে সীমান্তে সংঘর্ষবিরতি ভেঙে পাক গুলি। ওই ৩১ ডিসেম্বরের শেষ রাত (অর্থাৎ বৃহস্পতিবার ভোর) থেকেই সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন শুরু করে পাকিস্তান। শুক্রবারও তা বন্ধ হয়নি। এই ৪৮ ঘণ্টায় তিন বার তারা সীমান্তে গুলি চালিয়েছে। এ দিন গভীর রাতে জম্মু সীমান্তে পাক রেঞ্জারবাহিনী ভারতীয় ছাউনি লক্ষ করে গুলি চালায়। বিএসএফের পাল্টা গুলিতে আজ রেঞ্জার বাহিনীর ৩ জন নিহত হয়েছে বলে কয়েকটি সূত্রের দাবি। এর আগে ৩১ ডিসেম্বরও বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছিল ৪ জন রেঞ্জার। ‘বিনা প্ররোচনায় তাঁদের হত্যা করা হয়েছে’ বলে অভিযোগ তুলে আজ ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে চিঠি লেখেন পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বিদেশ বিষয়ক পরামর্শদাতা সরতাজ আজিজ। ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনার পিসিএ রাঘবনকে ডেকে পাঠিয়ে সেই চিঠিটি দেন পাক বিদেশসচিব ইজাজ আহমেদ চৌধুরি। হাইকমিশনার তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দেন, পাকিস্তানের দিক থেকেই প্রথমে গুলি চলেছিল বলেই ভারতীয় জওয়ানরা বাধ্য হয়ে জবাব দিয়েছেন।
দিল্লির মতে, বছরের এই সময়টাতেই ভারতীয় ভূখণ্ডে জঙ্গি ঢোকায় পাক সেনা-আইএসএআই। তাদের ‘কভার’ দিতেই গুলি ছুড়ে ব্যস্ত রাখা হয় ভারতীয় জওয়ানদের। সেই সঙ্গে সমুদ্রপথেও যে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চলছে, জঙ্গি ট্রলারই তার প্রমাণ। গোয়েন্দা কর্তাদের অভিযোগ, পেশোয়ারের স্কুলে হামলার পর পাক সরকার বলেছিল, ‘ভাল’ তালিবান ও ‘খারাপ’ তালিবানের মধ্যে ফারাক করা হবে না। তা সত্ত্বেও লকভিকে নিয়ে তাদের নরম মনোভাব বদলায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২৬/১১-র হামলার আগাম টুকরো তথ্য ছিল আমেরিকা, ব্রিটেন ও ভারতের কাছে। কিন্তু সমন্বয়ের অভাবে হামলা রোখা যায়নি। তার পরবর্তী সময়ে ভারতের গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা, বিশেষ করে উপকূলে নজরদারি যে যথেষ্ট জোরদার হয়েছে, তা এ বারেই প্রমাণ হয়ে গেল। উন্নততর প্রযুক্তির মাধ্যমে গোয়েন্দাদের নজরদারির সাহায্যে এই হামলা রুখে দেওয়া গিয়েছে। অন্য দিকে, উপকূল রক্ষী বাহিনীও ঠিক সময়ে অভিযান চালিয়েছে। বাহিনীকে এ জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পর্রীকর।