বৈঠকের বিষয় ছিল, দেশজুড়ে ভোটের প্রচারে ভিআইপিদের নিরাপত্তা। আর সেখানেই ঘুরে-ফিরে এল একটাই নাম, নরেন্দ্র মোদী। বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারে কী ভাবে নিরাপত্তা বলয় সাজতে হবে, দলীয় সমর্থকদের ভিড়ে মিশে গেলেও কী ভাবে
সকলের ছোঁয়া থেকে বাঁচাতে হবে তাঁকে, দিল্লিতে ডেকে আদতে সেই পাঠ-ই দেওয়া হল সমস্ত রাজ্যের পুলিশকর্তাদের।
গত শুক্রবার ওই বৈঠক ডেকেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অনিল গোস্বামী। সব রাজ্যের স্বরাষ্ট্র-কর্তা ও একাধিক উচ্চ পদস্থ পুলিশকর্তা ছাড়াও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (আইবি), স্পেশাল প্রোটেকশন গ্রুপ (এসপিজি), ন্যাশনাল সিকিওরিটি গার্ড (এনএসজি) এবং মোদীর নিরাপত্তায় ব্রিটেনের ‘রয়্যাল মিলিটারি পুলিশ’-এর ধাঁচে তৈরি বিশেষ বাহিনী ‘ক্লোজ প্রোটেকশন টিম’ (কেপিটি)-এর শীর্ষ কর্তারা ওই বৈঠকে হাজির ছিলেন। প্রশাসন সূত্রের খবর, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ‘হাই-প্রোফাইল’ নেতা কিংবা ‘স্টার ক্যাম্পেনার’রা ভোটের প্রচারে রাজ্য সফরে গেলে তাঁর নিরাপত্তায় সেখানকার পুলিশ কী ব্যবস্থা নেবে, তার একটা নির্দেশিকা (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর) তৈরি করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। এমনকী, এ-ও বলে দেওয়া হয়েছে, ভোটের দামামা বাজার শুরুর আগে থেকে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সমস্ত রাজ্যকে যে সব পরামর্শ (অ্যাডভাইসরি) পাঠিয়েছে, সেগুলিও যেন হুবহু অনুসরণ করা হয়।
সে দিনের ঘণ্টা দেড়েকের বৈঠকে মোদীর নিরাপত্তা নিয়েই যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বেশি চিন্তিত তার ইঙ্গিত পেয়েছেন বিভিন্ন রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা। তাঁদের কয়েক জন জানিয়েছেন, কেন্দ্রের তরফে ভিআইপিদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত নির্দেশিকা জানানোর সময় বারেবারেই উঠেছে গত অক্টোবরে বিহারের পটনায় মোদীর উপরে জঙ্গি-হানার প্রসঙ্গ। দিন কয়েক আগে দিল্লি পুলিশের হাতে ওই ষড়যন্ত্রের অন্যতম মূল চক্রী ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন নেতা তেহসিন আখতারের গ্রেফতারের পরে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর নিরাপত্তা যে আরও আঁটোসাটো করা দরকার, বিভিন্ন রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তাদের সে কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব। তবে মোদী খুব কমই নিরাপত্তার ব্যাকরণ অমান্য করেন, এটাই পুলিশের বড় ভরসা, বলছেন এক স্বরাষ্ট্র-কর্তা। ওই কর্তার বক্তব্য, “নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে জনতার মধ্যে যাওয়ার প্রবণতা বেশি রাহুল গাঁধীর। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও মাঝেমধ্যে মানুষের মধ্যে চলে যান। তাই ওঁদের নিয়েই চিন্তা বেশি।”
কেন মোদীকে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক? রাজ্য প্রশাসনের একাধিক কর্তার মতে, যে হেতু এ বার বিজেপির ক্ষমতায় আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে বিভিন্ন জনমত সমীক্ষা, তাই ধরেই নেওয়া হচ্ছে, পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন নরেন্দ্র মোদী। তাই, এখন থেকেই তাঁর সুরক্ষা আরও নিশ্ছিদ্র করতে চায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। দিল্লির বৈঠকে কার্যত সেই বার্তাই দেওয়া হয়েছে।
প্রশাসন যেটা ভাবছে, সেটাই নিশ্চিত মনে করছে দল। তাই দলের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীকে নিজেদের রাজ্যে নিয়ে যেতে কার্যত প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন বিজেপি নেতারা। ওই তালিকায় রয়েছে পশ্চিমবঙ্গও। রাজ্য বিজেপির এক নেতা বলেন, “গত ফ্রেব্রুয়ারিতে ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার আগেই ব্রিগেড ময়দানে এক দফা সভা করেছেন মোদী। সেই সভায় জনতার উপস্থিতি আরও উৎসাহী করেছে আমাদের। তাই মোদীজিকে দিয়ে ভোটের আগে আরও কয়েকটি সভা করাতে চাইছি আমরা।”
বিজেপি সূত্রের খবর, প্রথম দফা ভোটের আগে আগামী ১০ এপ্রিল শিলিগুড়িতে একটি জনসভা করবেন মোদী। আসানসোল ও কৃষ্ণনগরেও তাঁকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় আছে দল। রাজ্য প্রশাসনও বলছে, দক্ষিণবঙ্গে একাধিক সভা করতে পারেন মোদী। তবে, দিল্লি থেকে এ ব্যাপারে এখনও কোনও নির্দিষ্ট বার্তা এসে পৌঁছয়নি নবান্নে।
ইতিমধ্যেই অবশ্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রথম দফায় ভোটের প্রচারে রাজ্য সফরে বেরিয়ে পড়েছেন। কংগ্রেসের সহ সভাপতি রাহুল গাঁধী দিন কয়েক আগে পশ্চিমবঙ্গে এক প্রস্থ ঘুরে গিয়েছেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় ভোটের আগে আবারও তিনি আসবেন বলে কংগ্রেস সূত্রের খবর। রাহুলই শুধু নয়, গত কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার দুই সদস্য জয়রাম রমেশ ও গুলাম নবি আজাদের মতো দলের প্রথম সারির নেতাদেরও এ রাজ্যে প্রচারে আনার কথাবার্তা চলছে। পিছিয়ে নেই সমাজবাদী পার্টি (এসপি) ও ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি)-র মতো আঞ্চলিক দলগুলিও। ওই দুই দলের সর্বভারতীয় নেতা মুলায়ম সিংহ যাদব ও প্রফুল পটেল এপ্রিলের মাঝামাঝি এ রাজ্যে প্রচারে আসতে পারেন বলে রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশের খবর। এক গোয়েন্দাকর্তা বলেন, “নেতানেত্রীদের সঙ্গে বলিউডের একাধিক অভিনেতা-অভিনেত্রেীরও আসার সম্ভাবনা রয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁদের দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়বে আমজনতা। তাই নিরাপত্তায় এতটুকু ফাঁক রাখা চলবে না।”