পওয়ারের স্বস্তি কেবল নিজের বিচ্ছিন্ন দ্বীপেই

কৃষিঋণ না চোকাতে পারার জেরে আত্মহত্যার কোনও দাগ এই যোজনান্তর দ্রাক্ষাখেতের সবুজে লেগে নেই। শৌচকর্মটুকু সারার জন্যও জল না মেলার মরাঠি গ্রামের পরিচিত চিত্রটি গত দু’প্রজন্ম যাবৎ চোখে দেখেনি এই সুজলাং সুফলাং জনপদ। দেখার কথাও নয়। কেননা এটি মরাঠা স্ট্রং ম্যান শরদ পওয়ারের সাম্রাজ্য!

Advertisement

অগ্নি রায়

বারামতী (মহারাষ্ট্র) শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৪ ০২:১৫
Share:

কৃষিঋণ না চোকাতে পারার জেরে আত্মহত্যার কোনও দাগ এই যোজনান্তর দ্রাক্ষাখেতের সবুজে লেগে নেই।

Advertisement

শৌচকর্মটুকু সারার জন্যও জল না মেলার মরাঠি গ্রামের পরিচিত চিত্রটি গত দু’প্রজন্ম যাবৎ চোখে দেখেনি এই সুজলাং সুফলাং জনপদ।

দেখার কথাও নয়। কেননা এটি মরাঠা স্ট্রং ম্যান শরদ পওয়ারের সাম্রাজ্য!

Advertisement

জলের অভাবে বিপর্যস্ত, উন্নয়নের বিহনে ভগ্ন, দুর্নীতির প্রকোপে দরিদ্র পশ্চিম মহারাষ্ট্রের মধ্যে এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো এই বারামতী নির্বাচনী ক্ষেত্রে এসে দাঁড়িয়েছি। লোকসভাকে এ বার চিরতরে বিদায় জানিয়েছেন বহু যুদ্ধের পোড় খাওয়া পওয়ার।

ব্যাটন তুলে দিয়েছেন উত্তরসূরি, কন্যা সুপ্রিয়া সুলে এবং ভাইপো অজিত পওয়ারের হাতে। জোর আলোচনা চলছে ভোটযুদ্ধ থেকে তাঁর অবসরের (দলনেতা হিসাবে অবশ্যই রাজ্যসভায় থাকছেন তিনি) ‘টাইমিং’ নিয়ে। কেননা প্রবল মোদী ঝড়ের মুখে এ বার বিদর্ভ, কোঙ্কন, মুম্বই এমনকী পুণেতেও তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার অক্ষত থাকবে কি না, নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। কিন্তু গত তিরিশ বছর ধরে ১৪টি নির্বাচনে (লোকসভা এবং বিধানসভা মিলিয়ে) বারামতী কেন্দ্র থেকে শরদ পওয়ার তথা এনসিপি-র লাগাতার জয়ের রেকর্ডে যে এ বারেও বিজেপি-শিবসেনা আঁচ ফেলতে পারবে না (সুপ্রিয়া এ বার বারামতীর প্রার্থী), তা এখনকার প্রখর সূর্যালোকের মতই স্পষ্ট।

গজানন বৈভবরাও দেশপাণ্ডে স্কুলের ভোটকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে মধ্যবয়স্ক স্থানীয় হোটেল ব্যবসায়ী উমেশ চহ্বাণ যেমন হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বললেন, “এখানে অন্য কোনও নামই নেই। লড়াই বলেই কিছু নেই। পওয়ার সাহেব যা বলবেন, এখানে তা-ই চলবে। আমরা সবাই বসে থাকি ওঁকে জেতানোর জন্য। কত সাধারণ মানুষ ধনী হয়ে গেল ওঁর দৌলতে।”

শ’দেড়েক কিলোমিটারের মধ্যেই কি চরম বৈপরীত্ব। সুরেশ কলমডীর তিহাড় গমনের পর কার্যত শক্তিহীন হয়ে গিয়েছে পুণের কংগ্রেস-এনসিপি দুর্গ। নরেন্দ্রভাই মোদী যে বন্যার জলের মত অপ্রতিরোধ্য হচ্ছেন, তা বোঝার জন্য অলিতে গলিতে আড়ি পাতারও দরকার পড়ছে না।

‘মি মোদিলা মতদান কেলে’, অর্থাৎ ‘মোদীকেই ভোট দিয়েছি’ এটা শুধু পুণে নয়, গোটা পশ্চিম মহারাষ্ট্রেরই সংখ্যাগরিষ্ঠের রিংটোন। পুণে থেকে যিনি কংগ্রেসের হয়ে দাঁড়িয়েছেন, তিনি ভূমিপুত্রও নন বিদর্ভের কংগ্রেস নেতা পতঙ্গরাও কদমের পুত্র বিশ্বজিৎ কদম। আর তাঁর বিরুদ্ধে বিজেপির হয়ে লড়ছেন ২০০৯-এর নির্বাচনে এই এলাকা থেকে সামান্য ভোটে হারা অনিল শিরোরে। তফাত হল, সেই নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদী ছিলেন না, এ বার প্রবল ভাবে রয়েছেন। এখানকার জনসভাগুলিতে মোদী বলেছেন, “ওদের আপনারা ৬০ বছর দিয়েছেন। আমায় ৬০ মাস দিন। সমাজের সমস্ত স্তরের জন্য উন্নয়ন আনব।” ‘সমস্ত স্তর’ কটাক্ষের লক্ষ্য শরদ পওয়ার-কংগ্রেস। অর্থাৎ, শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ মরাঠাদের জন্যই নয়, প্রধানমন্ত্রী হলে মোদীর লক্ষ্য থাকবে পিছড়ে বর্গ, মালি, বানজারি, খাটিগ-এর মতো সম্প্রদায়ের কাছে উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দেওয়া। অন্তত বলছেন তিনি সেই রকম।

পুণে থেকে বেরিয়ে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নান্দের, আনন্দনগর ছাড়িয়ে বারামতীর রাস্তায়। দেখেই মালুম, গত তিন দশক ধরে নিজের নির্বাচনী ক্ষেত্রকে কী প্রবল ভাবে সাজিয়ে দিয়েছেন পওয়ার। দু’পাশের ইক্ষুখেত বা দ্রাক্ষাবাগানের মালিকানা কার সেই প্রশ্ন স্বতন্ত্র।

কিন্তু রাস্তার ধারে আখ খেতের উপর এমন ঝাঁ চকচকে, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত অস্থায়ী পার্টি অফিস ভারতের কোনও প্রত্যন্ত জেলায় দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। অবশ্যই পার্টি অফিসটি এনসিপি-র। ভিতরে গরমাগরম কন্ট্রোল রুম। এক সময় এখানকার গ্রামে-গঞ্জে হ্যাজাক নিয়ে রাতে ভোট প্রচার করতেন সদ্য তরুণ অজিত পওয়ার। আর আজ এখানকার রাতের রোশনাই দিনকেও হার মানায়।

এই পওয়ার-ভূমে ঢোকার মুখে কিন্তু প্রবীণ মরাঠা নেতার কোনও পোস্টার নেই। তাঁর দলেরও নয়। বদলে কী রয়েছে? একটি বিরাট বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপন ‘ড্রাইভ ফর প্যাশন--- রেমন্ডস’! রয়েছে ধবধবে সাদা অতিকায় টয়োটো শো রুম। ডিশ অ্যান্টেনা খচিত নয়নশোভন একতলা বাংলো। যত এগোচ্ছি, বদলে যাচ্ছে ল্যান্ডস্কেপ।

পঁচিশ বছর আগে যা ছিল অজ এক গ্রাম, এখন তার মুখ ঢেকে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া থেকে জার্মানি সব রকমের বিয়ারের বিজ্ঞাপন এবং সংলগ্ন দোকানে। গর্তহীন মাখনের মতো রাস্তাকে চমকে দিয়ে চলে যাচ্ছে এসইউভি। পওয়ার এসে রেল স্টেশন বানিয়ে দিয়েছেন, সেখানে রাখা রয়েছে ’৫৭ সালের একটি বাষ্পীয় ইঞ্জিন।

“আসলে এখানকার মতো জলের সরবরাহ গোটা মহারাষ্ট্রে খুব কম রয়েছে”, জানাচ্ছেন সন্তোষ জগতাপ। পওয়ারের পৈতৃক ভিটে ইন্দ্রপুরের কাছে একটি শহরোচিত শপিং মলে কম্পিউটার গ্যাজেটের দোকান তাঁর। এখানেই জন্ম-কর্ম। তাঁর কথায়, “গ্রীষ্মকালে যখন সবচেয়ে বেশি জলের প্রয়োজন হয়, তখন বাড়তি ট্যাঙ্কার সরবরাহ করা হয় বারামতীতে। আরও সুবিধে হয়েছে যে, রাজ্যের জলসম্পদমন্ত্রী এনসিপি-রই। ফলে পওয়ারের কথা অগ্রাহ্য করার কোনও উপায়ই নেই তাঁর। লাভবান আমরা।”

দূরে সূর্যের আলোয় ঝলসাচ্ছে ট্র্যাক্টরের উজ্জ্বল রং। কৃষি ও শিল্প যেন হাত ধরাধরি করে রয়েছে এখানে। এক দিকে শর্করা বলয়, অন্য দিকে ৮০০ হেক্টর জমির উপর গড়ে ওঠা ‘মহারাষ্ট্র ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার’।

এক দিকে সোনালি গমখেতের রৌদ্র-ছায়া, অন্যদিকে অটোরিকশা নির্মাণ সংস্থা পিগাজ্জিও-র বিশাল কারখানা। পওয়ার শিবিরের বক্তব্য, এখানে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম হওয়ার কোনও সুযোগই ছিল না।

কারণ গত বিশ বছর ধরে যে বিশাল জমি শিল্পের জন্য অধিগ্রহণ করেছে সরকার, তা ছিল বাঁজা জমি। চাষবাস হতো না কোনও কালেই। শিল্প গড়ে উঠলে যা হয় তা-ই হয়েছে, অর্থাৎ ছত্রাকের মত তৈরি হয়েছে আধুনিক ব্যবস্থা সম্বলিত সরাইখানা আর রেস্তোরা।ঁ সঙ্গে কিছু অনুসারী শিল্প।

কী বলা যায় ‘আদর্শ লোকসভা কেন্দ্র’ বারামতীই? হয়তো অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু এ হেন পওয়ার-ভূমে দাঁড়িয়েও দেশ (তথা রাজ্য) জুড়ে মোদী-হাওয়ার কথা ভাবলে অন্য চিন্তা এসে পড়ছে। ১৬ মে-র পর সবেধন নীলমণি এই বারামতীই মরাঠা নেতার রাজনৈতিক অবসরকেন্দ্র হয়ে উঠবে না তো!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন