কিরণ বেদী এবং সাজিয়া ইলমিকে শুভেচ্ছা দিল্লির বিজেপি সভাপতি সতীশ উপাধ্যায়ের। ছবি: পিটিআই।
তখন তিনি দিল্লির ট্রাফিক বিভাগের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র কনোট সার্কাসে একটি সাদা অ্যাম্বাসাডর ভুল পার্কিং-এ দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়িটি উঠিয়ে চালান করে দিয়েছিলেন কিরণ বেদী। যদিও তিনি জানতেন, গাড়িটি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর। পরে বলেছিলেন, “প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি যখন তুলে নিয়েছি, তখনই জানতাম আমার বদলি হবে। পরের দিনই সোজা গোয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু তাই বলে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পাইনি।”
আর তিন সপ্তাহ পরে দিল্লিতে ভোট। শেষ লগ্নে অরবিন্দ কেজরীবালকে টক্কর দেওয়ার জন্য এমন একটি মুখই বেছে নিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটুকুই হয়নি কেবল। দিল্লির বুকে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের সঙ্গে পোস্টার পড়ে গিয়েছে একদা ‘ক্রেন বেদী’ বলে পরিচিত কিরণের। বুঝিয়েই দেওয়া হচ্ছে, কেজরীবালের বিরুদ্ধে তিনিই বিজেপির প্রার্থী। বিজেপির সরকার হলে তিনিই মুখ্যমন্ত্রী।
দেশের এই প্রথম মহিলা আইপিএস অফিসারটিকে কর্মজীবনে যেখানেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, নিজের ছাপ রেখে এসেছেন। কঠোর প্রশাসক এবং দুর্নীতি-বিরোধী ভাবমূর্তি বলে পরিচিতি রয়েছে। ‘দুর্নীতি হঠাও’ ডাক দিয়েই একদা কেজরীবালের দলে যোগ দিয়েছিলেন। গত কাল বিজেপিতে এসেছেন। মোদী এবং অমিত এখন তাঁকেই দিল্লির ভাবী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রচার করা হবে বলে ঠিক করেছেন।
কিরণ নিজেও সেই ভাবেই প্রস্তুত হচ্ছেন। গত কাল দলে যোগ দেওয়ার পরেই আজ বিজেপির দফতরে প্রায় আধ ঘণ্টার বক্তৃতায় তিনি বুঝিয়ে দিলেন, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তিনি কী ভাবে রাজ্য পরিচালনা করতে চান। এমনকী মঞ্চে যখন দিল্লির তাবড় তাবড় বিজেপি নেতা মজুত, সকলের সামনে নিজস্ব মেজাজে তাঁদের ধমকে দিতেও কসুর করেননি। সটান বলে দিলেন, “এখানে কোনও মনোরঞ্জন হচ্ছে না। কাজ না করলে কাজ করাতে ভালই জানি। কথা না শুনলে বাইরে বেরিয়ে যান।”
কেজরীবালের মোকাবিলায় এমন এক জনকে যে দরকার, সেটা ভালই বুঝেছিলেন মোদী। সম্প্রতি রামলীলা ময়দানে তিনি নিজে জনসভা করার পরেও রাজধানীতে আপ-কে তেমন কাবু করা যায়নি। এবিপি-নিয়েলসেনের জনমত সমীক্ষা দেখিয়ে দিচ্ছে, দিল্লিতে গত তিন মাস ধরে বিজেপির সম্ভাব্য আসন সংখ্যা কমছে আর জনপ্রিয়তা বাড়ছে কেজরীবালের। এ মাসের ৭-১২ তারিখের মধ্যে করা সমীক্ষার ফলই বলছে, বিজেপি পেতে পারে ৩৪টি, আপ ২৮ এবং কংগ্রেস ৮টি আসন। সমীক্ষার মতে, নরেন্দ্র মোদী দেশের সবথেকে জনপ্রিয় নেতা হলেও মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দিল্লিবাসীর প্রথম পছন্দ কেজরীবালই। অথচ দু’মাস আগে এই সমীক্ষাতেই বিজেপির সম্ভাব্য আসনসংখ্যা ছিল ৪৬ এবং আপ-এর ১৮। সুতরাং আপ যে ইঞ্চি-ইঞ্চি করে এগোচ্ছে, সেটা বুঝতে পেরেই চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছিলেন মোদী-অমিতরা। পাশাপাশি, কেজরীবাল তাঁর আক্রমণ বাড়াচ্ছিলেন। দিল্লির বিজেপি সভাপতি সতীশ উপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ আনছিলেন, বিজেপির পোস্টারকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, “মোদীর ছবি কেন? উনি তো আর মুখ্যমন্ত্রী হবেন না!’’
ঠিক এই আবহেই কিরণকে দিল্লির মুখ করে এনে ব্রহ্মাস্ত্রটি প্রয়োগ করল বিজেপি। কলহদীর্ণ দিল্লি বিজেপি-র মাথার উপরে বসিয়ে দেওয়া হল তাঁকে। এমন এক জন, যিনি কেজরীবালকে কেজরীবালের ভাষাতেই জবাব দিতে পারবেন! যাঁর হাত ধরে দিল্লির মধ্যবিত্ত সমাজ, মহিলাকুল এমনকী কেজরীবালের গরিব ভোটব্যাঙ্কেও থাবা বসানো যাবে! অন্তত বিজেপি শিবিরের তেমনটাই আশা। এমনকী কিরণ আজ সরকার পরিচালনার যে মডেলটি হাজির করেছেন, তাতেও আপ-ঘরানার ছাপ স্পষ্ট। কী রকম? কিরণ বলছেন, সরকার গড়লে রোজ সকাল ন’টায় তিনি আকস্মিক সফরে বেরোবেন দিল্লির যে কোনও প্রান্তে। খতিয়ে দেখবেন সব কিছু। শুধু তিনি নন, গোটা সচিবালয় নিজের নিজের দফতর অনুযায়ী সফর করবেন বিনা নোটিসে। মাসে একদিন তো বটেই, দরকার হলে আরও ঘনঘন সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেখা করবেন। ঠিক যেমনটি করতেন কেজরীবাল। কিরণ জানান, এই মন্ত্রটি স্বয়ং মোদীই তাঁকে দিয়েছেন। সরকার পরিচালনার ধরন কেমন হবে, তা মোদীর সঙ্গে কথা বলেই ঠিক করছেন তিনি। তাঁর কথায়, “প্রধানমন্ত্রী আমাকে দিল্লিকে বিশ্বমানের শহর গড়তে বলেছেন। দিল্লিকে দেশের দিল বানাতে হবে।”
শেষ বেলায় কেজরীবালকে আরও চাপে রাখতে আজ বিজেপিতে আনা হল আপ-এর পুরনো সহযোগী সাজিয়া ইলমিকেও। মোদীর গুণগান গেয়ে তিনিও এখন কেজরীবাল-বধে প্রস্তুত। মোদীর এই দুই মোক্ষম চালে কিছুটা বিভ্রান্ত কেজরীবাল নিজেও। কিরণ-সাজিয়ার বিরুদ্ধে ঠিক কী বলবেন খুঁজে না পেয়ে সুর খানিকটা নরম করতে হচ্ছে তাঁকে। কিরণ প্রসঙ্গে অরবিন্দের তাই মন্তব্য, “আমি ওঁকে পছন্দ করি। রাজনীতিতে আসার ব্যাপারে ওঁকে বরাবরই উৎসাহ দিয়ে এসেছি।” সরাসরি কিরণ-সাজিয়াদের আক্রমণ না করে আপ বরং বিষয়টা এখন বিজেপির দুর্বলতা বলে দেখাতে চাইছে। দলের নেতা আশুতোষ কটাক্ষ করে বলছেন, “বিজেপি তো এখন আম আদমি পার্টির বি-টিম হয়ে গিয়েছে। আমাদের সহযোগীদের নিয়েই দল ভরাতে হচ্ছে।”
আর কংগ্রেস? কেজরীবালের বিরুদ্ধে তাদের প্রার্থী শীলা দীক্ষিত-ঘনিষ্ঠ বর্ষীয়ান নেত্রী কিরণ ওয়ালিয়া। নিজেদের কিরণকে আগলাতে অন্য কিরণের অপ্রিয় অতীত কাহিনি তুলে ধরছে তারা। কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী অজয় মাকেন বলছেন, “সরকারি পদে ছিলেন উনি। ৪০ বছর ধরে সিনিয়রদের সঙ্গে ঝগড়া করার অভিজ্ঞতা রয়েছে ওঁর।” শুধু তাই নয়, কিরণ বেদী ও সাজিয়া এক সময়ে টুইট করে মোদীর যে সব সমালোচনা করেছিলেন, সেগুলিও খুঁচিয়ে সামনে আনছে কংগ্রেস। অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি এ দিনই বলেন, “এক জন ৪৯ দিন সরকার চালিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আর এক জনের দিল্লির পুলিশ কমিশনার হয়ে ওঠার স্বপ্ন অধরা থেকে গিয়েছে বলে এখন মুখ্যমন্ত্রী হতে চাইছেন।” তাঁর কটাক্ষ, “কেজরীবালও কি এ বার বিজেপি-তে যাবেন?”