গত বছর মে মাসে ক্ষমতায় আসার পর প্রথম দিকের একটি মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর সতীর্থদের কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন, আচার-আচরণে যেন কোনও ভিআইপি-তন্ত্র গড়ে না ওঠে। থাকতে হবে সাদামাটা, মাটির কাছাকাছি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে জানানো হয়েছিল, শুধুমাত্র বিজেপি-র মন্ত্রীদেরই নয়, গোটা দেশের সরকারি নেতাদের মধ্যেই এই সহজ জীবনযাত্রার সংস্কৃতি গড়ে তোলাই লক্ষ্য মোদীর।
কিন্তু সম্প্রতি একের পর এক ঘটনায় বড় প্রশ্নচিহ্নের সামনে পড়েছে তাঁর সেই প্রয়াস। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস এবং গত ২৪ তারিখ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজুর বিমান-কাণ্ডের পর ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী। সেই ক্ষোভকে আরও উস্কে দিয়ে এয়ার ইন্ডিয়ার ঘটনা নিয়ে আজও তরজা করেছেন রিজিজু। বিমানে রিজিজু উঠবেন বলে তিন জনকে নামিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। এয়ার ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, বিমান ছাড়তে দেরি হয় গোটা ঘটনার জন্য। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নির্দেশে গতকাল গোটা বিষয়টি নিয়ে রিজিজু ক্ষমা চাওয়ার পরেও ফের আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন তিনি। বলেছেন, ‘‘আমার জন্য কাউকে বিমান থেকে নামতে হয়নি। পুরো খবরটাই ভুয়ো।’’ এখানেই না থেমে তিনি আরও বলেন, তাঁর জন্য বিমান দেরি হয়নি, উল্টে নির্ধারিত সময়ের আগেই বিমান ছাড়ার নোটিস এসেছিল। কিন্তু তাঁর এই অবস্থানকে খন্ডন করে ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্স-এর একটি রিপোর্ট বলছে ‘এক জন ভিআইপি’কে ওঠানোর জন্যই সে দিন বিমানটি ছাড়তে দেরি হয়।
ঘটনা হল, ক্ষমা চাওয়ার পরেও বিষয়টিকে আবার উত্থাপন করার এই প্রয়াসকে যথেষ্ট অনভিপ্রেত বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতৃত্ব। পাশাপাশি, সরকারি শীর্ষ নেতৃত্ব আশঙ্কায় যে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া গোটা দেশেই শীর্ষপদে আসীন রাজনীতিবিদদের মধ্যে এই ভিআইপি-মানসিকতা বেড়ে চলেছে। সদ্য তৈরি হওয়া রাজ্য তেলঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি যে বুলেটপ্রুফ মার্সিজিড বেঞ্জ বাসটি কিনেছেন তার মূল্য পাঁচ কোটি টাকা! সরকারি অর্থে কেনা ওই বাসটিকে আজ ঘটা করে পুজোও করা হয়েছে হায়দরাবাদে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ভারতের কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য এমন একটি বিলাসবহুল গাড়ির দৃষ্টান্ত একেবারেই বিরল। কী নেই সেই বাসে! প্যান্ট্রি, লাক্সারি কোচ, টয়লেট— সবই রয়েছে পাঁচতারা ঘরানার। বিলাসবহুল জীবনযাত্রার জন্য পরিচিত জয়ললিতা বা মায়াবতীর পক্ষেও এটা বাড়াবাড়ি বলেই মনে করা হচ্ছে।
তবে রাজনৈতিক শিবির মনে করছে, ভারতীয় রাজনীতিতে আজকের দিনেও যে এর ব্যতিক্রম নেই তা নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা অরবিন্দ কেজরীবালের মতো মুখ্যমন্ত্রীরাও রয়েছেন সাধারণ জীবনযাপনের প্রতীক হয়ে। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে তা-ও কেজরীবালের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে বিলাসবহুল জীবনযাপনের অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে কদাপি নয়। সাধারণ ভাবে তাঁর যে কোনও সফরেই, তা সে বিমানই হোক বা সড়কপথে, তাঁর নির্দেশই থাকে কখনও যেন সাধারণ মানুষের সমস্যা না হয়। বিমানযাত্রার সময় সাধারণত বাকি যাত্রীরা উঠে যাওয়ার পর তিনি বিমানে ওঠেন। বিজেপি-র মধ্যেও রবিশঙ্কর প্রসাদ, মনোহর পর্রীকরের মতো অনেক মন্ত্রী রয়েছেন যাঁরা নিজেদের গাড়িতে লালবাতি পর্যন্ত ব্যবহার করেন না। নিজেরা হাতে ব্যাগ নিয়ে ঘোরেন।
এঁদের দৃষ্টান্তই বাকিরা অনুসরণ করুক, এমনটাই চাইছেন প্রধানমন্ত্রী।