দলে তাঁর বিকল্প তিনি নিজেই। ওয়ার্কিং কমিটি তো দূরের কথা, গোটা কংগ্রেস দলে এমন কোনও নেতা পাওয়া যাবে না নেতৃত্বের প্রশ্নে যিনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়তে পারেন রাহুল গাঁধীকে। তাঁর কাজের ধরন নিয়ে যতই অসন্তোষ থাকুক, দিল্লিতে কার্যত জমানত খুইয়ে আতঙ্কিত ও দিশেহারা কংগ্রেস কিন্তু সাগ্রহে তাকিয়ে রয়েছে রাহুলের দিকেই! কবে সাংগঠনিক সংস্কার করে নতুন টিম তৈরি করবেন রাহুল, কবে মাঠে নামবেন তিনি? এমনকী সূত্রের খবর, মেয়ে বিয়ের নিমন্ত্রণ জানাতে গিয়ে লালু প্রসাদও আজ সনিয়া গাঁধীকে বলে এসেছেন, রাহুলকে রাস্তায় নামতে বলুন এ বার!
জয়পুরে চিন্তন শিবির ডেকে দু’বছর আগে রাহুলকে সহ সভাপতি করা হয় কংগ্রেসের। আজ সে প্রসঙ্গ তুলে ওয়ার্কিং কমিটির এক সদস্য বলেন, আনুষ্ঠানিক ভাবে দায়িত্ব নিয়েই রাহুল বলেছিলেন, “দলটা চলছে কী ভাবে, মাঝে মাঝে তা নিয়েই বিষ্ময় জাগে! কোনও নিয়ম-কানুন নেই।” এখন খোদ রাহুলই সেই প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে! গত ৪৮ মাসেও নতুন টিম তৈরি করতে পারেননি তিনি। উল্টে সনিয়া গাঁধীর যে টিম ছিল, তার সদস্যদেরও কাজ প্রায় কেড়ে নিয়েছেন। বকলমে এক সময় দল চালাতেন আহমেদ পটেল। ওয়ার্কিং কমিটি থেকে শুরু করে রাজ্য স্তরের নেতা, মুখ্যমন্ত্রী, শরিকদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রাখতেন, হাইকম্যান্ডের তরফে নির্দেশ দিতেন। এখন দলের কোনও সিদ্ধান্তের খবরই তাঁর কাছে আগাম থাকে না! টেক্সটের জবাব দেওয়ার ফুরসৎ থাকত না যাঁর, নতুন ট্যুইটার অ্যাকাউন্ট খুলে তিনি এখন নিয়মিত ট্যুইট করতে পারেন! দশ নম্বর জনপথের খাস লোক হিসাবে পটেলের পাল্টা গোষ্ঠী ছিল দিগ্বিজয়ের। ভুল হোক, ত্রুটি হোক, নিজের লোককে টিকিট পাইয়ে দেওয়া হোক, শিল্প মহলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হোক, সকালে বিকেলে কংগ্রেস দফতরে বসে অন্তত কর্মীদের সঙ্গে দেখা করতেন তিনি। এখন সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নামে অন্ধ্রপ্রদেশ-কর্নাটকের দায়িত্বে তিনি, কিন্তু আদতে ‘বেকার’। মাঝে মাঝেই চলে যান ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফি করতে। আবার জনার্দন দ্বিবেদী, মতিলাল ভোরা, মোহনপ্রকাশ, সি পি জোশীর মতো ‘কার্যত অকেজো’ নেতারাও দলের পদ আঁকড়ে রয়েছেন। পদে থেকেও তাঁরা কুটোটিও নাড়ছেন না। সন্তোষমোহন দেবের কন্যা শিলচরের সাংসদ সুস্মিতা দেব তাই বলছেন, “শুধু রাহুলকে দোষ দিয়ে কী লাভ? তিনি তো সহজ নিশানা! দলে তো তাবড় নেতার অভাব নেই। পরাজয় হলেই সব দোষ রাহুলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিব্যি তাঁরা গা ঢাকা দিয়ে থাকেন।” সুস্মিতার প্রশ্ন এটা কেন হবে? বাকি নেতারা কেন সাংগঠনিক দুর্বলতার দায় নেবেন না?
তবে দিল্লিতে কংগ্রেস সাফ হয়ে যাওয়ার পর সেই অচলাবস্থা কাটানোর জন্য এখন অবশ্যই চাপ বাড়তে শুরু করেছে রাহুলের ওপর। প্রশ্ন হল, তা হলে গত ন’মাস ধরে কী করলেন রাহুল? কংগ্রেস সূত্র বলছে, একেবারে কিছু করেননি বললে অন্যায় হবে। দেশের অন্তত চারশ কংগ্রেস নেতার সঙ্গে গত তিন মাসে বৈঠক করেছেন। তার পর কংগ্রেসের সংস্কারের জন্য ১১ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট তৈরি করেছেন। মজার বিষয় হল, সমসাময়িক পরিস্থিতিতে কংগ্রেসকে চাঙ্গা করার জন্য সব ওষুধ রয়েছে ওই প্রেসক্রিপশনে। যেমন, ব্লক থেকে ওয়ার্কিং কমিটি পর্যন্ত নেতাদের কাজ ও দায়বদ্ধতা সুনিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে, নেতাদের মৌরসিপাট্টা ও স্বজনপোষণ বন্ধ করতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলা হয়েছে, পঞ্চায়েত-পুরভোট বা বিধানসভায় প্রার্থী নির্বাচনে স্থানীয় নেতাদের মতকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, এমনকী বিজেপি বা আপ-এর মতো ক্যাডার তৈরি করতে তহবিল তৈরি ও কর্মীদের মাসোহারা দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
কিন্তু গণ্ডগোল গোড়াতেই। তাঁর ঘনিষ্ঠ প্রাক্তন এক মন্ত্রীর কথায়, রাহুলের আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি এতটাই যে ওই রিপোর্ট রূপায়ণেও দেরি করছেন তিনি। অজুহাত হল, এ ব্যাপারে প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিগুলি থেকে এখনও মতামত আসেনি। চলতি মাসে ওই রিপোর্ট এলে তবেই তা কার্যকরী হবে। অথচ অর্ধেক প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি জানেনই না যে এমন কোনও রিপোর্ট তৈরি হয়েছে। যেমন পশ্চিমবঙ্গের প্রদেশ দফতরে সেই রিপোর্ট পাঠানো হলেও, অধীর চৌধুরীর হাতেই তা পৌঁছয়নি আজও।
সব মিলিয়ে কংগ্রেসে এখন রোষের কেন্দ্রবিন্দু যেমন রাহুল, তেমনই পরিত্রাণের জন্য তাঁর দিকেই তাকিয়ে কর্মীরা। মজা করে কংগ্রেসের এক নেতা আজ বলেন, হয়তো সব শেষ হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন রাহুল। তার পরে নতুন করে শুরু করবেন!