রেলের মালিকানা সরকারের হাতে রেখেই সংস্কারের নীল নকশা চূড়ান্ত করে ফেললেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
সংস্কারের চাকায় গতি আনতে গতকালই অর্ডিন্যান্স জারি করে বিমায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানো হয়েছে। একই ভাবে অর্ডিন্যান্স আনা হয়েছে কয়লা খনি নিলামের ক্ষেত্রে। এ বার পালা রেলের। ইতিমধ্যেই রেলের ১৭টি ক্ষেত্রে একশো শতাংশ বিদেশি লগ্নির জন্য খুলে দিয়েছে সরকার। আগামী দিনে ওই ক্ষেত্রগুলির জন্য বিদেশি লগ্নি টানতে সরকার যে বদ্ধপরিকর, তা আজ স্পষ্ট করে দিলেন প্রধানমন্ত্রী।
বাজেটে রেলে একশো শতাংশ বিদেশি লগ্নির জন্য খুলে দেওয়ার পর থেকেই সংশয় ছিল, তা হলে কি এ বার বেসরকারিকরণের পথে হাঁটবে কেন্দ্র? রেল ইউনিয়নগুলি ইতিমধ্যেই সরকারের ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পথে নামার হুমকি দিয়ে রেখেছে। স্বভাবতই কর্মীদের ওই আশঙ্কা দূর করতে সরকারের পক্ষ থেকে রেল কর্মীদের বার্তা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হচ্ছিল। আজ সেই বার্তা দিতে বারাণসীর ডিজেল লোকোমোটিভ ওয়ার্কসের অনুষ্ঠানকে বেছে নেন প্রধানমন্ত্রী। সূত্রের খবর, গতকালই বিষয়টি নিয়ে সুরেশ প্রভুর সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন মোদী। তখনই ঠিক হয়, আজ রেলের অনুষ্ঠান থেকেই এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করবেন মোদী। আজ রেলের ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, “কোনও ভাবেই রেলের বেসরকারিকরণ করা হবে না।” এ বিষয়ে মন্ত্রকের বক্তব্য, বিদেশি বিনিয়োগ মানেই যে বেসরকারিকরণ নয়, সেই বার্তাই আজ প্রধানমন্ত্রী দিতে চেয়েছেন।
সবিস্তার ব্যাখ্যায় রেলমন্ত্রক বলছে, একশো শতাংশ বিদেশি লগ্নির কথা ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই রেলের কর্মীদের একাংশ চাকরি হারানোর ভয় করছিল। সেই আশঙ্কা জানিয়ে ইতিমধ্যেই রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভুর কাছে দরবার করেছে রেল ইউনিয়নগুলি। আজ তাই প্রধানমন্ত্রী রেলের মালিকানা সরকারের হাতে রাখার কথা বলে কার্যত রেলের ১৩ লক্ষ কর্মচারীকে আশ্বস্ত করলেন যে তাদের চাকরি সুরক্ষিত। একই সঙ্গে তিনি এ-ও বুঝিয়ে দিয়েছেন, সংস্কারের যে ক্ষেত্রগুলি মন্ত্রক ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করেছে সেখানে বিদেশি বিনিয়োগের দরজা খোলা থাকবে। সেই নীতি থেকে কখনওই পিছিয়ে আসা হবে না।
প্রাথমিক ভাবে যে ১৭টি ক্ষেত্র বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে বুলেট ট্রেন, হাই স্পিড করিডর, বিশ্বমানের স্টেশন, পণ্যবাহী করিডর, যাত্রী নিরাপত্তার ক্ষেত্রগুলি। এই ক্ষেত্রগুলিতে নিজ সামর্থ্যে কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন তা বর্তমানে রেল কেন, কেন্দ্রের হাতেও নেই। কেন না, শুধুমাত্র ঘোষিত প্রকল্প শেষ করতে রেলের প্রয়োজন ছ’লক্ষ কোটি টাকা। যে টাকা কোথা থেকে আসবে, তার কোনও সদুত্তর নেই কোনও রেল কর্তার কাছে। ফলে ভারতীয় রেলকে আধুনিক রূপ ও পরিকাঠামোগত ভাবে নতুন চেহারা দিতে হলে এখন বিদেশি বিনিয়োগের উপর ভরসা করা ছাড়া উপায় নেই কেন্দ্রের। মোদী বলেন, “যদি ভারতীয় রেলের উন্নতিতে ডলার, ইউরো বা ইয়েন আসে, ক্ষতি কী? ওই টাকা রেলের উন্নতিতেই কাজে লাগবে।”
তবে রেলে সংস্কারের লক্ষ্যে দরজা হাট করে খুলে দিলেই যে বিনিয়োগ আসবে, এমন নয়। এর আগেও রেলে বিদেশি বিনিয়োগ টানার চেষ্টা করেছিলেন প্রাক্তন রেলমন্ত্রীরা। কিন্তু নীতিপঙ্গুত্বের কারণে তা ব্যর্থ হয়। তা ছাড়া, রেলের সামনে অন্য সমস্যাও রয়েছে। ভবিষ্যতে বিদেশি বিনিয়োগ এলে সে ক্ষেত্রে ওই বিদেশি সংস্থার শর্ত মানতে বাধ্য থাকবে রেল। এখন যেমন পশ্চিম পণ্য করিডর নির্মাণে অর্থ বিনিয়োগ করেছে জাপান। কিন্তু সেই অর্থের বিনিময়ে তাদের শর্তই হল ওই করিডর নির্মাণ থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে ওই রুটে চালানোর জন্য যে ইঞ্জিন-কামরা-ওয়াগন লাগবে তা সবই কিনতে হবে জাপানি সংস্থা থেকে। দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বেও থাকবে ওই জাপানি সংস্থাগুলি। এ ক্ষেত্রে ওই করিডরে দেশীয় বা অন্য কোনও দেশের প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারবে না ভারতীয় রেল। একই শর্ত প্রযোজ্য মুম্বই-আমদাবাদ বুলেট ট্রেনের ক্ষেত্রে। ফলে যে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য রেল এখন হা-পিত্যেশ করে বসে রয়েছে তা বাস্তবায়িত হলে রেলের পক্ষে ভাল হবে, এ কথা মানতে নারাজ অল ইন্ডিয়া রেলওয়েমেনস ফেডারেশনের সর্বাভারতীয় সম্পাদক শিবগোপাল মিশ্র। তাঁর আশঙ্কা, “ব্যবসায়ীরা তো আর দান-খয়রাত করতে রেলে টাকা লাগাবে না।
তাদের লাভের কথা মাথায় রেখে পয়সা ঢালবেন। সেই লাভ দেখতে গিয়ে রেলের ক্ষতি হবে বলেই আমাদের আশঙ্কা।”
তবে রেলের ক্ষেত্রে যে সংস্কারের আশু প্রয়োজন, তা গত এক দশক ধরে বলে আসছিল যোজনা কমিশন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ওই বক্তব্যের সঙ্গে একমত ছিলেন। কিন্তু জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় সংস্কার তো দূর, ক্রমশ পপুলিজমের চোরাবালিতে তলিয়ে গিয়েছে ভারতীয় রেল। এই পরিস্থিতিতে ক্ষমতায় এসেই তাই রেলে সংস্কারের ডাক দেন প্রধানমন্ত্রী। রেলমন্ত্রী হিসেবে সদানন্দ গৌড়া কার্যত ব্যর্থ হওয়ায় দেরি না করে নিজের লোক সুরেশ প্রভুকেও রেলমন্ত্রকে নিয়ে আসেন মোদী। বাড়ানো হয় ভাড়াও। এমনকী, তেলের দাম কমা সত্ত্বেও রেলের ভাড়া কমানোর মতো জনমোহিনী পথে হাঁটতে চায়নি কেন্দ্র। উল্টে রেল যে আগামী দিনে সংস্কারের পথে হেঁটে ভাড়া আরও বাড়াবে, সেই ইঙ্গিতও দিয়ে রেখেছেন সুরেশ প্রভু। এ বার রেলে উন্নত পরিষেবার লক্ষ্যে বেসরকারি লগ্নি টানতে কেন্দ্র যে সর্বাত্মক ভাবে ঝাঁপাবে, তা আজ ফের এক বার স্পষ্ট করে দিলেন প্রধানমন্ত্রী।