এই সব নানা কথা ভাবতে ভাবতে নিদ্রাহীন দুটি চোখের পাতা কখন এক হয়ে গিয়েছিল সবে ত্রিশের কোঠায় পা দেওয়া যুবক শিবাজির। অকস্মাত্ তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। বিছানায় উঠে বসলেন তিনি। এ কি সত্যি না স্বপ্ন? মা ভবানী কি সত্যিই এসেছিলেন তাঁর কাছে? যেন মনে হল, তিনি বলছেন, ‘ওরে ওঠ, আর ঘুমোস না। তুই জিতবি রে জিতবি! আফজল খানের কাছে তুই কিছুতেই হারবি না, কিছুতেই না!’
মনে বল পেলেন শিবাজি। দেখতে পেলেন আশার ক্ষীণ আলো। কিন্তু ওই দোর্দণ্ডপ্রতাপ আফজল খানের বিরুদ্ধে কী ভাবে আসবে জয়? অনেক চিন্তা করে শিবাজি ঠিক করলেন তিনি মিলিত হবেন আফজল খানের সঙ্গে। আফজল খানও সম্মতি দিলেন ওই প্রস্তাবে। ঠিক হল দু’জনের সাক্ষাত্ হবে প্রতাপগড় দুর্গের কাছে এক স্থানে। প্রতাপগড় দুর্গ মহারাষ্ট্রের জঙ্গল-ঘেরা সুউচ্চ পাহাড়ে নিজ মহিমায় দণ্ডায়মান। সেই পাহাড়েরই নীচে নির্মিত হল একটি মণ্ডপ। সেখানেই সাক্ষাত্ হবে দু’জনের—শিবাজি এবং আফজল খান।
আফজল খানের সঙ্গে সাক্ষাত্—কিন্তু ক্রূর সর্পকে কি কেউ বিশ্বাস করে? সন্ধিপ্রস্তাবের ছল করে সেরার রাজা কস্তুরি রঙ্গাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁকে হত্যা করেছিল আফজল খান। দুরাত্মাকে কখনও বিশ্বাস করতে নেই।
তাই শিবাজি গায়ে ও মাথায় চড়ালেন লোহার বর্ম ও শিরস্ত্রাণ। তার ওপর আলখাল্লা ও মাথায় উষ্ণীষ। বাম হাতে পরলেন বাঘনখ লাগানো দস্তানা এবং ডান হাতের জামার হাতার ভাঁজে লুকিয়ে রাখলেন একটি ভোজালি। তাঁর লুটিয়ে-পড়া পুরো-হাতা সাদা আলখাল্লার নীচে সব চাপা পড়ে গেল। হ্যাঁ, এ বার তিনি প্রস্তুত!
প্রণাম করলেন জিজামাতাকে। মা পুত্রকে আশীর্বাদ করলেন, ‘তুমি জয়যুক্ত হও।’
শিবাজি এবং আফজল খান দু’জনের কেবল দু’জন করে দেহরক্ষী উপস্থিত থাকবে সাক্ষাত্স্থলে, এমনই কথা হয়েছিল। তারিখটি ছিল ১০ নভেম্বর, ১৬৫৯ সাল।
বিশালকায় দীর্ঘদেহী আফজল খান শিবাজির জন্য অপেক্ষায় রত। শিবাজি এক সময় প্রবেশ করলেন সুসজ্জিত তাঁবুতে। আপাতদৃষ্টিতে শিবাজিকে দেখে মনে হল, তিনি নিরস্ত্র—যেন কোনও বিদ্রোহী এখানে আত্মসমর্পণ করতে এসেছে।
আফজলের পাশে রাখা ছিল তলোয়ার এবং ভোজালি। শিবাজি মঞ্চে উঠলেন, যেখানে আফজল খান উপবিষ্ট ছিলেন এবং মাথা নুইয়ে অভিবাদন করলেন।
আফজল—চাতুর্যে যার জুড়ি মেলা ভার, ত্বড়িত্গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে শিবাজিকে আলিঙ্গন করলেন। বিরাট দেহ আফজলের কাঁধের কাছে আকৃতিতে ছোটখাটো মরাঠা বীর। এই অসম আকৃতির সুযোগে বাঁ হাতে আফজল শিবাজির গলা জড়িয়ে ধরলেন লৌহ কঠিন ফাঁসে। ডান হাতে তুলে নিলেন ধারালো চকচকে ছুরি এবং আঘাত করলেন শিবাজির দেহের এক পাশে। শিবাজির দেহে বর্ম থাকায় সেই ছুরিকাঘাত প্রতিহত হল। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকিত হলেও আঘাত সামলে নিতে অবশ্য শিবাজির দেরি হল না। বাঘের মতো ক্ষিপ্রতায় শিবাজি তাঁর বা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন আফজলের কোমর এবং সঙ্গে সঙ্গে পরপর বাঘনখের আঘাতে চিরে ফেললেন আফজলের পেট। আফজল খান যন্ত্রণায়, ক্ষোভে চিত্কার করে উঠলেন, ‘বিশ্বাসঘাতক! খুন করে ফেলল আমায়! বাঁচাও বাঁচাও, কে আছ বাঁচাও!’
শিবাজি ততক্ষণে লাফ দিয়ে নেমে এসেছেন মঞ্চ থেকে। আফজলের বিশ্বস্ত সঙ্গী সৈয়দ বান্দা শিবাজির পথ আটকে দাঁড়াল। হাতে তার বিশাল ঝকঝকে খাপখোলা তলোয়ার। এক কোপ বসাল সে শিবাজির মাথায়। পাগড়ি দু’টুকরো হয়ে গেল তাঁর। কাহিনি এখানেই খতম হলে মরাঠা ইতিহাস আজ অন্য ভাবে লেখা হত। কিন্তু না, পাগড়ির নীচে লোহার শিরস্ত্রাণ এ বারেও রক্ষা করল তাঁকে। শিবজির বিশ্বস্ত দেহরক্ষী জীব মহলা ত্বড়িত্গতিতে কেটে ফেলল সৈয়দের ডান হাত এবং হত্যা করল তাকে, নিজের প্রভুকে বাঁচানোর জন্য।
এ দিকে দেখা যাক, আফজল খানের কী হল। বাঘনখের আঘাতে তার পেটের নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে এসেছে। পালকিবাহকরা আফজলকে পালকিতে চাপিয়ে পালাতে যাওয়ার উপক্রম করছে—এমন সময় শিবাজির আরেক বিশ্বস্ত রক্ষী শম্ভুজি কাওজি পালকি থেকে নামিয়ে আফজল খানের শিরচ্ছেদ করলেন।
জয় হল শিবাজির। মা ভবানীর আশীর্বাদ সত্যি হল। স্বরাজ্য স্থাপনের পথে এক ধাপ এগোলেন তিনি এবং তা সম্পূর্ণ নিজের দুর্জয় সাহস আর প্রত্যুত্পন্নমতিত্বের জোরে।
চার বছর পর, ১৬৬৩, পুণে
এ বার প্রতিপক্ষ মুঘল। ঔ রঙ্গজেবের মাতুল শায়েস্তা খান হয়ে দাঁড়িয়েছে শিবাজির পথের কাঁটা। একের পর এক অঞ্চল হাতছাড়া হচ্ছে তাঁর। চাকান, কালিয়ান, এমনকী পুণেও অধিকার করে নিয়েছে শায়েস্তা খান। এই চার বছর ধরে যে স্বরাজ্য তিনি গড়ে তুলেছিলেন তার অনেকটাই গেছে মুঘলদের দখলে। তাই এই শায়েস্তা খানকে শায়েস্তা না করলে চলছে না।
এ বার চরম আঘাত হানতে হবে যা কার্যত মনোবল ভেঙে দেবে মুঘলদের। কিন্তু কী ভাবে? সম্মুখ সমরে কিছুতেই মুঘলদের বিরুদ্ধে জয়লাভ সম্ভব নয়। বলবান কে? যে বাহুবলে বলীয়ান, না কি বুদ্ধির্যস্য বলং তস্য? দাক্ষিণাত্যের মুঘল শাসক শায়েস্তা খানকে কী ভাবে সরিয়ে দেওয়া যায়, তা-ই এখন একমাত্র চিন্তা মরাঠাসূর্য শিবাজি মহারাজের।
অবেশেষে এল একদিন সেই সুযোগ। ৫ এপ্রিল, ১৬৬৩ সাল। পুণেতে মুঘলদের তাঁবুর সামনে রাতের প্রথম প্রহরে দেখা গেল একদল সৈন্যকে। সেই সৈন্যদলের অগ্রভাগে যিনি, তিনি মূল ফটকের নৈশপ্রহরীকে বললেন, এই মুঘল সৈন্যরা এসেছে নৈশ পাহারার জন্য। যারা এখন নৈশ পাহারায়, তাদের অব্যাহতি দিয়ে এরাই এখন এদের কর্তব্য করবে।
তখন চলছে রমজান মাস। সূর্যাস্তের পর উপবাস ভঙ্গ করে মধ্যরাতের পূর্বেই ক্লান্ত শরীরে শায়েস্তা খান ও তাঁর পরিবারের লোক গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। মুঘল সেনা ছাউনিগুলোতে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। কেবল এখানে-ওখানে দু’ একটা টিমটিমে আলো চিনিয়ে দিচ্ছিল প্রহরীদের অবস্থান। সেই সময় ওই আগুন্তুক নিঃশব্দে ডেকে নিল পঞ্চাশ জন সৈনিককে। পাকশালার দেওয়ালে গর্ত করে তার মধ্যে দিয়ে সেই সেনারা প্রবেশ করল শায়েস্তা খানের অন্দরমহলে। কেটে ফেলল শিবিরের আচ্ছাদন। অন্ধকার রাতে শয়নগৃহে অনুপ্রবেশ করে পালঙ্কে শায়িত মানুষদের ওপর চালাল তরবারি। মুহূর্তের মধ্যে সৃষ্টি হল প্রচণ্ড কলরব। এই কলরব যতটা না শায়িতদের, তার চেয়েও বেশি আঘাতকারীদের। তারা লোকজনকে বিভ্রান্ত করে ফেলল। আর এই ডামাডোলের সুযোগে কাজ হাশিল করে সেই আক্রমণকারীরা ফিরে গেল সিংহগড়—যেখান থেকে তারা এসেছিল। কে ছিলেন এই গুটিকয়েক সেনার নেতৃত্বে? বলার অপেক্ষা রাখে না—ইনিই ছিলেন শিবাজি! আবারও সেই অকুতোভয় মানুষটির দুর্জয় সাহসের নমুনা! অতর্কিত আক্রমণে শায়েস্তা খান প্রাণে বেঁচে গেলেও জখম হয়েছিলেন। জানালা দিয়ে পালাতে গিয়ে তরবারির আঘাতে কাটা পড়েছিল হাতের আঙুলগুলো।
অবিশ্বাস্য—এক কথায় অবিশ্বাস্য ছিল এই আঘাত। সুরক্ষিত মুঘল সেনাবেষ্টিত এই শিবিরে প্রবেশ করতে হলে যে অদম্য সাহস আর মনোবল দরকার তা শিবাজির ছিল এবং এই অসম যুদ্ধে জয়লাভ করে তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন। শিবাজির বীরত্বের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। আক্রমণের ফলে দাক্ষিণাত্যের মুঘলশাসক শায়েস্তা খান পিছু হটে গিয়েছিলেন এবং পালিয়ে গিয়েছিলেন বুরহানপুরে।
পরে তাঁকে বাংলায় স্থানান্তরিত করা হয়। এই ঘটনার মাধ্যমে শিবাজি দাক্ষিণাত্যের মুঘলদের উপরে চরম আঘাত হানতে সমর্থ হয়েছিলেন।
পাহাড় আর জঙ্গলের
বিজয়মুকুট দুর্গপ্রাকার
শিবাজির রাজত্বে একটা গিরিপথও সুরক্ষাহীন ছিল না। একটা গিরিশীর্ষও দুর্গহীন ছিল না। প্রত্যেকটি তালুক বা অঞ্চলে ছিল এক বা একাধিক রক্ষাকর্তা। সমগ্র রাজ্য জুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে ছিল দুর্গ আর দুর্গ। শিবাজির রাজ্যে পুরনো ও নতুন মিলিয়ে দুশো চল্ল়িশটি দুর্গ ছিল। দুর্গগুলি কেবল পাহাড় বা জঙ্গল জুড়ে ছিল তা নয়, ছিল নৌবাহিনীর উপযোগী উপকূলবর্তী দুর্গও।
দুর্গ নির্মাণের স্থান নির্বাচনেও খুব সাবধানতা অবলম্বন করা হত। উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় যেখানে খাড়া রাস্তা উঠে গেছে এঁকেবেঁকে—সেই সব স্থান দুর্গ নির্মাণের আদর্শ হিসেবে গণ্য হত। থাকত বিশাল দুর্গপ্রাকার, যার জায়গায় জায়গায় থাকত সশস্ত্র প্রহরা। দুর্গগুলিতে শস্য মজুতের ব্যবস্থা থাকত সেনা ও অন্য আবাসিকদের জন্য। থাকত তেল ও ঘিয়ের সঞ্চয়। আর সুব্যবস্থা থাকত পানীয় জলের —এ জন্য প্রতিটি দুর্গেই ছিল অনেকগুলো করে পানিতালাও।
এই সব দুর্গের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এত জোরদার ছিল যে ১৬৮০ সালে শিবাজির মৃত্যুর পর এক-একটি দুর্গ জয় করতে মুঘলদের প্রচুর অর্থ, লোকবল ও সময় ব্যয়িত হয়েছে। শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য দুর্গজালিকা নিমাণ—এ শিবাজি মহারাজের দ্বারাই সম্ভব হয়েছে।
মহারাষ্ট্রে শিবাজি মহারাজকে ভগবান জ্ঞানে পুজো করা হয়। এক জন মানুষের মধ্যে যদি এত অতি-মানবীয় গুণের প্রকাশ ঘটে, তবে তিনি সাধারণের কাছে দেবতায় উন্নীত হবেন, এটাই স্বাভাবিক।
১৯ ফেব্রুয়ারি শিবাজি মহারাজের জন্মদিন। তাই লেখার মাধ্যমে তাঁর প্রতি জানালাম আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি। মহারাষ্ট্রে রয়েছি অথচ শিবাজির জন্মজয়ন্তীতে লিখব না, এমনটা হতে পারে না। মহারাষ্ট্রের পাহাড়ে-জঙ্গলে-আকাশে-বাতাসে মানুষের মনে শিবাজির যে বীরত্বের কাহিনি, দেশপ্রেমের কাহিনি লেখা রয়েছেতার খুব সামান্যই স্মরণ করলাম এই লেখায়। এই প্রসঙ্গে বলি, মহারাষ্ট্র সরকার আরব সাগরের ওপর ১৯০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট শিবাজির মূর্তি ও স্মরণসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছেন। এই স্থানটি রাজভবন থেকে দেড় কিলোমিটার দূরত্বে আরব সাগরের মধ্যে। গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া ও প্রস্তাবিত নরিম্যান পয়েন্টের জেটি থেকে এই স্মারকসৌধে যাওয়া যাবে। এটি নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে আরব সাগরের মধ্যে ভূগর্ভস্থ শিলাস্তরের ওপর। শিবাজির জীবন সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করার জন্য এখানে তৈরি হবে মিউজিয়াম, অ্যাম্ফিথিয়েটার, এক্সিবিশন গ্যালারি ইত্যাদি। তবে এই পরিকল্পনার বাস্তব রূপায়ণ নির্ভর করছে অনেক কিছুর উপর, যার একটি কারণ হল পরিবেশ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় সংক্রান্ত।
এ বার শেষ করব। তবে তার আগে একবার আমাদের দেবাদিদেব মহাদেবকে স্মরণ করি। আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি শিবরাত্রি যে! মহাদেব-মহাকাল-আর সেই দেবাদিদেব যদি নৃত্যরত হন অর্থাত্ নটরাজ। কেন জানি না, শিবের এই নটরাজ মূর্তিই যেন বেশি আকর্ষণ করে। দুর্বার এক নৃত্যছন্দে তিনি আবিষ্ট। তাঁর নৃত্যের তালে তালে আবর্তিত হচ্ছে জন্ম-মৃত্যু, সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়। মোক্ষ আর ভ্রম তাঁর নৃত্যের অনুসারী। নটরাজ—তিনি এ সব কিছুতেই চরম উদাসীন যোগী। তাঁর ওই অগ্নিময় নৃত্যের ভঙ্গিমা দেহে জাহায় শিহরন, কিন্তু মনে নিয়ে আসে এক অনির্বচনীয় অনুভূতিএ নৃত্য আনন্দতাণ্ডব। হে নটরাজ, তোমার নাচের তালে করো আমাদের মোহমুক্তি —সব জাগতিক কামনা-বাসনা পুড়ে ছাই হয়ে যাক। ‘অন্ধকারের উত্স হতে উত্সারিত আলো—সেই তো তোমার আলো’!