গত তিন দিন ধরে চলা যাবতীয় জল্পনার অবসান ঘটিয়ে পাকিস্তান আজ জানিয়ে দিল, সোমবার নরেন্দ্র মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসছেন নওয়াজ শরিফ। মঙ্গলবার সকালে মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন তিনি। যে সিদ্ধান্ত জানার পরে কূটনীতিকরা অনেকেই বলছেন, গত কাল আফগানিস্তানের হেরাটে ভারতীয় দূতাবাসে জঙ্গি হানার ঘটনা তা হলে শাপে বর হয়ে গেল!
প্রশ্ন হচ্ছে, কী ভাবে এই হানার ঘটনা প্রভাব ফেলেছে প্রেক্ষাপটে?
কূটনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, হেরাটে জঙ্গি হামলার ঘটনাকে সফল ভাবে কাজে লাগিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। আইএসআই এবং পাক সেনাবাহিনীকে তিনি এ কথাই বলেছেন যে, ওই ঘটনার পর ভারত সফর বাতিল করলে ভুল বার্তা যাবে গোটা বিশ্বের কাছে। দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই, আমেরিকা-সহ বিশ্বের অন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশের সামনে এ কথাই প্রমাণিত হয়ে যাবে যে, পাকিস্তান বন্দুকের সাহায্য নিয়ে শান্তি আলোচনাকে পণ্ড করছে। আজ সকালের মধ্যেই নওয়াজ সে দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দল এবং সেনাপ্রধানের সঙ্গে আলোচনা শেষ করে সফরের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলেন। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য সওয়াল করছিলেন নওয়াজ। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তাঁকে সেই সুযোগ করে দিয়েছে মোদীর আমন্ত্রণ। তার পরে কাল হেরাটে হানার যে ঘটনা ঘটে, তাকে ব্যবহার করে পাক সেনা এবং আইএসআইয়ের সামনে নিজের যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলেন নওয়াজ। গত কয়েক বছর ধরে দু’দেশের সম্পর্কে যে হিমের পরশ লেগেছে, এর ফলে তা কাটতে পারে বলেই মনে করছেন কূটনীতিকরা।
নওয়াজ যে মোদীর আমন্ত্রণ রাখতে চাইছেন, সেটা কাল বোঝা গিয়েছিল তাঁর মেয়ে মরিয়মের টুইট দেখার পরেই। মরিয়ম বলেছিলেন, ভারতের নয়া সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখা উচিত। পুরনো ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে আসার কথাও বলেন তিনি। আজ পাক প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, সেনাপ্রধান রাহিল শরিফকে বোঝাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন নওয়াজের ভাই শাহবাজ। পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ কাল আধ ঘণ্টা বৈঠক করেন রাহিলের সঙ্গে। প্রাক্তন সেনাপ্রধান কিয়ানির সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ভাল। ফলে দাদার সাহায্যে তিনি বড় ভূমিকা নিয়েছেন।
হেরাট-হানার পরে চাপ কিন্তু মোদীর উপরেও ছিল। পাক মদতে চলা সন্ত্রাসের মধ্যে ইসলামাবাদের সঙ্গে আলোচনার তাৎপর্য কী, এই নিয়ে প্রশ্ন তুলে কড়া সমালোচনা শুরু করেছে কংগ্রেস। এমনও বলা হচ্ছে, এক দিকে যখন পাক সাহায্যপ্রাপ্ত জঙ্গিরা ভারতীয় কূটনীতিকদের আক্রমণের নিশানা করছে, তখন শান্তি আলোচনা শুরু করা এক ধরনের ‘রোম্যান্টিকতা’ ছাড়া আর কিছুই নয়। সমালোচকরা আরও বলছেন, মোদী তাঁর ভোট-প্রচারে আগাগোড়া পাক সন্ত্রাসের তীব্র নিন্দা করে জিতে এসে পরে ভোল বদলে ফেলেছেন।
মার্কিন কূটনীতিকদের একাংশ কিন্তু মোদীর সঙ্গে তুলনা টানছেন প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের। বরাবর কমিউনিস্ট বিরোধী নিক্সনই চিনের সঙ্গে সম্পর্কের বরফ গলাতে পেরেছিলেন। এ ক্ষেত্রেও একদা হিন্দুত্বের পোস্টার বয় মোদীই পারবেন পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের শৈত্য কমাতে, মনে করছেন তাঁরা। অভ্যন্তরীণ চাপে এক চুলও না নড়ে মোদী এর মধ্যেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি বিষয়টি নিয়ে কতটা ভেবেছেন। হেরাটের ঘটনার পরে পাকিস্তানের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য তাঁর উপরে চাপ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু মোদী গুরুত্ব দেননি। ঠিক যে ভাবে দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক দলগুলির আপত্তি সত্ত্বেও তিনি শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষেকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন বলেই ঠিক রয়েছে।
মোদী শিবিরের যুক্তি, হেরাটের হাতেগরম সন্ত্রাসের বিষয়টি সামনে এসে পড়ায় বরং উল্টো সুবিধা হয়ে গিয়েছে তাঁরও। নওয়াজের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এই উদাহরণ দেখিয়ে পাকিস্তানের সার্বিক ছায়াযুদ্ধের বিষয়টি তুলে ধরতে পারবেন।
মোদীর এই শান্তি উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছে আমেরিকা-সহ পশ্চিম বিশ্ব। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার আগেই তাঁর এই মোক্ষম চাল কূটনৈতিক ভাবে ভারতকে কিছুটা সুবিধাজনক জায়গায় এনে দিল বলেই মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি, বিশেষজ্ঞরা এই ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন যে, গোটা ঘটনায় সুকৌশলে পাকিস্তানের ভিতরের ‘অসুখকে’ সর্বসমক্ষে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন মোদী। তাঁর ডাকে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিতে না পারার কারণ যে ইসলামাবাদের বহু-কেন্দ্রিক নেতৃত্ব সেই বিষয়টি ফের আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে। এ দিন পাক বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র তসনিম আসলামের কথাতেও তা স্পষ্ট। তসনিম জানান, বৃহস্পতিবারই সিদ্ধান্ত হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কিছু কারণে দেরি হয়ে গেল। পাশাপাশি মোদীও সীমান্তে সংঘর্ষ এবং সন্ত্রাস নিয়ে পূর্বসূরিদের পথ ছেড়ে কঠোর অবস্থান নিতে পারেন। বিজেপি সূত্রেই এই কথা বলা হয়েছে।
নওয়াজ কতটা তৈরি হয়ে আসছেন? পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রক থেকে জানানো হয়েছে, নওয়াজের প্রতিনিধি দলে থাকবেন নিরাপত্তা ও বিদেশনীতি সংক্রান্ত উপদেষ্টা সরতাজ আজিজ, বিশেষ সচিব তারিখ ফতেমি এবং বিদেশসচিব আজিজ চৌধুরি। এই প্রতিনিধিদলটি থেকেই স্পষ্ট, ভারত সফরকে শুধুই জনসংযোগের কূটনীতিতে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছেন না নওয়াজ। বরং সুযোগ কাজে লাগাতে তিনি তৈরি। রাজনৈতিক সূত্রের খবর, গত তিন দিন ধরে এ ব্যাপারে যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করেছেন নওয়াজ। ভারতের বিমান ধরার আগে জাতীয় স্তরে সব রাজনৈতিক দল, সেনা ও আইএসআই-এর সঙ্গে তিনি ঐকমত্য তৈরি করেছেন। পাকিস্তান মুসলিম লিগের এক নেতা আজ জানিয়েছেন, এ জন্যই ৭২ ঘণ্টা সময় লেগেছে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে।
নওয়াজের তৃতীয় দফার প্রধানমন্ত্রিত্বে এই প্রথম ভারত সফর। পাক মুসলিম লিগ সূত্রে জানা গিয়েছে, সেনাবাহিনীকে নওয়াজ বলেছেন, দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসার যে সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে, তাতে কাশ্মীর-সহ পাকিস্তানের বিভিন্ন বিষয়কে উত্থাপন করতে পারবেন তিনি। কাশ্মীরের হুরিয়ত নেতাদের সঙ্গেও তিনি আলোচনা করতে চাইছেন এই সফরে। কারণ, জঙ্গি নেতা হাফিজ সঈদ আজই প্রশ্ন তুলেছেন, ভারতে যে যাচ্ছেন নওয়াজ, এর পরে কাশ্মীরিদের কাছে তিনি মুখ দেখাবেন কী করে!
ইতিমধ্যেই নওয়াজের ভারতে আসার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা। তিনি বলেছেন, “পাক প্রধানমন্ত্রীর নিমন্ত্রণ গ্রহণ করার ঘটনায় আমি খুবই খুশি। এই সফরে দু’দেশের মধ্যে এক নতুন যুগের সূচনা হবে বলেই আশা করছি। জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষ গোটা বিষয়টি খুব মন দিয়ে লক্ষ করছে।” রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও বৈঠক করবেন তিনি। ব্যক্তিগত ভাবে প্রণবের সঙ্গে সখ্যও রয়েছে নওয়াজের।