সৌত্রিক দে কুই নোহ্ (ভিয়েতনাম)
কর্মসূত্রে ভিয়েতনামে থাকি। চান্দ্র নববর্ষ খুব জাঁকজমকে পালন করা হয়। একে এরা বলে ‘টেট হলিডে’। সেই ছুটি কাটাতে সিঁথিতে বাড়ি চলে এসেছিলাম। ফেব্রুয়ারির ২ তারিখে ফের রওনা দিই ভিয়েতনামের উদ্দেশে। ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যম ও বন্ধুদের থেকে জেনে গিয়েছি, নতুন একটা মারাত্মক ভাইরাসের আক্রমণে চিন বিধ্বস্ত। সারা বিশ্ব এর করাল প্রকোপে চরম সঙ্কটের মুখে পড়তে চলেছে। নানা সংবাদমাধ্যমের দৌলতে বুঝে গিয়েছিলাম, কী কী সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তাই মাস্ক কিনে নিলাম, সঙ্গে হ্যান্ড স্যানিটাইজ়ার।
দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছে দেখি, শতকরা ৩০ ভাগ যাত্রীর মুখে মাস্ক। তা-ও অনেকেই কথা বলার সময়ে তা মুখ থেকে নামিয়ে নিচ্ছেন। কিছু মানুষ নোভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তাই খুব সহজে হাত দিচ্ছেন না কিছুতে। আর ওয়াশরুমে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে স্যানিটাইজ়ার ব্যবহার করছেন। আমার যাত্রা হল শুরু।
হ্যানয়ের নয় বাই বিমানবন্দরে পৌঁছে অবাক হয়ে দেখলাম— যাত্রী থেকে কর্মী, প্রত্যেকের মুখে মাস্ক। একে অপরের সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলাফেরা করছেন সকলে। কথাও বলছেন মাস্ক পরে। প্রতি ৫ মিটার অন্তর হ্যান্ড স্যানিটাইজ়ার রাখা। অনবরত তার ব্যবহার চলছে। মর্মে মর্মে অনুভব করলাম আমার দেশের তথাকথিত শিক্ষিত, উচ্চবিত্তরাও কত উদাসীন। আর এঁরা কতটাই সাবধানী ও সজাগ। কষ্ট হল, আমার দেশে থাকা মা, বাবা, বোন আর প্রিয়জনেদের জন্য। তাঁরা কতটা আশঙ্কাজনক পরিবেশে রয়েছে ভেবে।
বিমানবন্দর থেকে বাসে হোটেলে গেলাম। হোটেলে সর্বত্রই দেখলাম সকলে কতটা সচেতন ও সক্রিয় নোভেল করোনাভাইরাসের মোকাবিলায়। পরের দিন সকালের ফ্লাইটে যাব কুই নোহ্, আমার কর্মস্থল। বাসে ওঠামাত্র আমার ওপর স্যানিটাইজ়ার স্প্রে করা হল। গন্ধটা অ্যালকোহলের মতো।
শুধু এই সময়ে নয়, ভিয়েতনামিরা এমনিতেই বেশ স্বাস্থ্য সচেতন। এখানে ছোটবেলা থেকে মাস্ক পরে বাইরে যাওয়ার অভ্যাস করানো হয়। অন্তত ৬০ শতাংশ মানুষ প্রতিদিন মাস্ক ব্যবহার করেন। এটা ভিয়েতনামিদের দৈনন্দিন জীবনের অভ্যাস।
এখানকার যুবসমাজ এটাকে একটা ‘স্টাইল স্টেটমেন্ট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। তাই এরা এতটা সুরক্ষিত। একটু ঠান্ডা লাগলেই এরা মাস্ক পরে নেয়। যাতে অন্যদের বিব্রত হতে না-হয়, আশঙ্কায় থাকতে না-হয় সংক্রমণের।
এখানে সব সাধারণ শৌচালয়ে সাবান ও স্যানিটাইজ়ার রাখা থাকে। প্রতিটি অফিসের প্রবেশ দ্বারে স্যানিটাইজ়ার, লিফটে স্যানিটাইজ়ার, শপিং মলে স্যানিটাইজ়ার। যেখানেই প্রচুর জনসমাগম হয়, সেখানেই স্যানিটাইজ়ার রাখাটা এদের সংস্কৃতি। এই ভাবেই এরা ভেঙে ফেলে সংক্রমণের দীর্ঘ শৃঙ্খল।
এখানকার মহিলাদের মধ্যে ‘ওয়েট টিস্যু’র ব্যবহার খুবই প্রচলিত। বড়দের হলে, অ্যালকোহলের ভাগ থাকে। ছোটদের জন্য হলে থাকে সোডিয়াম বেনজ়য়েট, সেটিলপাইরিডিনিয়াম ক্লোরাইডের মতো কিছু রাসায়নিক। মহিলারা নিজেদের হাত, শিশুদের মুখ অনবরত মুছে নেয় এই টিস্যু দিয়ে। এতেই জীবাণুমুক্ত থাকে মা ও শিশু উভয়েই। আগে যে-সব অভ্যাস ছিল না আমার, সেগুলির সঙ্গে বেশ মানিয়ে নিয়েছি এখন। ভিয়েতনাম আমাকে শিখিয়েছে সুস্থ থাকার মূলমন্ত্র: নিজেকে জীবাণুমুক্ত ও সুস্থ রাখো, অন্যকেও সুস্থ থাকতে সাহায্য করো।
লেখক একটি বহুজাতিক সংস্থার প্ল্যানিং ম্যানেজার।