পৃথিবী এখন যে ধরনের কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, কবে যে সব আবার আগের মতো হবে, এই প্রশ্নের উত্তর কারও কাছে নেই। এই সময় যারা দ্বাদশ শ্রেণি পাশ করে কলেজের পথে পা বাড়াচ্ছ, আর যারা এই বছর স্নাতক হয়ে চাকরির দুনিয়ায় যোগ দিতে যাচ্ছ, তাদের জন্যে এই বছরটি স্বভাবতই অনেক বেশি ‘চ্যালেঞ্জিং’।
একই সঙ্গে এই বছর যে সব ছাত্রছাত্রী বিভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষা দেবে, তাদেরও দুশ্চিন্তার শেষ নেই। কিন্তু তোমাদের ধৈর্য ধরে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে যেতেই হবে। অন্যান্য বছর বোর্ড পরীক্ষার পরে এই সব এন্ট্রান্স টেস্টের জন্য আলাদা করে নিজেকে তৈরি করার সময় খুব কম থাকে। আশার কথা, এ বছর তা নয়। হাতে যে সময়টা পাচ্ছ, সেটা পুরোটা ব্যবহার করে নিজের খামতিগুলো পুষিয়ে নাও। তোমাদের মতোই এক ছাত্র ঋচিক ঘোষ জানাল, “এই সময়টি আমার জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন সময়। স্বাভাবিক ভাবেই দুশ্চিন্তায় রয়েছি— কবে প্রবেশিকা পরীক্ষা হবে, তার ফলই বা কবে বেরোবে। আমার মতে, এখন পরীক্ষার জন্যে তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইন্ডোর গেমস খেললে, গল্পের বই পড়লে, বন্ধুদের সঙ্গে কথা বললে এই সময়টা কাটতে পারে।”
যারা কলেজে পড়ছ, তাদের বলি— নিজেদের কয়েকটি প্রশ্ন করো। এক সময় পৃথিবী আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসবে, কিন্তু তুমি কি তার জন্য তৈরি? এত দিন যে ভাবে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবে এসেছ, তখনও কি সে ভাবেই ভাবলে চলবে? আগামী দিনের চাকরির বাজারের জন্যে তোমার বর্তমান যোগ্যতা কি যথেষ্ট? ধরেই নেওয়া যায়, প্রায় সব রকম ব্যবসার কাজে আমূল পরিবর্তন আসবে বা এসে গিয়েছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে নিজের চিন্তাধারা বদলানোর সময়ও কিন্তু হয়েছে। না হলে আগামী দিনের কাজের দুনিয়ায় নিজেকে অন্যদের থেকে এগিয়ে রাখতে পারবে না। অদৃশ্য এক শত্রুর মোকাবিলা করতে আমরা যখন বাড়িবন্দি, তখন আমাদের অনেকের কাছেই হাতে সময় আগের চেয়ে বেশি। এই সময়টাকে নষ্ট না করে, নতুন দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করা ভাল।
সময়ের সদ্ব্যবহার
• অন্যান্য বছর বোর্ড পরীক্ষার পরে এই সব এন্ট্রান্স টেস্টের জন্য আলাদা করে নিজেকে তৈরি করার সময় খুবই কম থাকে। আশার কথা, এ বছর তা নয়। হাতে যে সময়টা পাচ্ছ, সেটা পুরোটা ব্যবহার করে নিজের খামতিগুলো পুষিয়ে নাও।
• বেশ কিছু ক্ষেত্রে সরকার পোষিত কোর্স আছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কোর্স তো আছেই। তাই, কোর্স নির্বাচনের সময় ভাল ভাবে খেয়াল রাখতে হবে, কারা ট্রেনিং দিচ্ছেন, কোর্স শেষে কী সার্টিফিকেট তোমাকে দেওয়া হচ্ছে এবং বাজারে সেটা কতখানি গ্রহণযোগ্য।
বাড়ি বসে নিজের স্কিল বাড়ানোর সেই সুযোগ করে দিচ্ছে ইন্টারনেট। কত রকমের অনলাইন কোর্স রয়েছে; কোনটা তোমার করা উচিত? সব দিক বিবেচনা করে দেখে নাও, যে কোর্সটা করবে ভাবছ, সেটা তোমার কেরিয়ারকে কত দূর এগিয়ে দিতে পারে। এই ধরনের পরামর্শের জন্য ঠিক লোককে খুঁজে বার করাটাও কিন্তু একটা বড় কাজ। কে তোমার পরিস্থিতি বুঝে ঠিক পরামর্শ দিতে পারবেন, সেটা কি তুমি নিজেও ভাল করে ভেবে দেখেছ? অনেক সময়ই এমন পরামর্শের উপর নির্ভর করে জীবনের গতি অন্য রকম হয়ে যেতে পারে।
বেশ কিছু ক্ষেত্রে সরকার পোষিত কোর্স আছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কোর্স তো আছেই। এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, কারা ট্রেনিং দিচ্ছেন, কোর্স শেষে কী সার্টিফিকেট তোমাকে দেওয়া হচ্ছে এবং বাজারে সেটা কতখানি গ্রহণযোগ্য। নিজের বিষয় অনুযায়ী দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি আরও কিছু বিষয় নিয়ে ভাবতে পারো, যেগুলি এখন তো বটেই, পরেও কাজে দিতে পারে। যেমন,
• কোডিং— আগামী দিনে প্রচুর ব্যবসা নিজেদের ভার্চুয়াল দুনিয়ায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। সে ক্ষেত্রে তাদের প্রয়োজন হবে পেশাদার কোডার ও ডেভলপার। বিভিন্ন সাইট রয়েছে, যেখানে বিনামূল্য বেসিক থেকে ইন্টারমিডিয়েট স্তরের কোডিং শেখা সম্ভব। অনলাইন কোডিং প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়ে নিজের র্যাঙ্কিং বাড়াতে পারলে পরে তা চাকরির ক্ষেত্রে অনেক সময় সুবিধে করে দেয়।
• ডিজিটাল মার্কেটিং— ব্যবসা যখন অনলাইন হয়ে যাবে, তখন ভাল ডিজিটাল মার্কেটার-এর চাহিদাও বাড়বে। অনলাইনে বিনামূল্যে বা টাকা দিয়েই অনেক জায়গায় ডিজিটাল মার্কেটিং শেখা যায়।
• কপিরাইটিং— ব্যবসা অনলাইন হয়ে গেলে বিজ্ঞাপন ও ব্যবসার নিজস্ব পাতা এবং তার কনটেন্ট লেখার প্রয়োজনও বাড়বে। ফলে ভাল কপিরাইটারেরও প্রয়োজন হবে সংস্থাগুলোর।
• ফিনানশিয়াল প্ল্যানার— ব্যবসার ধরনে যখন আমূল পরিবর্তন আসতে চলেছে, তখন কী ভাবে নিজের জমানো পুঁজি কাজে লাগানো যায়, তার পরামর্শ দিতে পারবেন এক জন দক্ষ ফিনানশিয়াল প্ল্যানার। অনেক জায়গায় এই বিষয়েও নানা অনলাইন কোর্স আছে।
• সফ্ট স্কিল ডেভলপমেন্ট— এই সময় কমিউনিকেশন স্কিলও বাড়ানো যায় অনলাইন কোর্সের মাধ্যমে। যে ভাল কথা বলতে পারে, অনেক ক্ষেত্রেই তার কদর বেশি। একই সঙ্গে ভাষার ওপর দক্ষতা বাড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ তো এখনই।
• ব্লগিং— ব্লগ লেখা অনেকের শখের বিষয় হলেও এটা করে অনেকে উপার্জনও করেন। প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, খেলাধুলো, সিনেমা— যার যে দিকে আগ্রহ, সেই নিয়ে ব্লগ বানাতে পারো। ইন্টারনেট ঘাঁটলে অনেক ওয়েবসাইট পাবে, যেখানে ব্লগার হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। সেগুলো দেখতে পারো।
• এক্সট্রাকারিকুলার অ্যাক্টিভিটি—শুধুই পড়াশোনা নয়, এখন অনেক কলেজে ভর্তির সময় ছাত্রছাত্রীদের এক্সট্রাকারিকুলার অ্যাক্টিভিটি সম্পর্কেও জানতে চাওয়া হয়। যে হেতু অতিমারির কারণে এখন বাইরে গিয়ে কিছু শেখা মুশকিল, তাই বাড়ি বসেই আমেরিকার কোনও শিক্ষকের কাছে গিটার, অস্ট্রেলিয়ার কারও কাছে আঁকা বা স্পেনের কারও কাছ থেকে কোনও খেলা শিখে নিতে পারো।
এমআইটি-র কনডেন্সড ম্যাটার ফিজ়িক্স-এর পিএইচ ডি-র ছাত্র অর্ক চট্টোপাধ্যায় জানালেন, “১৬৬৫-৬৬ সালে ইংল্যান্ডে প্লেগ মহামারির সময় স্যর আইজ়্যাক নিউটন কোয়রান্টিনে বাড়ি ফিরে এসে ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেন। কথাটা আগেই জানা, কিন্তু তাও এখন আমি ও আমার বন্ধুরা অনেকেই কথাটা ভেবে ভেবে নিজেদের অনুপ্রাণিত করছি। এই নতুন পরিস্থিতিতে আমাদের নিজেদের থামিয়ে রাখলে চলবে না। এই সময় আমি কলেজের অনলাইন ক্লাস করার সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন সম্মেলনেও যোগ দিচ্ছি। নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করছি। আমার মনে হয় কোভিড-১৯’এর শেষে, নতুন পৃথিবীতে প্রত্যেক ছাত্রকেই আগের থেকে বেশি প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে।”
অর্থাৎ পরিস্থিতি সহজ নয়, হয়তো আরও কঠিন হতে চলেছে। কিন্তু এখন হতাশ হওয়ার সময় নয়, বরং নিজেকে তৈরি করার সময়। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, ‘এভরি ক্লাউড হ্যাজ় আ সিলভার লাইনিং’। পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক না কেন, সেই আশার আলোর রেখাটিকে কে কী ভাবে কাজে লাগাচ্ছ, তার উপরেই জীবন নির্ভর করবে। সুতরাং, আজকের দুঃসময়ে ওই আশার রুপোলি আলোটুকু আঁকড়ে থাকা বড্ড জরুরি।
ম্যানেজার, জেকবস-সিইএস