গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
ময়দা-মাখনের মখমলি মিলমিশের এতখানি সাহস, কে জানত!
নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান পেরিয়ে নানা ধর্মের মানুষকে মিলিয়ে মিশিয়ে সে-ই তো এক করে ছাড়ল! আর তাই কেকের হাত ধরেই বরাবরের মতো এক হয়ে গেল বড়দিনের কলকাতা।
এ শহরটা আসলে চিরকালের মেল্টিং পট। এ দেশ-ও দেশ থেকে মানুষ এসেছে। নানা ধর্মের, নানা বর্ণের মানুষ আস্তানা গেড়েছে। আলাদা হয়েও মহানগরের মিলিজুলি সংসারে যেন এক হয়ে গিয়েছে তাদের খাবারদাবার, সাজগোজ, জীবনযাপনের অনেক কিছুই। কলকাতা তাই অবলীলায় তার বড়দিনে গড়ে নিয়েছে কেকের এক নিজস্ব কালচার। যে সংস্কৃতিতে সাহেবি কেক খ্রিস্টানি কিচেন পেরিয়ে আজও অনায়াসে তৈরি হয়ে চলেছে ইহুদি-অ্যাংলো ইন্ডিয়ান-হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধদের হেঁশেলে। ডিসেম্বর মাসভর নানা ভাষা, নানা গোষ্ঠীর হাতে তৈরি সেই কেকের খোঁজে পুরনো বেকারিগুলোতে ঢুঁ মারতে ভোলে না কলকাতা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যে সুস্বাদের টান বয়ে নিয়ে চলে সগর্বে।
ব্রিটিশ আমলে কলকাতায় এক সময়ে বড়দিন মানেই ছিল গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের বেকারি কিংবা ফ্লুরিজ়ের খাস বিলিতি কেক। তবু ম্যাজিকটা ঘটে গেল অন্য কোনওখানে। তাতেই কলকাতার বড়দিনের সঙ্গে চিরকালের মতো জুড়ে গেল এক ইহুদি পরিবারের নাম। বাগদাদের ইহুদি পরিবারের সন্তান নাহুম ইজ়রায়েল মোরডেকাইয়ের হাত ধরে ১৯০২ সালে এ শহর পেল তার প্রথম এবং একমাত্র ইহুদি বেকারি ‘নাহুমস’ বা নাহুম অ্যান্ড সন্স। বড়দিনের কেকের সঙ্গে প্রায় সমার্থক হয়ে যাওয়া পুরনো নিউ মার্কেট অর্থাৎ হগ মার্কেটের এই বেকারিতে কাঠের তাকে থরে থরে সাজানো প্লাম কেক, রিচ ফ্রুট কেক, স্পেশ্যাল ক্রিসমাস ফ্রুট কেক, ম্যাকারন বা লেমন টার্ট কিনতে এখনও ফি বছর লম্বা লাইন পড়ে ২৫ ডিসেম্বরের ঢের আগে থেকেই।
১৯০২ সালে এ শহর পেল তার প্রথম এবং একমাত্র ইহুদি বেকারি ‘নাহুমস’ বা নাহুম অ্যান্ড সন্স। ছবি: সংগৃহীত।
থিয়েটার রোডের বাঙালি খ্রিস্টান পরিবারে বড় হয়েছেন গায়ক রূপম ইসলাম। ছোটবেলায় বড়দিন মানেই ঘরদোর সেজে উঠত আলো, গ্রিটিং কার্ড, ক্রিসমাস ট্রি, সান্তা ক্লজ়ে। আর অবশ্যই থাকত কেক আর চিপস। রূপমের কথায়, “নিউ মার্কেটে দোকানে দোকানে ঘুরে কেক চেখে দেখে কিনতাম আমরা। তখন ইচ্ছে হলেও নাহুমসের কেক কেনার সামর্থ্য ছিল না। এখন হলে হয়তো কেক আসবে নাহুমস থেকে। অবশ্য নিজে গিয়ে কেক কেনা বা ঘর সাজানোর সময় আর পাই না এখন। তবে ছোটবেলার মতো এখনও বড়দিনের সকালে কেক আর চিপস আমার চাই-ই চাই।“
ধর্মতলা পেরিয়ে এ বার যাওয়া যাক ওয়েলেসলির দিকে। তারই এক চিলতে গলিতে হলদে বাড়িটার গায়ে লেখা ‘সালদানহা’। গোয়ান দম্পতির হাতে গড়া এই বেকারি আজও চালান পরিবারের লোকেরাই। এখন যার ভার নিয়েছেন তৃতীয় প্রজন্মের ডেবোরা আলেকজান্ডার ও তাঁর মেয়ে আলিশা। সেই ১৯৩০ সাল থেকে আজও বাড়িতেই মহিলাদের হাতে হাতে তৈরি হয় কেক। বছরভর নানা রকম জিনিস তাদের ভাঁড়ারে থাকলেও বড়দিনের ভিড়ের মরসুমে শুধুই ক্রিসমাস স্পেশ্যাল মেনু। “ডিসেম্বর পড়তেই ভিড় শুরু হয়ে গিয়েছে। রিচ ফ্রুট কেক, চকো ওয়ালনাট কেক, স্পেশ্যাল ফ্রুট কেক এ বারেও রয়েছে বড়দিনের স্পেশ্যাল মেনুতে,” চাহিদা মতো ক্রেতাদের হাতে কেকের প্যাকেট তুলে দেওয়ার ব্যস্ততার ফাঁকেই বললেন বেকারির কর্মী বরুণ কোয়েলহো।
গোয়ান দম্পতির হাতে গড়া ‘সালদানহা’ বেকারি আজও চালান পরিবারের লোকেরাই। ছবি: সংগৃহীত।
সেই ব্রিটিশ আমলেই বৌবাজারের অ্যাংলো পাড়া বো ব্যারাকে ছোট্ট এক বেকারি খুলেছিলেন যতীন্দ্রনাথ বড়ুয়া। রুজির টানে চট্টগ্রাম থেকে এ শহরে আসা, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জেএন বড়ুয়ার সেই বেকারি নিমেষেই হয়ে উঠল গোটা পাড়ার প্রিয় ঠিকানা। আর ক্রমে গোটা কলকাতারও। রংচটা নীল দেওয়ালের ছোট্ট দোকানটা এখন একা হাতেই সামলান যতীন্দ্রনাথের বড় ছেলে রতন বড়ুয়া। শীত পড়তে না পড়তেই হিমশিম খান ক্রেতাদের ভিড় সামলাতে। ঘরে তৈরি আঙুর, আপেল বা জিঞ্জার ওয়াইনের সুস্বাদে ওয়াইন কেক, রাম কেক, ওয়ালনাট কেক আজও আছে তাঁদের ডিসেম্বরের মেনুতে। তবে একেবারে শুরুর দিনগুলো থেকেই এখনও এই ছোট্ট বেকারি সবচেয়ে মন কাড়ে জেএন বড়ুয়ার সিগনেচার রেসিপি ছানাপোড়া কেকে। কর্মসূত্রে দিল্লিবাসী ঈপ্সিতা চট্টোপাধ্যায় যেমন বললেন, “ছোটবেলায় মা-বাবার সঙ্গে যেতাম বো ব্যারাকে। নানা রকম খাওয়াদাওয়া তো হতই, সঙ্গে ছানার কেক কেনা ছিল মাস্ট। এখনও বড়দিনে যদি কলকাতায় থাকি, ওই কেকটা আমার চাই-ই চাই!”
আর অন্যরা?
লোকে বলে, রান্নার স্বাদে-গুণে মুসলমান বাবুর্চিরা নাকি টেক্কা দিতে পারেন যাকে খুশি! সাহেব পাড়ার কেকের সঙ্গে টক্করে তাঁদের হাতও যে জাদু দেখাবে, তাতে আর সন্দেহ কী! মোমিনপুরের কে আলি বেকারি সেই জাদুতেই পেরিয়ে গিয়েছে ১১০ বছর। ছোট্ট দোকানটায়, তার চেহারায় সেই পুরনো আমলের সুবাস ভরপুর। সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপানিদের বোমা ফেলার আতঙ্কে কাঁটা হয়ে থাকা শহরে প্রথম জার্মান ব্রেড তৈরি করা শুরু করেন কে আলি। সেই রুটির স্বাদের কদরে ‘জার্মান বেকারি’ নামে খ্যাতির আলোয় আসা এই দোকানে আজও জার্মান ব্রেড তো বটেই, পাওয়া যায় হরেক রকম বিস্কুট, রুটি। পাওয়া যায় বাখরখানি বা অর্ডার দিলে শিরমলও। তবু শীত পড়তেই অর্ডারি কেকের পাল্লা ভারী। মূলত রিচ ড্রাই ফ্রুট কেক, অর্ডার বিশেষে ডিসেম্বর স্পেশ্যাল কেক আর জার্মান ব্রেড। এ সময়টায় তার বাইরে আর বিশেষ কিছু তৈরির ফুরসত মেলে না একেবারেই।
জেএন বড়ুয়ার সিগনেচার রেসিপি ছানাপোড়া কেক। ছবি: সংগৃহীত।
খিদিরপুরের মহল্লায় কে আলির বেকারি ঝাঁপ খুলেছিল ১৯৪২-এর সেই আগুনে দিনগুলোয়। বছর তিরিশ পরে হাতছানিতে সাড়া দিল হিন্দু পাড়াও। সত্তরের দশকে হাওড়ার নিউ হাওড়া বেকারিতে পুরোদস্তুর কেক-বিপ্লবই করে ফেললেন অলোকেশ জানা। তখন কেক মানেই খাস বিলিতি কিংবা অন্য নামী বেকারির দামি কেক। সাধ জাগলেই তাতে হাত ছোঁয়ানোর সাধ্য কই সকলের? সাহেবি সুস্বাদকে সর্বসাধারণের হাতের নাগালে নিয়ে আসতে, চায়ের সঙ্গে বিস্কুটের বদলে একটু ভারী বিকল্প হিসেবে অলোকেশ তৈরি করলেন নামমাত্র দামের বাপুজি কেক। মোরব্বা, বাদাম, খেজুর, কিশমিশে ঠাসা, বাটার পেপারের মোড়কে সেই সস্তার টিফিন কেক হাতে হাতে ঘুরতে লাগল আট থেকে আশি, সবারই। আজও পাড়ার চায়ের দোকান থেকে বাসস্ট্যান্ড, সারা বছর সর্বত্র ছেয়ে থাকে এই কেক। পেট ভরানোর চটজলদি উপায় হয়ে। “আমাদের কেকের স্বাদ, মান এবং ওজন আজও একই রকম। সঙ্গে এক রয়ে গিয়েছে কম দামের অনুপাতে সবচেয়ে ভাল কেক তৈরির চেষ্টা। বড়দিনে দশ-বারো রকম স্পেশ্যাল কেকও আমরা তৈরি করি বরাবর। শীতের বাজারে সেই কেকেরও ভালই চাহিদা”, বলছেন প্রয়াত অলোকেশবাবুর ছেলে অমিতাভ জানা। তিনি ও তাঁর ভাই অনিমেষ জানা এখন ব্যবসার দায়িত্বে।
আর সাহেব পাড়ার কেক?
গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল এখন নাম পাল্টে দ্য ললিত গ্রেট ইস্টার্ন। তার সে কালের বেকারি এ কালেও স্বমহিমায় বিরাজমান। পার্ক স্ট্রিটের একচ্ছত্র ঠিকানার ফ্লুরিজ় এখন দরজা খুলেছে শহরের এখানে ওখানে। রিচ প্লাম কেক, ড্রাই ফ্রুট কেক, ডেটস অ্যান্ড ওয়ালনাট কেক বা ডান্ডি কেকে আজও দুই ঠিকানাই মন কাড়ে আগের মতো।
সব মিলিয়ে কলকাতার বড়দিন আছে বড়দিনেই। বাকিটা কেক-মিলন্তির ম্যাজিক!