Autism Awareness Day 2023

২৫ বছর বয়সে হঠাৎই ধরা পড়ে অটিজ়ম, জীবনযুদ্ধ নিয়ে অকপট পোশাকশিল্পী

কয়েক বছর ধরেই অবসাদে ভুগছিলেন পোশাকশিল্পী শ্রেয়সী রাকা দাশ। শেষে ২৫ বছর বয়সে এসে ধরা পড়ল অটিজ়ম। ‘বিশ্ব অটিজ়ম দিবস’-এ আনন্দবাজার অনলাইনকে জানালেন নিজের অভিজ্ঞতার কথা।

Advertisement

রিচা রায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২৩ ১০:৩১
Share:

গান একটা বড় আশ্রয় শ্রেয়সীর। ছবি: সংগৃহীত।

শ্রেয়সী রাকা দাশ। শান্তিনিকেতনের মেয়ে। পোশাকশিল্পী। লালমাটিতেই বেড়ে ওঠা, বড় হওয়া। শ্রেয়সীর বয়স এখন ২৭। বছর দুয়েক আগে হঠাৎই জানতে পারেন, তিনি অটিস্টিক। জীবনের একটা ধাপ পেরিয়ে এসে, এমন কিছু তার জন‍্য অপেক্ষা করছে, কে জানত!

Advertisement

বেণী দুলিয়ে স্কুলে যাওয়া, মায়ের কাছে গান শেখা, মাঠে ধুলো উড়িয়ে খেলাধুলো, মন দিয়ে পড়াশোনা, শ্রেয়সীর শৈশব থেকে কৈশোর কেটেছে আর পাঁচ জনের মতোই। কোথাও কোনও ব‍্যতিক্রম ঘটেনি। নিজেকে নিয়ে আলাদা করে ভাবতে বসা নেই। অস্থিরতা নেই। পাঁচ জনের কানাঘুষো নেই। বরং বাবা-মায়ের বকাঝকা ছিল। অঙ্কে প্রচণ্ড ভয় ছিল। ইতিহাস নিয়ে পড়ার স্বপ্ন ছিল। মোদ্দা কথা, জীবন চলছিল স্বাভাবিক গতিতেই। কিন্তু জীবন তো আসলে নদীর মতো। কখনও স্রোতহীন, নিস্তরঙ্গ। আবার আবার কখনও এমন তরঙ্গের সৃষ্টি হয়, যার অভিঘাতে দুলে ওঠে চারপাশ। শ্রেয়সী তা জানেন ভাল করেই।

বেশ কয়েক বছর ধরেই অবসাদে ভুগছেন শ্রেয়সী। নানা সময়ে বিভিন্ন মনোবিদের পরামর্শ নিয়েছেন। কিন্তু কেউই অবসাদের উৎস ধরতে পারেননি। কারও মনে হয়েছে সব কিছু নিয়ে খানিক বেশি চিন্তা করছেন শ্রেয়সী। আবার কেউ বলেছেন, জীবনের নানা জটিলতায় অবসাদ আসা স্বাভাবিক। এটা ঠিক যে, অটিজ়মের ক্ষেত্রে সব সময়ে সঠিক নির্ণয় হয় না। অনেকের ক্ষেত্রেই এমন হয়। শ্রেয়সী তেমনই এক জন।

Advertisement

পলাশতলির আবহাওয়া শ্রেয়সীর মনের যত্ন নেয়।  ছবি: সংগৃহীত।

অবসাদ না কমায় দু’বছর আগে অন‍্য এক মনোবিদের কাছে যান শ্রেয়সী। তার পরেই জীবন বদলায় খানিক। মনোবিদের মনে হয় শ্রেয়সী অটিস্টিক। তিনিই এক জন মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে যেতে বলেন শ্রেয়সীকে।

মনোবিদের কাছে একাই গিয়েছিলেন শ্রেয়সী। তিনি অটিস্টিক, তা শোনার পর বিচলিত হয়ে পড়েন। সেই মুহূর্তে কী করা উচিত, বুঝতে পারছিলেন না। বাড়ি ফিরে প্রথম বাবাকে খবরটা দেন। শুরু হয় একটা নতুন লড়াই।

অন‍্য অসুখের মতো অটিজ়মের ক্ষেত্রে লক্ষণ দেখে সব সময় বোঝা যায় না। শ্রেয়সীরও যে চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দেওয়ার মতো কোনও লক্ষণ ছিল, তেমন নয়। তবে একেবারে কোনও লক্ষণ ছিল না, তা-ও না। শ্রেয়সী একেবারেই কোলাহল, চিৎকার, ভিড় সহ‍্য করতে পারেন না। দোল উৎসব কিংবা পৌষ মেলা, শান্তিনিকেতনের যে কোনও উৎসবেই বিপুল জনসমাগম হয়। সে সব উদ্‌যাপনে অংশ নিতেন না এমন নয়, কিন্তু খানিক অস্বস্তিতে থাকতেন। তবে পলাশতলির আবহাওয়া শ্রেয়সীর মনের যত্ন নেয়। এ ছাড়া গান একটা বড় আশ্রয় শ্রেয়সীর। পাঠভবনে পড়াকালীন গান শিখেছিলেন। কোথাও কোনও চিৎকার-চেঁচামেচি শুনলে হেডফোনে গান চালিয়ে শোনেন। স্বস্তি পান।

অঙ্কে অসম্ভব ভয় পেতেন শ্রেয়সী। গণিত-ভীতি কমবেশি সকলেরই আছে। কিন্তু কেসি নাগের জটিল অঙ্কে ভরা বইটা যেন গিলে খেতে আসত তাঁকে। একেবারে সহজ অঙ্কেও খেই হারিয়ে ফেলতেন মাঝখানে। আর জটিল সরল কিংবা পিতা-পুত্রের অঙ্ক হলে তো কথাই ছিল না। তখন বুঝতে পারেননি, পরে অবশ‍্য জেনেছেন অঙ্ক নিয়ে তাঁর এই অতিরিক্ত ভয় অটিজ়মের একটি লক্ষণ। এখন অবশ‍্য পেশাগত কারণে হিসাব রাখতে অঙ্ক করতে হয়। তবে সেই ভয় আর নেই।

পোশাকশিল্পী শ্রেয়সী কিন্তু আদতে ইতিহাসের ছাত্রী। বিশ্বভারতী থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর করেছেন। অঙ্কে ভীতি থাকলেও, ইতিহাসের প্রতি শ্রেয়সীর সারা জীবনের প্রেম। তাঁর কৌতূহলী মন অতীতের রহস‍্য জানতে চায়। কিছু দিন আগেই শ্রেয়সী বাংলাদেশ গিয়েছিলেন ইতিহাস নিয়ে একটি আলোচনাচক্রে যোগ দিতে। নিজের গবেষণাপত্র নিয়ে আলোচনা করেন সেখানে। তিনি অটিস্টিক, এ কথা জানার পর বাবা-মা ছাড়াও তাঁকে লড়াই করার সাহস জুগিয়েছিলেন যে মানুষটি, তিনি হলেন শ্রেয়সীর মনের মানুষ। বিশ্বভারতীতে আলাপ। দু’জনেরই বিষয় ইতিহাস। অতীত হাতড়াতে গিয়েই মিলেছে দু’জনের মন। শ্রেয়সীর কথায়, ‘‘আমার পার্টনার আমাকে যে ভাবে মানসিক সাহস জুগিয়েছে সেই সময়ে, তাতেই আমি অনেকটা জোর পেয়েছিলাম। আমি অটিস্টিক জানার পর আমার হাতটা আরও শক্ত করে ধরেছে ও। আমি ট্রেন ধরা নিয়ে প্রচণ্ড উদ্বেগে ভুগি। আগে ও বুঝতে পারত না, কেন এমন করছি। এখন বোঝে। আমাকে শান্ত করে। বোঝায়।’’

ইতিহাস থেকে ফ্যাশন দুনিয়া— দুটো দু’প্রান্তের বিষয়। অভিমুখ বদলে কী ভাবে পোশাকশিল্পী হয়ে উঠলেন তিনি? শ্রেয়সীর কথায়, ‘‘এ প্রশ্নটা আসলে সকলেই করেন। অভিমুখ বদলায়নি। আমার মা দারুণ শৌখিন। খুব সুন্দর করে সাজেন। ছোট থেকেই দেখছি। সাজগোজের প্রতি আমার উৎসাহ ছিলই। সেখান থেকেই আমার পোশাক সংস্থা ‘এসআরডি’-র জন্ম। আমি সব কথা সঠিক ভাবে প্রকাশ করতে পারি না। অনেক কথা মনেই থেকে যায়। আমি আমার সৃষ্টির মাধ্যমে কথা বলি। আমার প্রতিটি অপ্রকাশিত শব্দ আমার কাজের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায়। ভাবনা, চেতনা, অনুভূতির মিলিত প্রকাশ হল আমার কাজ।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন