পরিপাকতন্ত্রে আলসার? সচেতনতাই মূল ওষুধ বলছেন চিকিত্সকেরা

যে কোনও বয়সে পরিপাকতন্ত্রে আলসার হতে পারে। অ্যাসিডের আধিক্য, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ এই রোগের মূল কারণ। লক্ষণ বুঝে, ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করলে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। অবহেলা করলে কিন্তু রোগটি প্রাণঘাতীও হতে পারে। জানাচ্ছেন চিকিৎসক তাপস ঘোষ যে কোনও বয়সে পরিপাকতন্ত্রে আলসার হতে পারে। অ্যাসিডের আধিক্য, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ এই রোগের মূল কারণ। লক্ষণ বুঝে, ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করলে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। অবহেলা করলে কিন্তু রোগটি প্রাণঘাতীও হতে পারে। জানাচ্ছেন চিকিৎসক তাপস ঘোষ

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:১১
Share:

রোগী দেখছেন চিকিৎসক। ছবি: উদিত সিংহ

প্রশ্ন: শোনা যায়, অনেকেই আলসারে ভুগছেন। এই রোগটি কী?

Advertisement

উত্তর: সাধারণ ভাবে বলতে গেলে আলসার কথার অর্থ ক্ষত। এই ক্ষত পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন অংশে হয় এবং তা থেকে জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। পরিপাকতন্ত্রে অ্যাসিড বেশি মাত্রায় উৎপন্ন হলে এই রোগ হয়। অন্য দিকে, অ্যাসিড মাত্রা ঠিক থাকলেও কয়েকটি ক্ষেত্রে এই রোগ হয়। তখন সেই আলসারকে সংক্রমণ ঘটিত আলসার বলে।

প্রশ্ন: আলসার সাধারণত পরিপাক তন্ত্রের কোথায় হয়?

Advertisement

উত্তর: সাধারণ ভাবে খাদ্যথলি বা ক্ষুদ্রান্তের প্রথম ভাগে এই রোগ হয়। তবে এই রোগকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। খাদ্যথলির ভিতর যে আলসার হয় তাকে বলে গ্যাস্ট্রিক আলসার। ক্ষুদ্রান্তের প্রথম অংশে যে আলসার হয়, তাকে বলে ডিওডিনাম আলসার বলে।

প্রশ্ন: তা হলে, এই রোগ হওয়ার প্রধান কারণ কি অ্যাসিডের মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বেশি হওয়া আর সংক্রমণ?

উত্তর: একদম ঠিক। খাদ্যথলিতে অ্যাসিডের মাত্রাধিক্যের কারণে এই রোগ হলে সেখানে অ্যাসিড থেকে ক্ষত সৃষ্টি হয়। অন্য দিকে, সংক্রমণ থেকেও এই রোগ হয়। ‘এইচ পাইলোরি’ নামে একটি ব্যাকটেরিয়া থেকে সংক্রমণ হয়। এই সংক্রমণের ফলে ক্ষুদ্রান্তের ভিতরে আলসার দেখা দিতে পারে।

প্রশ্ন: এই রোগ হয়েছে, তা এক জন সাধারণ মানুষ বুঝবেন কী করে?

উত্তর: এই রোগের বেশ কিছু লক্ষণ আছে। সেগুলি খুব সাধারণ। বুকজ্বালা, পেটের উপরের দিকে যন্ত্রণা, খাওয়ার পরে পেট ফুলে থাকা বা পেট ফেঁপে থাকা, মুখ দিয়ে নুন জল ওঠা, গা বমি ইত্যাদি হলে বুঝতে হবে যে পেপটিক আলসার হলেও হতে পারে। এ ছাড়াও আরও একটি বিষয় জেনে রাখুন, গ্যাস্ট্রিক আলসার হলে, অর্থাৎ যদি খাদ্যথলিতে আলসার হয় তা হলে খাওয়ার পরেই পেট জ্বালা করবে। এই সময়ে রোগী খেতে ভয় পাবেন, খাওয়ার প্রতি অনীহা তৈরি হবে। অন্য দিকে, ডিওডিনাম আলসার অর্থাৎ ক্ষুদ্রান্তে আলসার হলে, পেট খালি থাকলে বা দীর্ঘক্ষণ না খেলে পেটে জ্বালা করবে। অনেক সময় রাতে অনেক ক্ষণ পেট খালি থাকলে, রোগী পেটের জ্বালা বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে কিছু খাবারের খোঁজ করেন। এগুলি খুব সাধারণ লক্ষণ। এর থেকে এই রোগ নির্ণয় করা সম্ভব।

প্রশ্ন: অনেক সময় তো খাওয়াদাওয়ার সমস্যা হলে বা সাধারণ গ্যাস অম্বল থেকেও বুকজ্বালা, গা বমি— এগুলি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কী ভাবে এই রোগ নির্ণয় সম্ভব?

উত্তর: ঠিকই বলেছেন। তবে এই উপসর্গগুলি যদি টানা বেশ কিছু দিন হয় বা সাধারণ গ্যাস, অম্বলের চিকিৎসা করিয়ে সমস্যা না মেটে, তা হলে বুঝতে হবে পরিপাকতন্ত্রে আলসার হয়েছে। এই বিষয়ে আমার বক্তব্য হল, গ্যাস, অম্বল যাই হোক না কেন, আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। বাজারচলতি নাম জানা কিছু গ্যাসের ওষুধ খেয়ে আমরা অনেক সময় নিজের অসতর্কতাবশত এই রোগ বাড়িয়ে তুলি।

প্রশ্ন: পরিপাকতন্ত্রে আলসার যাতে বাসা না বাঁধে, তার জন্য কী করতে হবে?

উত্তর: এ বিষয়ে বলে রাখা ভাল, আগে একটা ধারণা ছিল, ঝাল, মশলাদার খাবার খেলেই আলসার হতে পারে। কিন্তু এই ধারণা অনেকটাই ভুল। ঝাল বা মশলাদার খাবার এই আলসারের কারণ নয়। এই খাবার রোগকে বাড়িয়ে তোলে। আপনি যদি পরিপাকতন্ত্রে আলসার রোধ করতে চান, তা হলে, আগে আপনাকে ধূমপান এবং মদ্যপান বন্ধ করতে হবে। পেট খালি রাখা যাবে না। এক বারে অনেকটা না খেয়ে বার বার অল্প অল্প করে খান। আর একটা ভীষণ ভীষণ জরুরি কথা, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ব্যথা উপশম করার ওষুধ খাওয়া বন্ধ করতে হবে। আপনি বাতে বা অন্য ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন, দীর্ঘ দিন দোকান থেকে ব্যথা উপশমকারী ওষুধ খেয়ে কষ্ট লাঘব করছেন, অজান্তে কিন্তু আপনি পেটের মধ্যে এই মারণ রোগ ডেকে আনছেন।

প্রশ্ন: মারণ রোগ? মানে বলছেন এ ধরনের আলসার প্রাণঘাতী?

উত্তর: অবশ্যই, পরিপাকতন্ত্রের আলসার প্রাণঘাতী হতে পারে। এই রোগের ফলে খাদ্যথলি বা খাদ্যনালিতে রক্তপাত হতে পারে। এই রক্ত বমি বা মলের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। এই রোগে বাড়াবাড়ি হলে খাদ্যথলি ফুটো হয়ে যেতে পারে। এর পরে আপনি যদি কোনও চিকিৎসা না করিয়ে ফেলে রাখেন, তা হলে এই আলসার থেকে সহজে মুক্তি মেলে না। এবং বেশি বাড়াবাড়ি হলে মৃত্যুও ঘটতে পারে।

প্রশ্ন: অনেকেই বলেন, এই ধরনের আলসার থেকে ক্যানসারও হতে পারে, এটা কি ঠিক?

উত্তর: এই বিষয়ে বলে রাখা ভাল, এই ধরনের আলসার ক্যানসারের কারণ নয়। তবে সংক্রমণ দিনে দিনে বাড়লে, চিকিৎসা না করালে কিন্তু পরোক্ষ ভাবে এ রোগ থেকে আপনার শরীরে ক্যানসার নিজের জায়গা করে নিতে পারে।

প্রশ্ন: এই রোগের চিকিৎসা কী ভাবে হয়? এই রোগ কি সম্পূর্ণ সেরে যেতে পারে?

উত্তর: চিকিৎসা বলতে অ্যাসিডের মাত্রা কমানোর চিকিৎসা করা হয়। এইচ পাইলোরি ক্ষেত্রে এই সংক্রমণ কাটানোর চিকিৎসা করা হয়। তবে এটা বলি, আগে এই রোগের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করতে হত। তবে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায়, এই রোগে কোনও অস্ত্রোপচারের দরকার হয় না। এখন ওষুধেই রোগের সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। তবে আবার একই কথা বলছি, সমস্যা হলে গ্যাস, অম্বলের ওষুধ খেয়ে সাময়িক স্বস্তি পেয়ে রোগ বাড়াবেন না। সমস্যা হলেই চিকিৎসকের কাছে আসুন। তিনি যদি মনে করেন এন্ডোস্কোপি করিয়ে রোগ নির্ণয় করবেন।

প্রশ্ন: এন্ডোস্কোপি কি এই রোগ নির্ণয়ের অন্যতম পন্থা?

উত্তর: হ্যাঁ। ইউএসজি-র থেকে এন্ডোস্কোপি করানো ভাল। এই পরীক্ষার ফলে আলসার হয়েছে কি না তা ঠিকঠাক বোঝা যায়।

প্রশ্ন: কোন বয়সে এই রোগ বেশি দেখা যায়?

উত্তর: এই রোগ ছেলেমেয়ে, ৮ থেকে ৮০— সবার হতে পারে। তবে, একটু বেশি বয়সে এই রোগ বেশি হয়, কারণ তারা অনেকেই বাতের ব্যথায় কষ্ট পান। অনেকেই নানা আঘাত পান, তারা সেই সময় ব্যথা উপশমের ওষুধ খান। ফলে তাদের এই রোগ বেশি হয়। তবে, এখন মধ্যবয়সীদের ক্ষেত্রেও এই রোগ বেশি দেখা যাচ্ছে, কারণ, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন। সারাদিন কাজের চাপ। খাওয়ার কোনও সময় নেই, মানসিক চাপ— এ সবের ফলে পরিপাকতন্ত্রে অ্যাসিড মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এবং তাঁরা এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শিশুরাও আজ মাঠ থেকে দূরে, তারাও ছোট থেকে গ্যাস, অম্বলে ভুগছে। ফলে ছোটদের মধ্যেও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। তবে ছোটদের ক্ষেত্রে এই হার অনেকটাই কম।

প্রশ্ন: বড়দের কথা তো বললেন, শিশুদের ক্ষেত্রে কী ভাবে সতর্ক থাকতে হবে?

উত্তর: শিশুদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টা অনেকটা সহজ। কারণ, তারা বাবা-মায়ের অধীনে থাকেন। অবিভাবকেরা এই বিষয়ে সতর্ক থাকলেই সমস্যা মিটে যাবে। শিশুদের ফাস্ট ফুড থেকে বিরত রেখে, ভাল খাদ্যাভাস তৈরি করতে হবে। তাদের মাঠমুখো করা দরকার। শরীর মেদবহুল হওয়া আটকাতে হবে। এই বিষয়গুলি খেয়াল রাখলেই শিশুদের আলসার শুধু নয়, অন্যান্য নানা সমস্যা মিটে যাবে।

প্রশ্ন: আপনি তো দীর্ঘদিন বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে রয়েছেন। বর্ধমানে এই রোগের প্রকোপ কেমন?

উত্তর: দেখুন, সে ভাবে শতাংশ নির্ণয় তো করা যায় না। তবে অনেকে এই সমস্যা নিয়ে আসেন। বয়স্করা বেশি করে আসেন। তবে মাঝবয়সীরাও এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে, একটি ব্যাপার, যে কোন জায়গায় জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশ মানুষকে এই রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়।

প্রশ্ন: সব শেষে কি এটাই বলা যায়, সচেতনতাই এই রোগের প্রধান ওষুধ?

উত্তর: একদম। আবার বলছি। ধূমপান, মদ্যপান বর্জন, মানসিক চাপ কাটিয়ে ওঠা, ঠিক সময়ে খাওয়া, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ব্যথার ওষুধ না খাওয়া ইত্যাদিগুলি মেনে চলুন। এর ফলে দেখবেন শুধু আলসার নয়, অন্যান্য অনেক রোগ থেকে আপনি দূরে থাকবেন। অন্য একটি বিষয়েও একটু সর্তক করেদি, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যথার ওষুধ খেলে শুধু পেপটিক আলসার নয়, হার্টের সমস্যাও হতে পারে।

সাক্ষাৎকার: সুপ্রকাশ চৌধুরী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন