ঠান্ডা থেকে সাবধান

জমিয়ে ঠান্ডা পড়েছে। নানা উৎসবের মধ্যে দিয়ে তা উপভোগ করছেন।  কিন্তু এই ঠান্ডা থেকে নানা সমস্যা হতে পারে। তাই সাবধান থাকা জরুরি। জানাচ্ছেন চিকিৎসক অর্পণ রায়চৌধুরীজমিয়ে ঠান্ডা পড়েছে। নানা উৎসবের মধ্যে দিয়ে তা উপভোগ করছেন।  কিন্তু এই ঠান্ডা থেকে নানা সমস্যা হতে পারে। তাই সাবধান থাকা জরুরি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ ০১:০৫
Share:

প্রশ্ন: শীতে সবথেকে বেশি সমস্যা বয়ে আনে কোন রোগ?

Advertisement

উত্তর: শীতে সর্দিকাশিতে সবচেয়ে বেশি মানুষ ভোগেন। একে আমরা ‘কমন কোল্ড’ বলে থাকি। রাইনোভাইরাস নামের এক ধরনের ভাইরাস এর জন্য দায়ী। এই ভাইরাস মূলত নাক, মুখ, চোখ দিয়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। শীতের সময়ে এই ভাইরাস মূলত নাসারন্ধ্রে বাসা বেঁধে সংখ্যা বৃদ্ধি করে। ফলে নাক দিয়ে জল পড়ে। নাক বন্ধ হয়ে যায়। কাশি, হাঁচি, মাথাব্যথা ও জ্বর জ্বর ভাব দেখা দেয়।

Advertisement

প্রশ্ন: কাদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়?

উত্তর: ছ’ বছরের নীচের শিশুরা ঘন ঘন এই রোগের শিকার হয়। তবে, যে কোনও স্বাস্থ্যবান মানুষের বছরে দুই থেকে তিন বার কমন কোল্ডের শিকার হওয়াটা স্বাভাবিক ঘটনা।

প্রশ্ন: কী ভাবে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়?

উত্তর: এই রোগ হলে অনেকেই কাছের ওষুধের দোকান থেকে নিজেদের পছন্দমতো অ্যান্টিঅ্যালার্জিক বা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ কিনে খান। এটা ঠিক নয়। বিশেষ করে কমন কোল্ডে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই, যদি না তা সাইনাসের প্রদাহের মতো সমস্যা সাইনোসাইটিস (sinusitis) বা অ্যাকিউট ব্রঙ্কাইটিসের মতো জটিল আকার ধারণ করে। এই রোগের সতর্কতা হিসেবে, রোগীর সংস্পর্শে এলে ভাল ভাবে হাত ধুতে হবে। কারণ, রাইনোভাইরাস বাতাস ও স্পর্শে ছড়ায়। রোগীরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। যাতে তাঁর থেকে অন্য কারও এই রোগ না হয়। হাঁচি, কাশি ও নাক ঝাড়ার সময়ে রুমাল বা টিস্যু পেপার ব্যবহার করা উচিত। এতে রোগের আশঙ্কা অনেক কমে যাবে।

প্রশ্ন: শীতে আর কোন কোন সমস্যা বাড়ে?

উত্তর: শীতে হাঁপানির প্রকোপ বাড়ে। হাঁপানির জন্য যে সব ‘ট্রিগারিং ফ্যাক্টর’ থাকে তার মধ্যে শীতল বাতাস, ধুলো, ধোঁয়া, পরাগরেণু অন্যতম। শীতে ভীষণ ধুলো ওড়ে। হামেশাই দেখা যায়, হাঁপানি রোগী, যিনি এমনিতে দিব্য খোসমেজাজে ছিলেন, হঠাৎ এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস লাগার পরেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল। এবং তা বাড়তে থাকল। শরীরের এক বিশেষ হরমোনের মাত্রার তারতম্যের জন্য ভোররাতে হাঁপানি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। তখন সেই ব্যক্তিকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটতে হয়। আমাদের এই অঞ্চলে ক্রমাগত বেড়ে চলা বায়ুদূষণও এর আর
এক কারণ।

প্রশ্ন: হাঁপানি থেকে বাঁচতে কী কী সাবধানতা নিতে হবে?

উত্তর: শীতে হাঁপানি রোগীদের সাবধানে থাকতে হবে। ঠান্ডা হাওয়া, ধুলো, ধোঁয়া থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে হবে। এবং নিজের চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ইনহেলার ও আনুষঙ্গিক ওষুধ খেতে হবে। প্রতি পাঁচ বছরে একবার নিউমোকক্কাস ভ্যাকসিন আর ফি-বছর ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন যেন অবশ্যই নেওয়া হয়। ডায়াবেটিসের রোগীরা সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখুন।

প্রশ্ন: হাঁপানি ছাড়া আর কোন সমস্যা দেখা দেয় এই সময়ে?

উত্তর: হাঁপানির প্রকোপ ছাড়াও শীতে রক্তচাপ বৃদ্ধি ও হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা বাড়ে। দেখা গিয়েছে, রক্তে কোলেস্টেরল ও অন্যান্য উপাদান ছাড়াও কেবলমাত্র তাপমাত্রা কমার কারণে রক্তনালীর সঙ্কোচন হয়। ফলে এক দিকে, যেমন রক্তচাপ বাড়ে তেমনই হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতাও বাড়ে। তাই উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগীরা এই সময়ে নিয়মিত রক্তচাপ ‍পরীক্ষা করান ও ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নিন।

প্রশ্ন: শীতে ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়ার সমস্যায় অনেকে ভোগেন। এর থেকে বাঁচার উপায় কী?

উত্তর: শুষ্ক চর্ম বা ড্রাই স্কিন একটা বিরক্তিকর রোগ। যাঁকে ডাক্তারি পরিভাষায় ‘জেরোডার্মা’ (xeroderma) বলে। হাইপো থাইরয়েড ও এগজিমা রোগীদের এই প্রবণতা বেশি থাকে। ঠোঁট, মুখ, কনুই ও পায়ের পাতার চামড়া শুকিয়ে লাল হয়ে ভীষণ চুলকায়। এমনকী ফেটেও যায়। ময়েশ্চারাইজার, লুব্রিকেটিং ক্রিম, পেট্রোলিয়াম জেলি জাতীয় ক্রিম লাগালে আরাম মেলে।

প্রশ্ন: শীত মানসিক রোগীদের উপরে কি কোনও বিশেষ প্রভাব ফেলে?

উত্তর: এই সময়ে মানসিক ব্যাধির প্রোকোপ বাড়ে। এর নাম ‘সিজন্যাল এফেক্টিভ ডিসঅর্ডার’ বা এসএডি। যদিও বছরের যে কোনও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। কিন্তু শীতে এই রোগের প্রবণতা বাড়ে। বিশেষ করে যাঁরা গভীর অবসাদে ভুগছেন তাঁদের শীতের শুরু থেকেই নৈরাশ্য, অমনোযোগিতা, অবসন্নতা, সব সময় ঘুম ঘুম ভাব, হতাশা ও প্রায়ই আত্মহত্যার ইচ্ছা জাগে। শীত বিদায় নিলে, বসন্ত এলে এ সব উপসর্গ চলে যায়। এই মানসিক রোগটি মস্তিষ্কে এক ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার, সেরোটোনিন (যা মুডকে নিয়ন্ত্রণ করে) আর হরমোন মেলাটোনিন (যা ঘুমকে নিয়ন্ত্রণ করে) এর তারতম্যের উপর নির্ভর করে। প্রতি দিন সকালে ঘুম ভাঙার পরে এক ধরনের লাইটবক্সের উজ্জ্বল আলোর সামনে এক ঘণ্টা বসিয়ে রাখলে এঁরা ভাল থাকেন। এই ধরনের মানসিক ব্যাধি পরিবারের কারও থাকলে শীতের শুরুতেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

প্রশ্ন: শীত থেকে বাঁচতে আগুন পোহান অনেকে। কেউ কেউ রুম হিটার ব্যবহার করেন। এর থেকে কি কোনও বিপদ হতে পারে?

উত্তর: প্রবল ঠান্ডা থেকে সাময়িক আরাম পেতে নানা শ্রেণির মানুষ নানা পন্থা অবলম্বন করেন। যেমন, ফুটপাথবাসী মানুষ আগুন পোহান। মধ্যবিত্তরা রুম হিটার বা ব্লোয়ার চালান। বিত্তবানরা ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালান। অসতর্ক হলে আগুন লাগার ভয় তো আছেই। তা ছাড়াও রুম হিটারে, বিশেষত ব্লোয়ারগুলিতে কার্বন মোনোক্সাইড থেকে বিষক্রিয়ার আশঙ্কা থাকে। বন্ধ ঘরে বহুক্ষণ এই যন্ত্রগুলি চালিয়ে রাখলে মাথা ঝিমঝিম করে, মাথা ঘোরা, গা-বমি ভাব, ঝিমুনি ভাব-সহ শ্বাসকষ্ট হতে পারে। তখন বুঝতে হবে কার্বন মোনোক্সাইড থেকে বিষক্রিয়া হয়েছে। তৎক্ষণাৎ যন্ত্র বন্ধ করে ঘরের দরজা-জানলা খুলে দিতে হবে। তা না হলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। রুম হিটার বা ব্লোয়ার কখনই বেশিক্ষণ চালানো উচিত নয়। এবং ঘরের বাইরের বাতাস চলাচলের মতো একটু ব্যবস্থা রাখতে হবে। তা হলেই এই বিপদ এড়ানো যাবে।

প্রশ্ন: প্রবল ঠান্ডা থেকে কী কী বিপদ হতে পারে?

উত্তর: আমাদের এই অঞ্চলে ডিসেম্বর, জানুয়ারি মাসে তাপমাত্রা বেশ কমে গেলে অনেকে কোলাপস করে যান। এ ভাবে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে। বয়স্ক মানুষ আর শিশুদের এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। সুস্থ সবল মানুষও অনেকক্ষণ অরক্ষিত অবস্থায় থাকলে হাইপোথার্মিয়ার শিকার হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে শরীরের তাপমাত্রা ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটের কম হয়ে যায়। প্রচণ্ড ঠান্ডায় রোগী ঠকঠক করে কাঁপে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। কথা জড়িয়ে যায়। অবসন্ন হয়ে ঝিমিয়ে পড়ে। ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়। হৃদস্পন্দনে অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। ভেন্ট্রিকিউলার ফাইব্রিলিলেশন (ventricular fibrillilation) হলে মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে। শিশুদের গায়ের চামড়া লাল হয়ে শীতল হয়ে আসে ও নিস্তেজ হয়ে ঝিমিয়ে পড়ে।

প্রশ্ন: এমন হলে কী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার?

উত্তর: চটজলদি ব্যবস্থা নেওয়াটা জরুরি। রোগীকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঠান্ডা থেকে গরম পরিবেশে নিয়ে আসতে হবে। লেপ, কম্বল, স্লিপিং ব্যাগ বা যে কোনও গরম কাপড় দিয়ে মুড়ে দিতে হবে। তার পরে চিনি দেওয়া গরম দুধ, চা বা কোনও গরম পানীয় খাওয়াতে হবে। তবে সবচেয়ে ভাল রসুনের স্যুপ খাওয়া। রোগীকে চটজলদি গরম করতে হবে। কিন্তু হঠাৎ গায়ে গরম জল ঢেলে দেবেন না। তাতে কার্ডিয়াক অ্যারিথমিয়া (cardiac arrythmia) হতে পারে। এত কিছু করেও পরিস্থিতির উন্নতি না হলে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে এবং যাওয়ার পরে কার্ডিও পালমোনারি রেসুসিটেশন বা সিপিআর করতে হবে। সুতরাং হাইপোথার্মিয়া থেকে বাঁচতে আপার ও লোয়ার ইনার, গ্লাভস, টুপি, মাফলার, মোজা পড়ুন। এবং ভীষণ ঠান্ডায় অনেকক্ষণ ধরে খোলা আকাশের নীচে হালকা পোশাক পরে থাকার বিলাসিতা ত্যাগ করুন।

সাক্ষাৎকার: অর্পিতা মজুমদার

সাত দিনে সাত কাহনের বিভিন্ন বিভাগে ই-মেল বা চিঠি পাঠাতে:

ই-মেল: edit.southwestbengal@abp.in
চিঠি: আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬, প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা- ৭০০০০১।
চিঠি বা ই-মেলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের নাম উল্লেখ করতে ভুলবেন না

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন