পুকুরের নোংরা জলেই চলছে ঘরের নানা কাজ। ছবি: কল্যাণ আচার্য
জলের আরেক নাম জীবন। আবার ক্ষেত্রবিশেষে জল, মৃত্যুর পরোয়ানা বয়ে নিয়ে আসে। জীবাণু, ব্যাকটিরিয়া, প্রোটোজোয়া প্রভৃতি বিভিন্ন অণুজীব জল দ্বারা বাহিত হয়ে প্রায়ই মহামারি ঘটায়। পরিশ্রুত পানীয় জল না পাওয়ার জন্য ঘটে নানা ধরনের জলবাহিত রোগ। জল সত্যিই পরিশ্রুত কিনা তা জানবার জন্য যে নিয়মিত ও নিরন্তর তদারকি প্রয়োজন তা সচরাচর করা হয় না। মানুষের মধ্যেও রয়েছে সচেতনতার অভাব।
অনেক সময় দেখা যায় বাড়ির সামনে নিকাশি নালা দিয়ে জল বয়ে চলেছে। সেই নোংরা, ঘোলাটে জলেই বাড়ির মেয়েরা গৃহস্থালির কাজ সারছেন। বাসন ধুচ্ছেন। জামা-কাপড় কাচছেন। বাড়ির ছোট ছেলে মেয়েরা আবার সেই জলেই শৌচকর্ম সারছে। বাড়ির ছেলেরাই বা বাদ যান কেন? তাঁরাও সেই জলেই পোষা গরুটিকে স্নান করাচ্ছেন। এই দৃশ্য অধিকাংশ গ্রামাঞ্চলের। শহরাঞ্চলেও নিকাশি নালার জলে এখনও পর্যন্ত অনেকেই তাঁদের বাসনপত্র ধুয়ে নিয়ে যান। নিকাশি নালার কথা বাদ দিলে রয়েছে পুকুরের নোংরা জল। পুকুর সংস্কার করা হয় না দিনের পর দিন। এক জায়গায় আবদ্ধ জলে ক্রমাগত মিশছে পুকুরপাড়ের বর্জ্য পদার্থ, মানুষের মল মূত্র, গৃহপালিত গরুর মল মূত্র। পুকুরের সেই আবদ্ধ জলেই আবার হাত ধোওয়া থেকে গৃহস্থালির বাসন মাজা বা ঘষা বা ধোওয়ার কাজ করছেন গ্রামের অনেক মহিলাই। নদীর পাড়ের বাসিন্দারা তো বাড়ির কাছে নদীর জলেই তাঁদের প্রতিদিনের কাজ সারেন। এমন ছবি গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে। অথচ তথাকথিত এলাকা কাগজে কলমে ‘নির্মল’ ঘোষিত। কিন্তু নিত্যদিনের ছবি দেখলে মনে প্রশ্ন জাগে ‘নির্মল বাংলা’ বা ‘নির্মল ভারত’ নিয়ে মানুষ কতটা সচেতন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা , ইউনেসকো বছরের পর বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করে এখনও পর্যন্ত মানুষকে ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন করা যায়নি। মানুষদের এখনও বোঝানো যায়নি নালার জলে হাত ধোয়া, বাসন মাজা, গৃহস্থালির কাজ না করা, পুকুরের জল বা নদীর জল ব্যবহার না করা। স্বাস্থ্য দফতর এ বিষয়ে কতটা তাঁদের প্রকল্পকে কার্যকর করতে পেরেছে সেটা নিয়েও সন্দেহ জাগে। কেবলমাত্র বছরান্তে একবার হাত ধোওয়া উৎসব পালন করেই সচেতনতা বাড়ানো যায় না। কিংবা নির্মল বাংলা বা নির্মল বীরভূম গড়ার লক্ষ্যে দুর্গা পুজোর সময় শপথ গ্রহণ করে শ্রেষ্ঠ নির্মল মণ্ডপ বা শ্রেষ্ঠ পরিবেশ বান্ধব মণ্ডপের পুরস্কার মেলে তবে চিন্তা-ভাবনার বাস্তব রূপদান হয় না।
এই সব করে কি এখনও নালার জলে হাত ধোওয়া বন্ধ করা গিয়েছি। না পুকুরের ধারে শৌচকর্ম করা আটকানো গিয়েছে। নদী ও পুকুরের নোংরা জল ব্যবহারও বন্ধ করা যায়নি। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলে অনেকসময়ই নিয়মমাফিক টিউবওয়েল বসানো হয় না। আমরা জানি জনসাধারণের জন্য যে টিউবয়েলগুলি বসানো হয় সেগুলি আসলে খোঁড়া উচিত ভূগর্ভের অন্তত দ্বিতীয় স্তর পর্যন্ত কিম্বা আরও নীচ পর্যন্ত। কারণ ভূগর্ভের প্রথম স্তরের জল নিরাপদ নয়। দ্বিতীয় স্তরের গভীরতা মোটামুটি ২০০ ফুট। অথচ টিউবওয়েল বসানোর সময় পঞ্চায়েতগুলি অনেক সময় এই বিধি মেনে চলে না। অনেক ক্ষেত্রে আবার দেখা যায় ২০০ ফুট পাইপ দিয়ে একটির জায়গায় ২-৩ টি টিউবয়েল বসানো হয়। ফলে যা হবার তাই হয় গ্রীষ্মকালে এই সব টিউবওয়েল দিয়ে আর জল পড়ে না। তাই বাধ্য হয়েই মানুষ নালা বা পুকুরের জলে কাজ সারে।
জলবাহিত রোগ কী?
অপরিশুদ্ধ জল পান করার মাধ্যমে অথবা সেই জল রন্ধন ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করার ফলে যে ধরনের ব্যধি সংক্রামিত হয়ে থাকে তাকেই বলে জলবাহিত রোগ। এই ধরনের রোগ সাধারণত জলে বিচরণশীল রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুদের দ্বরা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দ্বারা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে জলবাহিত রোগে আক্রান্তদের মধ্যে শিশুদের আধিক্য বেশি। জলবাহিত রোগের মধ্যে অন্যতম হল কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েড প্রভৃতি।
আমাশয়
রোগের কারণ: বেসিলারি ও এমিবয়েড নামক দু রকমের জীবাণুর সংক্রমণেই আমাশয় হয়। আর এই রোগ হয় দূষিত জলের মাধ্যমে। আর মাছি, মল-মূত্র এর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগের সংক্রমণের জীবাণু মানুষের দেহে প্রবেশ করে আর তখনই আমের সঙ্গে রক্ত পড়তে থাকে।
মুক্তির উপায়: জল ফুটিয়ে ঠান্ডা করে পান করতে হবে।
আমাশয়ের মলের ওপর যেন মাছি না বসে।
রোগীকে বার্লি, সাবু, চিঁড়ে ইত্যাদি খেতে দিতে হবে।
রোগ ধরা পড়া মাত্র চিকিৎসা শুরু করা উচিৎ।
কলেরা
রোগের কারণ: জল বাহিত রোগের মধ্যযে সবচেয়ে মারাত্মক রোগ হল কলেরা। আগে গ্রামের পর গ্রাম এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখে পতিত হত। এর মূল কারণ হল অনেক জায়গাতেই যে পুকুরে স্নান করা হয়, কাপড় কাচা হয়, বাসন মাজা হয় সেই পুুুুকুরের জলই তারা পান করে।
মুক্তির উপায়: আশেপাশের পরিবেশ সব সময় জীবাণু মুক্ত ও পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করবেন। বাড়ির চারপাশে ডিডিটি ছড়িয়ে দিতে হবে।
যেহেতু এই রোগটি জলের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে তাই জল সব সময় ফুটিয়ে খেতে হবে।
কলেরার প্রকোপ দেখা দেওয়ার আগেই কলেরার টিকা নিতে হবে।
বাজারের খোলা খাবার না খাওয়া।
এই রোগের বাহক হল মাছি। মাছি বসা খাবার না খাওয়া।
কুয়োর জলে ও পুকুরের জলে পটাশ দিতে হবে।
টাইফয়েড
রোগের কারণ: এই রোগটিও জল বাহিত। সালমানেলা টাইফি নামক এক প্রকার জীবাণু সংক্রমণে এই রোগ হয়। মানুষের মল মূত্র কফের মধ্যে এই রোগের জীবাণু থাকে। মানুষ যখন তখন যেখানে সেখানে কফ থুতু ফেলে তা জলে গিয়ে পড়ে জল দূূূূষিত করে। এর ফলে এই রোগ হয়।
মুক্তির উপায়: রোগীকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঘরে রাখতে হবে এবং যে রোগীর সেবা করবে তাকেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।
ঘর যদি মশা মাছি মুক্ত রাখা যায় এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা যায় তবে রোগ ছড়াতে পারে না।
শাক সবজি ও ফল পটাশ মিশ্রিত জলে ধুয়ে খাওয়া উচিত।
জল ফুটিয়ে খাওয়া উচিত।
রোগীর মল মূত্র নোংরা কাপড় চোপড় সব পুড়িয়ে ফেলতে হবে বা মাটির নিচে পুঁতে দিতে হবে।
টাইফয়েড রোগের টীকা নিতে হবে।
চিকিৎসকদের মতে নালার জলে বা পুকুরের আবদ্ধ জল ব্যবহারে জলবাহিত রোগ যেমন হয় তেমনই চর্ম রোগও হয়। পাশাপাশি স্ত্রীরোগেরও প্রকোপ বাড়ে।
বিশিষ্ট স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ তথা পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার স্বাস্থ্য বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য অশোক চট্টোপাধ্যায় জানান, নোংরা জল ব্যবহার করার ফলে মহিলাদের ফ্যাংগাল, ব্যকট্রিয়াল, প্রোটোজুয়াল রোগ হয়। চর্ম রোগ বিশেষঞ্জ চঞ্চল দাস জানান, দূষিত জল ব্যবহারে চুলকানি, কন্টাক্ট ডার্মোটোক্সি, ফ্যাংগাল ইনফেকশন হয়।
স্বাস্থ্য আধিকারিকেরাও মানছেন জলবাহিত রোগের ক্ষেত্রে অনেকাংশই দায়ী নোংরা জলের ব্যবহার। এ বিষয়ে তাঁরাও পরিশ্রুত পানীয় জল ব্যবহারের জন্য একাধিকবার সচেতন করছেন।
জেলা প্রশাসনও মানুষকে বারবার সচেতন করছেন তবুও দেখা যাচ্ছে জেলাতে মুরারই থানার পাইকর গ্রাম বা মহম্মদবাজার থানার শোতশাল এর মতো গ্রামে এখনও নোংরা জল ব্যবহারে পেটের রোগের কারণে শিশু, কিশোর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস ত্যাগ করার ক্ষেত্রে এখনও আমাদের যথেষ্ট সচেতনতার অভাবই এই মৃত্যুর কারণ বলে স্বাস্থ্য আধিকারিকেরা মনে করেন। তাই শীতের শেষে গরমের শুরুতে বা আসন্ন বর্ষায় জলবাহিত রোগ নিয়ে এখন থেকেই জেলাবাসীকে সচেতন করার কথা ভাবছেন স্বাস্থ্য আধিকারিক তথা চিকিৎসকেরা। আগামী দিনে জলবাহিত রোগের প্রকোপ কমানোর লক্ষ্যে তাঁদের এই উদ্যোগ।