Immunity

কোভিডের প্রভাব কি মহিলাদের ক্ষেত্রে কম? কী বলছেন চিকিৎসকরা?

যে সব ভাইরাস প্রধানত শ্বাসযন্ত্রকে আক্রমণ করে, তাদের প্রভাবে ছেলেরা ঘায়েল হয় বেশি৷

Advertisement

সুজাতা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০২০ ১৪:২৫
Share:

কোভিডের প্রভাব মহিলাদের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কম। ছবি: পিটিআই

কোভিডে আক্রান্ত ও মৃতদের তালিকায় পুরুষের সংখ্যাধিক্য। 'জার্নাল অব আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন'-এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন হাসপাতালে যে ৫৭০০ জন কোভিড রোগী ভর্তি আছেন, তার মধ্যে ৬০ শতাংশেরও বেশি পুরুষ। এঁদের মধ্যে যে ৩৭৩ জনকে আইসিইউ-তে পাঠানো হয়েছে, তাতেও সংখ্যাধিক্য পুরুষের, মোট রোগীর প্রায় ৬৬.৫ শতাংশ। 'ওয়েস্টার্ন জার্নাল অব এমারজেন্সি মেডিসিন'-এ প্রকাশিত প্রবন্ধে গবেষকরা জানাচ্ছেন, উহানের হাসপাতালে যত কোভিড রোগী ভর্তি আছেন তার মধ্যে ৫১-৬৬.৭ শতাংশ হলেন পুরুষ আর ইটালিতে পুরুষ রোগীর সংখ্যা, মোট রোগীর ৫৮ শতাংশ। ৪৪৬০০ জন কোভিড রোগীকে নিয়ে এক সমীক্ষা হয় চিনে। দেখা যায়, এঁদের মধ্যে ২.৮ শতাংশ পুরুষ মারা গেছেন। আর মহিলা মৃত্যুর হার ১.৭ শতাংশ।

Advertisement

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামী জানিয়েছেন, "আমাদের দেশের পরিসংখ্যান দিতে না পারলেও এটা ঠিক যে, পুরুষদের রোগ বেশি হচ্ছে। জটিলতাও বেশি হচ্ছে। তবে শুধু কোভিড নয়, করোনা গ্রুপের যে কোনও ভাইরাসের ক্ষেত্রেই এ কথা সত্যি। "

ম্যান ফ্লু : আগের কথা

Advertisement

২০০৩ সালে সার্স ও ২০১২ সালে মার্সের সময়ও ঘটেছিল একই ঘটনা। বেশি মারা গিয়েছিলেন পুরুষরা। ২০১৬ সালের এক স্টাডি থেকে জানা যায়, মার্সে যত মহিলা মারা গেছেন, পুরুষ মারা গেছেন তার চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি। ফলে মার্সকে ডাকা হত ‘ম্যান ফ্লু’ নামে। তখনই জানা যায়, যে সব ভাইরাস প্রধানত শ্বাসযন্ত্রকে আক্রমণ করে, তাদের প্রভাবে ছেলেরা ঘায়েল হয় বেশি। এমনকি ঋতু পরিবর্তনের সময় যে সাধারণ ফ্লু হয়, তাতেও ভোগেন বেশি পুরুষেরা। অর্থাৎ এই সব ভাইরাসের বিরুদ্ধে পুরুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম।

কেন পুরুষের প্রতিরোধ কম

“কেউ বলছেন যৌন হরমোনের কথা, কেউ বলছেন ক্রোমোজোমের কথা, কেউ এনেছেন রিসেপটর অর্থাৎ মানব কোষে ঢুকতে যে বস্তুটির সাহায্য লাগে নভেল করোনা ভাইরাসের, তার প্রসঙ্গ। কেউ আবার তুলে ধরেছেন মহিলাদের সহজাত নিয়ম-নিষ্ঠার কথা। প্রত্যেকটির পক্ষেই প্রচুর সমীক্ষা হয়েছে।” জানালেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায়। আসুন একে একে সে সব নিয়ে আলোচনা করা যাক।

আরও পড়ুন: নাগাড়ে কাশি, স্বরে বদল ফুসফুস ক্যানসারের উপসর্গ হতে পারে​

শুধু কোভিড নয়, করোনা গ্রুপের যে কোনও ভাইরাসের ক্ষেত্রেই পুরুষদের জটিলতা বেশি, দাবি একাংশের।

যৌন হরমোন তত্ত্ব

সার্স ও মার্স নিয়ে গবেষণা করে ২০১৭ সালে 'ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল'-এ যে প্রবন্ধ ছাপা হয়, তাতে জানা যায়, এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে ছেলেদের প্রতিরোধ কম থাকার কারণ সম্ভবত যৌন হরমোন। বিভিন্ন বয়সি নারী ও পুরুষ ইঁদুরের শরীরে সার্স ভাইরাস প্রবেশ করিয়ে গবেষকরা দেখেন, ছেলে ইঁদুরগুলি আক্রান্ত হয়েছে বেশি সংখ্যায়। এবার মেয়ে ইঁদুরদের স্ত্রী যৌন হরমোন বা ইস্ট্রোজেনের উৎস ডিম্বাশয় কেটে ফেলা হয় বা এমন ওষুধ দেওয়া হয় যাতে ইস্ট্রোজেন বেরতে না পারে। এবার তাদের সার্স ভাইরাস ইনজেকশন দিয়ে দেখা গেল, যাদের ইস্ট্রোজেন আছে তাদের চেয়ে এরা বেশি সংখ্যায় মারা যাচ্ছে। এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে লস এঞ্জেলসের সেডার সিনাই মেডিকেল সেন্টার ও নিউ ইয়র্কের স্টোনি ব্রুক ইউনিভারসিটির রেনেসা স্কুল অব মেডিসিনের বিজ্ঞানীরা অল্প কিছু কোভিড রোগীর উপর স্ত্রী যৌন হরমোন প্রয়োগ করে আশাপ্রদ ফল পান।

ক্রোমোজোম তত্ত্ব

মেয়ো ক্লিনিকের গবেষক ভিনা তানেজা জানিয়েছেন, “নারী ও পুরুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার তারতম্যের মূলে এক্স ক্রোমোজোমের হাত থাকার সম্ভাবনা আছে। নারী শরীরের কোষে থাকে দু'টি এক্স ক্রোমোজোম ও পুরুষ শরীরে একটি এক্স একটি ওয়াই। এক্স ক্রোমোজোমের মধ্যে এমন কিছু জিন আছে, যারা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। যদিও দ্বিতীয় এক্স ক্রোমোজোম চুপচাপই থাকে, তবে তার মধ্যে যে সব সুরক্ষা জিন আছে, তাদের ১০ শতাংশ বেশ কার্যকর। তার ফলেই এই পার্থক্য হয়। কাজেই এ দিক থেকে দেখলে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রায় দ্বিগুণ মেয়েদের। তবে তার কতটা কোভিড ঠেকাতে ও তার জটিলতা কমাতে কাজে লাগে তা জানতে গেলে আরও গবেষণা দরকার।”

আরও পড়ুন: করোনা আবহে পালস অক্সিমিটার ঘরে রাখা জরুরি? কী মত চিকিৎসকদের​

কারণ কি রিসেপটর

নভেল করোনা ভাইরাস লুকিয়ে থাকতে পারে ছেলেদের টেস্টিসে! মেয়েদের ডিম্বাশয়ে যদিও তার চিহ্ন মাত্র থাকে না। কী কারণ তার? এসিই-২ নামের রিসেপটরে ভর করে কোষের গভীরে ঢোকে করোনা। যেখানে যেখানে এই রিসেপটরের প্রাচুর্য, সেখানেই তার রাজত্ব। পুরো শ্বাসযন্ত্র জুড়ে বসে আছে সে। আছে পরিপাকতন্ত্রে। আছে টেস্টিসেও। সে কারণেই মেয়েদের শরীর থেকে যেখানে গড়ে ৪ দিন লাগে ভাইরাসের বিদায় নিতে, ছেলেদের সময় লাগে ৬ দিন। তবে ভাইরাস টেস্টিসকে সংক্রামিত করে, না কি রিসার্ভার হিসেবে ব্যবহার করে তা জানতে এখনও আরও অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হবে।

চিনে ছেলেরাই বেশি ধূমপান করেন। পরে দেখা গেল, ধূমপান না করলেও ছেলেরা বেশি আক্রান্ত। ফাইল ছবি।

দোষী ধূমপান

“করোনা সংক্রমণ ও জটিলতার সঙ্গে ধূমপানের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, রিসেপটরের সূত্রেও। এই কারণে যখন চিনে ছেলেদের বেশি রোগ হচ্ছিল, ধূমপানকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। কারণ, চিনে ছেলেরাই বেশি ধূমপান করেন। কিন্তু পরে দেখা গেল, ধূমপান না করলেও ছেলেরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।” জানালেন সুবর্ণ গোস্বামী।

আরও পড়ুন: কখন প্রয়োজন ভেন্টিলেটর? কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার এটির?

শেষের আগে

মেয়েদের রোগ কম হওয়া বা কম জটিল হওয়ার মূলে কি এই ক'টা কারণই রয়েছে, নাকি আছে আর কিছু?

হ্যাঁ আছে । বিজ্ঞানীদের অভিমত, নিয়ম-কানুন মানার ব্যাপারে মেয়েদের যে সহজাত প্রবৃত্তি তাও এর একটা বড় কারণ। বিভিন্ন সমীক্ষায় জানা গেছে, যেদিনথেকে কোভিড ঠেকানোর নিয়মাবলি এসেছে জনসমক্ষে, মেয়েরা যতখানি নিষ্ঠার সঙ্গে তা পালন করছেন, ছেলেরা ততটা করছেন না। এই কারণেও মেয়েরা রোগে পড়ছেন কম। তবে এ নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন।

অতএব প্রত্যেকেই নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করুন। তাতে রোগ ঠেকানো সহজ হবে।

(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।

• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন