জটিল অস্ত্রোপচারে মুশকিল আসান এখন রোবোটিক সার্জারি

ধীরে ধীরে বাড়ছে রোবটের সাহায্য নিয়ে অস্ত্রোপচারের সুযোগ। শরীরের দুর্গম অংশে সহজে পৌঁছে গিয়ে মুশকিল আসান করতে জুড়ি নেই এই রোবটের। তাই বাড়ছে এর চাহিদাও। লিখছেন স্বাতী মল্লিকধীরে ধীরে বাড়ছে রোবটের সাহায্য নিয়ে অস্ত্রোপচারের সুযোগ। শরীরের দুর্গম অংশে সহজে পৌঁছে গিয়ে মুশকিল আসান করতে জুড়ি নেই এই রোবটের। তাই বাড়ছে এর চাহিদাও।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৯ ২২:০৯
Share:

যান্ত্রিক ওটি-তে ‘কনসোল’-এ রোবটের সাহায্যে অস্ত্রোপচার করছেন চিকিৎসক। চণ্ডীগড়ের পিজিআই হাসপাতালে।

আমদাবাদের হাসপাতালে চলছে রোগিণীর হৃদ্‌যন্ত্রের অস্ত্রোপচার। কিন্তু ওটি-তে নেই চিকিৎসক। তিনি বসে রয়েছেন হাসপাতাল থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে গাঁধীনগরে! সেখানে একটি বিশেষ কক্ষ থেকে মনিটরে দেখে সফল ভাবে এই অস্ত্রোপচার করে সম্প্রতি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন হৃদ্‌রোগ চিকিৎসক তেজস পটেল। আর অপারেশন থিয়েটারে দাঁড়িয়ে হাতেকলমে অস্ত্রোপচারটি ভালয় ভালয় উতরে দিয়েছে যে, সে আদতে একটি রোবট!

Advertisement

অস্ত্রোপচার করবে রোবট? এ পর্যন্ত পড়েই শিউরে উঠছেন যে সব পাঠক, তাঁদের আশ্বস্ত করছেন এ শহরের চিকিৎসকদের একাংশ। কারণ, অপারেশন থিয়েটারে রোগীর শরীরে বিশালাকার রোবট অস্ত্রোপচার করলেও পিছন থেকে (পড়ুন ‘কনসোল’ থেকে) তাকে চালনা করছেন অভিজ্ঞ চিকিৎসকই। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আধুনিক এই পদ্ধতি আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হচ্ছে দেশে-বিদেশে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের একাধিক হাসপাতালে তো বটেই, কলকাতার বুকে দু’টি বেসরকারি হাসপাতাল— অ্যাপোলো গ্লেনেগল্‌স হাসপাতাল এবং টাটা মেডিক্যাল সেন্টারে বর্তমানে রয়েছে এই রোবোটিক সার্জারির সুবিধা।

আর-পাঁচটা অস্ত্রোপচার থেকে কোথায় আলাদা এই রোবট? চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ল্যাপারোস্কোপির থেকে আরও এক কদম এগিয়ে এই রোবোটিক সার্জারি। এ ক্ষেত্রে অপারেশন থিয়েটারে রোগীর পাশে নয়, চিকিৎসক থাকেন পাশের ‘কনসোল’-এ। সেখানে বসে মনিটরে ত্রিমাত্রিক ছবি দেখতে পান তিনি। শরীরের যে অংশে অস্ত্রোপচার করা হবে, সেই অংশটি প্রায় ৮০ গুণ বাড়িয়ে তিনি মনিটরের পর্দায় দেখতে পান। আর সেখান থেকেই চালনা করেন রোবটকে।

Advertisement

অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রেও রয়েছে অভিনবত্ব। রোগীর শরীরে ছুরি-কাঁচি চালিয়ে নয়, ছোট ছোট গোটা পাঁচেক ছিদ্র করে রোবটের হাত (যা মাত্র ১ সেন্টিমিটার চওড়া) এবং ছোট ক্যামেরা ভিতরে ঢুকিয়ে দিলেই কেল্লা ফতে! ইউরোলজির চিকিৎসক অমিত ঘোষের ব্যাখ্যা, ‘‘রোবট হাতের কব্জি ৩৬০ ডিগ্রি ঘোরাতে পারে, যা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই শরীরের যে কোনও দুর্গম এবং ছোট জায়গায় পৌঁছে গিয়ে জটিল অস্ত্রোপচার অথবা নিখুঁত ভাবে সেলাই করা রোবটের পক্ষে অনেক সহজ।’’ সাধারণ অস্ত্রোপচারের তুলনায় রক্তপাতের পরিমাণও এ ক্ষেত্রে নগণ্য। ফলে বড়সড় অস্ত্রোপচারের পরের দিন রোগী হেঁটে-চলে বেড়াতে পারেন বলে দাবি চিকিৎসকদের।

ইতিহাস বলছে, ১৯৮৫ সালে নিউরোলজিক্যাল বায়োপসি করতে প্রথম রোবটের সাহায্য নেওয়া হয়। এর পরে ২০০০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্য ভিঞ্চি’ নামে একটি সংস্থা এই রোবট বাজারে আনার পরে চিকিৎসাশাস্ত্রে নতুন দিগন্ত খুলে যায়। ২০১০ সালে দিল্লির এইমসে ইউরোলজি অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে প্রথম এ দেশে ব্যবহার করা হয়েছিল এই পদ্ধতি। বর্তমানে অবশ্য এর ব্যাপ্তি বেড়েছে অনেকটাই। স্ত্রী-রোগ সংক্রান্ত যে কোনও অস্ত্রোপচারই হোক কিংবা মাথা-গলা, কিডনি-যকৃৎ-অগ্ন্যাশয়-থাইরয়েড-প্রস্টেট কিংবা জরায়ুতে অস্ত্রোপচার, এমনকি অঙ্গ প্রতিস্থাপন— সব ক্ষেত্রেই রোবটের সাহায্য নিচ্ছেন প্রশিক্ষিত চিকিৎসকেরা।

তবে এমন রোবট আনতে গুনতে হবে কয়েক কোটি টাকা। রয়েছে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ ও সময়াভাবও। তবু নয়-নয় করে বর্তমানে এ দেশে মোট ৬৬টি রোবট রয়েছে বিভিন্ন হাসপাতালে। দিল্লি, বেঙ্গালুরু, চণ্ডীগড়, গুরুগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে রোবটের সুবিধা পাচ্ছেন রোগীরা। খরচ কোথাও পাঁচ লক্ষ, কোথাও সাত লক্ষের কাছাকাছি। কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত ইউরোলজির চিকিৎসক অনুপ কুন্ডু বলছেন, ‘‘চণ্ডীগড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পিজিআই হাসপাতালে অতি কম খরচে রোবোটিক সার্জারির সুবিধা পান রোগীরা। সেখানে শুধু রোগীদের কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়। দিল্লি এইমসের ক্ষেত্রে এই অপেক্ষার সময়টা আরও অনেক বেশি।’’

তবে রোবটের দাম কমার আশায় রয়েছেন অনেক পোড় খাওয়া চিকিৎসক। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওই সংস্থাটির পেটেন্ট শেষ হয়ে আসছে। তার পরেই হু হু করে রোবটের দাম কমবে বলে আশা। অনুপবাবু বলছেন, ‘‘পেটেন্ট শেষ হলে ইউরোপের অনেক দেশই রোবট নিয়ে আসবে বাজারে। তখন দাম কমবে। সে ক্ষেত্রে হয়তো সরকারি হাসপাতালেও রোবট কেনা যাবে। উপকৃত হবেন মানুষ।’’

টাটা মেডিক্যাল সেন্টার সূত্রের খবর, ২০১৭ সালের জুলাইয়ে ‘দ্য ভিঞ্চি’ সংস্থার রোবট যন্ত্রটি কিনেছিলেন কর্তৃপক্ষ। সেন্টারের ডেপুটি ডিরেক্টর ভি আর রামানন বলছেন, ‘‘গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই যন্ত্রের সাহায্যে প্রায় ১৩০টি রোবোটিক সার্জারি হয়েছে। অন্য চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে রোবোটিক সার্জারির খরচে এখানে খুব বেশি তফাৎ হয় না।’’ অ্যাপোলো হাসপাতাল সূত্রের খবর, ২০১১ সালে প্রায় ১০ কোটি টাকা দিয়ে কেনা হয়েছিল রোবট। এখনও পর্যন্ত তা দিয়ে ৬০০টির মতো অস্ত্রোপচার হয়েছে। হাসপাতাল সূত্রের দাবি, এখানে রোবটের সাহায্যে অস্ত্রোপচারের খরচ সাধারণ অস্ত্রোপচারের দেড় গুণ। ইউরোলজি, পেলভিক সমস্যা, ক্যানসার, থাইরয়েড, জরায়ু বা কানে-গলায় অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে এই রোবোটিক সার্জারি করে থাকেন এখানকার চিকিৎসকেরা। দাতার শরীর থেকে কিডনি প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়েই রোবোটিক সার্জারির উপরেই ভরসা রাখেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ভবিষ্যতে হৃদ্‌যন্ত্রে অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রেও এই রোবট ব্যবহারের কথা ভাবছে অ্যাপোলো। দাম কমলে আরও রোবট কেনার কথা কর্তৃপক্ষ ভাবছেন বলেও হাসপাতাল সূত্রে খবর।

কিন্তু অপারেশন টেবিলে রোবটের সামনে যেতে কতটা আগ্রহী রোগীরা? চাইলেই কি এই রোবোটিক সার্জারি করাতে পারেন সাধারণ মানুষ? অনুপবাবু বলছেন, ‘‘মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। তাই রোবোটিক সার্জারি করানোর ক্ষমতা যে মানুষের নেই, এমনটা নয়। এমন রোগীকেও চিনি, যিনি চণ্ডীগড়ের সরকারি হাসপাতালে না গিয়ে দিল্লি থেকে বেশি টাকা খরচ করে রোবোটিক সার্জারি করিয়ে এসেছেন।’’ আর অ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে প্রস্টেট ক্যানসারে রোবোটিক সার্জারি করানো, বারাসতের ৬৮ বছরের অতীশ দে বলছেন, ‘‘তিন বছর আগে অপারেশন হয়েছিল। কোনও সমস্যা হয়নি। গত বছর তো হর কি দুন ট্রেক পর্যন্ত করে এলাম!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন