Meningitis

দেরি হলেই বাড়ে বিপদ

মেনিনজাইটিস-এ রোগ নির্ণয় বা চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হলে, রোগীর সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সম্ভাবনা কমে যেতে পারে

Advertisement

সৌরজিৎ দাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০২১ ০৭:১০
Share:

ফাইল চিত্র

আইরিশ কবি এবং নাট্যকার অস্কার ওয়াইল্ড এবং রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যু হয়েছিল মেনিনজাইটিস-এ। গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিসের লেখায়ও এই রোগের উল্লেখ রয়েছে। জেনে নেওয়া যাক, জটিল এই রোগটি সম্পর্কে।

Advertisement

মেনিনজাইটিস কী?

মানুষের ব্রেন বা মস্তিষ্কের উপরে ফাইবারের একটা স্বচ্ছ, পাতলা আস্তরণ থাকে। এর নাম মেনিনজেস। এটি ব্রেনকে সুরক্ষা দেওয়ার কাজ যেমন করে, তেমনই আবার এর পুষ্টিপ্রক্রিয়াতেও সাহায্য করে। এই মেনিনজেস-এ যদি কোনও কারণে সংক্রমণ বা প্রদাহ হয়, তখন তাকে বলা হয় মেনিনজাইটিস। মেনিনজেস-এর তিনটি আস্তরণ। সবচেয়ে ভিতরের আস্তরণটি (বা পায়া মেটার) মস্তিষ্কের পৃষ্ঠের সঙ্গে লেগে থাকে। মেনিনজাইটিসের কারণে অনেক সময়ে ব্রেনও প্রভাবিত হয়। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে ব্রেনের পৃষ্ঠে বা সেটা ফুলে ওঠে। ডাক্তারি ভাষায় যেহেতু ব্রেনকে ‘এনসেফালন’ বলা হয়, তাই মস্তিষ্কের ফুলে ওঠা বা সেখানে সংক্রমণ হলে সেই রোগের নাম দেওয়া হয়েছে এনসেফালাইটিস। আর মেনিনজাইটিস-এর কারণে এমন হলে তাকে মেনিনগো এনসেফালাইটিস-ও বলে। মেনিনজাইটিস বা এনসেফালাইটিস আলাদা ভাবে খুব কমই দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগীরা মেনিনগো এনসেফালাইটিস-এই ভুগে থাকেন। নিউরোলজিস্ট ডা. জয়ন্ত রায় রোগটি নিয়ে বিশদে আলোচনা করলেন।

Advertisement

এই রোগের লক্ষণ কী? কাদের হতে পারে?

ভাইরাস, টিউবারকিউলোসিস সহ ব্যাক্টিরিয়া, ফাঙ্গাস বা অন্যান্য জীবাণুর সংক্রমণ থেকেই মূলত হতে পারে মেনিনজাইটিস। কিছু বিরল ক্ষেত্রে কোনও সংক্রমণ ছাড়াও এই রোগ হতে পারে। যেমন, ক্যানসার থেকে বা কোনও রাসায়নিক থেকে। মেনিনজাইটিস একটি স্নায়ুঘটিত রোগ। এ ক্ষেত্রে যদি চিকিৎসা শুরু করতে দেরি করা হয়, তা হলে রোগীর সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সমস্যা হতে পারে। এক জন সাধারণ ব্যক্তি কী ভাবে বুঝবেন, তাঁর কোনও প্রিয়জনের মেনিনজাইটিস হয়েছে? মূলত পাঁচটি লক্ষণ দেখে— রোগীর জ্বর হবে, সঙ্গে প্রচণ্ড মাথাব্যথা, ঘন ঘন বমি করতে পারেন, খিঁচুনি ধরতে পারে মাঝেমধ্যেই এবং ধীরে ধীরে তিনি নিস্তেজ হয়ে পড়বেন। এগুলি ছাড়াও আরও দু’একটা লক্ষণ দেখা যায়— যেমন, ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া বা শরীরে র‌্যাশ। বেশ কিছু মেনিনজাইটিসের ক্ষেত্রে শরীরে র‌্যাশ বেরোতে দেখা যায়। মেনিনগোকক্কাল ব্যাক্টিরিয়ার কারণে সদ্যোজাত বা শিশুদের মেনিনজাইটিস হলে গায়ে র‌্যাশ বেরোয়। সঙ্গে থাকবে জ্বর ও বমি। বড় বা ছোটদের মধ্যে এই লক্ষণগুলি একসঙ্গে বা এদের কয়েকটি দেখা দিলেই রোগীকে তখনই চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত।

ডা. রায় বললেন, ‘‘নানা ভাবে এই রোগটি হতে পারে। এক, ইনহেলেশন রুট-এর মাধ্যমে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেনিনজাইটিসের ব্যাক্টিরিয়া বা ভাইরাস শরীরে ঢোকে নাক বা শ্বাসনালির মধ্য দিয়ে। তার পরে তারা সেখানে বাসা করে এবং শেষমেশ গোটা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। নাকের সঙ্গে যেহেতু ব্রেনের যোগ রয়েছে, তাই এই সংক্রমণ খুব তাড়াতাড়ি চলে যায় ব্রেনে। দুই, ধরা যাক কোনও ব্যক্তির কানে পুঁজ হয়েছে। তিনি সেটা ঠিকমতো চিকিৎসা করালেন না। এই পুঁজ থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে ব্রেনে চলে গেলে মেনিনজাইটিস হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বলা হয় কন্টিগুয়াস রুট-এর মাধ্যমে (অর্থাৎ ব্রেনের আশপাশের কোনও জায়গা থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া) রোগটি হয়েছে। তিন, ট্রমা থেকে হতে পারে। কারও দুর্ঘটনায় মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লাগল, ফ্র্যাকচার হল। ওই ফ্র্যাকচারের মধ্য দিয়ে ব্রেনে সংক্রমণ ছড়াল। অথবা কারও ব্রেন সার্জারির সময় ইনফেকশন হল মস্তিষ্কে (পোস্ট সার্জারি মেনিনজাইটিস)।’’ আর হতে পারে সেপ্টিসেমিয়া (শরীরের কোনও অঙ্গের সংক্রমণ রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ব্রেন-এ চলে গেল) থেকে। এ ক্ষেত্রে ব্লাড স্ট্রিম ইনফেকশন-এর মাধ্যমে রোগী আক্রান্ত হন মেনিনজাইটিসে।

ট্রেকিং করতে গিয়ে কিংবা নোংরা জলে সাঁতার কাটতে গিয়ে অনেক সময় অ্যামিবা, প্রোটোজ়োয়া বা ফাঙ্গাসের কারণেও মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হতে পারেন।

একেবারে ছোট্ট শিশু (সদ্য জন্মেছে) থেকে বয়স্ক ব্যক্তি— যে কোনও কারও হতে পারে এই রোগ। যদিও বড়দের আর ছোটদের এই রোগ হওয়ার ক্ষেত্রে কিছু পার্থক্য থাকে। কিছু ভাইরাস বা ব্যাক্টিরিয়া শিশুদের আক্রমণ করে, কিছু বড়দের।

রোগের চিকিৎসা

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেনিনজাইটিসে এমপেরিক ট্রিটমেন্ট করা হয়। ‘‘নির্দিষ্ট একটি প্রোটোকল অনুযায়ী এই ট্রিটমেন্ট সঙ্গে সঙ্গে শুরু করতে হয়। সব রিপোর্ট আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে রোগীর ক্ষতি হতে পারে। তাই চটজলদি চিকিৎসা দরকার,’’ বললেন ডা. রায়। শুধু মেনিনজাইটিসের ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য অনেক রোগের ক্ষেত্রেই এই এমপেরিক ট্রিটমেন্টই পরিচিত চিকিৎসাপদ্ধতি। চিকিৎসকেরা জানেন কোন বয়সে কোন ভাইরাস বা ব্যাক্টিরিয়া থেকে মেনিনজাইটিস হয়। সেই অনুযায়ী, অ্যান্টিবায়োটিকের সংশ্লিষ্ট ডোজ়ের ইনজেকশন দেওয়া হয় রোগীকে। এর পরে শুরু করা হয় পরীক্ষানিরীক্ষা। মেনিনজাইটিস নির্ণয় করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি পরীক্ষা হল এমআরআই অথবা সিটি স্ক্যান (যে কোনও একটা) এবং লাম্বার পাংচার। সঙ্গে আনুষঙ্গিক রক্ত পরীক্ষা থাকেই। দশ দিন থেকে দু’সপ্তাহ দিতে হয় ইনজেকশন। যদিও সব মেনিনজাইটিসের ক্ষেত্রে চোদ্দো দিনের চিকিৎসা না-ও চলতে পারে। যেমন, কারও যদি টিউবারকিউলার মেনিনজাইটিস হয়, তা হলে কিন্তু তার চিকিৎসা চলে দেড় থেকে দু’বছর।

এখন মেনিনজাইটিস নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বায়োফায়ার-এর মতো অত্যাধুনিক পরীক্ষা বেরিয়ে গিয়েছে, যা দিয়ে ঠিক কোন ব্যাক্টিরিয়া, ফাঙ্গাস বা ভাইরাসের কারণে মেনিনজাইটিস হয়েছে, তা নিখুঁত ভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে সেই মতো চিকিৎসাও করা যাচ্ছে। তা ছাড়া, এখন প্রচুর অ্যান্টিব্যাক্টিরিয়াল, অ্যান্টিফাঙ্গাল, অ্যান্টিভাইরাল ওষুধও বেরিয়ে গিয়েছে, যার ফলে রোগীদের সুস্থ করে তোলা সম্ভব হচ্ছে। তবে পুরোটাই নির্ভর করছে, কত তাড়াতাড়ি রোগ নির্ণয় করা হচ্ছে, তার উপরে। এই রোগে দেরি মানে, রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাওয়া।

পোস্ট ডিজিজ সিম্পটম থাকে?

মেনিনজাইটিসে যেহেতু ব্রেন সংক্রমিত হয়, তাই এর ফলে প্রভাবিত হয় মস্তিষ্ক থেকে বেরোনো বিভিন্ন স্নায়ু। ফলে দেখা দিতে পারে বিভিন্ন সমস্যা। যেমন, কারও হয়তো ব্রেন ড্যামেজ হল, কেউ স্মৃতিশক্তি হারালেন, কারও শরীরের এক দিক প্যারালিসিস হয়ে গেল, কেউ এক কানে আর শুনতে পেলেন না, কারও চোখের মণি প্রভাবিত হল ইত্যাদি। এই ধরনের সমস্যায় অনেক সময়ে ওষুধপত্র দিয়ে বা রিহ্যাবিলিটেশনের মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ করে তোলা হয়। মেনিনজাইটিস হলে অনেক সময়ে শিশুদের ব্রেনে জল জমতে দেখা যায়। এই জল আসলে সেরিব্রো স্পাইনাল ফ্লুয়িড (সিএসএফ), যা ব্রেনের কাজকর্মে সাহায্য করে। মেনিনজাইটিসে ব্রেন থেকে এই সিএসএফ প্রবাহ ঠিকমতো হয় না। তার ফলে তা মস্তিষ্কে জমতে শুরু করে। একে বলে হাইড্রোকেফালাস। বড়দের ক্ষেত্রে এই সমস্যা তুলনায় কম হয়। হাইড্রোকেফালাস হলে সেটা অস্ত্রোপচার করে ঠিক করতে হয়।

মেনিনজাইটিসে তিন ধরনের পরিণতি হতে পারে। এক, রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন। দুই, চিকিৎসা সত্ত্বেও রোগী মারা গেলেন। সাধারণত বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই আশঙ্কা বেশি থাকে। আর তিন, রোগ সেরে গেলেও রোগের মাত্রা খুব বেশি হওয়ার কারণে শারীরিক সমস্যা থেকে গেল। এটা অনেকটা রোধ করা যায়, যদি ঠিক সময়ে রোগ ধরা পড়ে এবং সেই মতো চিকিৎসা শুরু করা যায়।

কোভিড কালে এই রোগের চিকিৎসা কী ভাবে করা যাবে?

অতিমারির কারণে কিন্তু অন্য রোগ থেমে নেই। ফলে রোগ পুষে রেখে তাকে আরও সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে নিয়ে গেলে আখেরে রোগীরই ক্ষতি। চিকিৎসকেরা কিন্তু অন্যান্য রোগীদেরও চিকিৎসা করছেন। তাই মেনিনজাইটিসের মতো রোগের ন্যূনতম লক্ষণ দেখা দিলেই অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া
ভীষণ জরুরি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন