হাতে স্মার্টফোন, কানে ইয়ারফোন। সঙ্গে ইন্টারনেট। বাইরের পৃথিবী বন্দি একটি ‘টাচে’। অনবরত কানে বাজছে ভাল লাগার সুর।
সুরের এই পৃথিবীতে ডুবে থাকার নেশার আড়ালে কিন্তু লুকিয়ে রয়েছে বিপদ। শরীর ও মনের ছন্দ বেসুরো হয়ে যাওয়ার ভয়। হু-র (ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন) সমীক্ষা বলছে, গোটা বিশ্বের প্রায় ১১০ কোটি টিন এজার ও যুবক-যুবতী শ্রবণক্ষমতা হারানোর দোরগোড়ায়। সৌজন্যে, ব্যক্তিগত অডিও গ্যাজেটের লাগাম ছাড়া ব্যবহার।
কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শব্দ’ ছবিতে ফোলি-শিল্পী তারকের দেখা গিয়েছিল এক অদ্ভুত সমস্যা। স্টুডিওতে ব্যাকগ্রাউন্ড শব্দ তৈরির শৈল্পিক নেশায় ডুবে সে সাধারণ মানুষের কথায় মনঃসংযোগ করতে পারত না। তার কান শুধু শব্দ শুনত। হেডফোন ছাড়া মানুষের কণ্ঠস্বর তার মাথায় পৌঁছত না। আজকের প্রজন্মের অনেকের মধ্যেই স্রেফ লাইফস্টাইলের কারণেই এই জাতীয় সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা।
মাঝারি ও বেশি আয়ের দেশগুলি থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে হু-এর আশঙ্কা, ১২ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের ৫০ শতাংশ বিপদজনক শব্দসীমার মধ্যে আছে। কলকাতার ছবিও কিন্তু এই ভয়েরই আভাস দিচ্ছে। ‘‘দীর্ঘ সময় ধরে ইয়ারফোন লাগিয়ে রাখার জন্যই কলকাতায় ১২ থেকে ৩৫ বছর বয়সিদের কানের সমস্যা বাড়ছে। আর তা থেকে অন্যান্য শারীরিক সমস্যাও,’’ বললেন ইএনটি বিশেষজ্ঞ অরুণাভ সেনগুপ্ত। অ্যাকস্টিক নিউরোমা বা কানে টিউমারের সংখ্যা বাড়ছে কলকাতায়। অন্যান্য কারণের সঙ্গে ইয়ারফোন বা হেডফোনে খুব জোরে গান শোনা এর জন্য দায়ী বলে মনে করছেন চিকিত্সকেরা। নাইটক্লাবের একটানা নিচু ফ্রিকোয়েন্সিতে ‘বুম বুম’ আওয়াজ প্রতিনিয়ত শুনলেও সমস্যা হয়, বলছিলেন ইএনটি বিশেষজ্ঞ দীপঙ্কর দত্ত। ঝিঁ ঝিঁ পোকার মতো একটা গুনগুন শব্দ তখন কানে বাজতে থাকে। চিকিত্সার পরিভাষায় একে বলে ‘টিনিটাস।’ সম্প্রতি বলিউডের ছবি ‘সাউন্ডট্র্যাকে’ও এই সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়েছে।
কিন্তু আজকের প্রজন্মের মধ্যে শব্দের জগতে ডুবের থাকার এত প্রবণতা কেন? ‘‘ভাল লাগা থেকে শুরু হলেও গান শোনার অভ্যাসটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে নেশায়,’’ বলছিলেন মনোবিদ প্রশান্ত রায়। মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘আমরা পাবলিক স্পেসেও নিজের জন্য একটা কমফর্ট জোন খুঁজে নিতে চেষ্টা করি। চারপাশের মানুষজনের প্রতি যে উদাসীনতা এখন দেখা যায়, ইয়ারফোনে মগ্ন থাকা কিছুটা সেই প্রবণতারই লক্ষণ।’’ ট্রেনে-বাসে বই বা ম্যাগাজিন পড়ার মধ্যে মন ও মস্তিষ্কের যে সক্রিয় অংশগ্রহণ আছে, ইয়ারফোনে গান শোনার মধ্যে তা নেই। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রামের মতে, এর পিছনে আত্মকেন্দ্রিকতা তো আছেই। আবার শব্দদূষণের হাত থেকে বাঁচতেও অনেকে বেছে নিচ্ছেন এই পথ। একটা বড় অংশের কাছে আবার ব্যক্তিগত বা কর্মক্ষেত্রের ‘স্ট্রেস’ থেকে হাঁফ ছাড়ার উপায় হল এই ইয়ারফোন। কিন্তু আখেরে এতে মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তার সঙ্গে লড়াই করার জোরই হারিয়ে যেতে বসেছে বলে সতর্ক করছেন চিকিৎসকরা। এক অদ্ভুত উদাসীনতা ভুলিয়ে দিচ্ছে মানুষের সঙ্গে কথোপকথনের স্বাভাবিক অভ্যাস।
মার্কিন বিজ্ঞানী কার্ল ফ্রিসটার্প গবেষণায় দেখাচ্ছেন, এই প্রজন্মের ‘ইয়ারফোন অবসেশন’ থেকে দুটি সমস্যার জন্ম হতে পারে। ‘লার্নেড ডেফনেস’ বা অভ্যাসগত বধিরতা আর ‘জেনারেশনাল অ্যামনেশিয়া’ বা প্রজন্মগত স্মৃতিভ্রংশতা। কান কেবল এক ধরনের শব্দ শুনতে শুনতে হারিয়ে ফেলতে পারে তার সহজাত ক্ষমতা। এমনিতেই এই প্রজন্মের প্রকৃতির সঙ্গে দূরত্ব খুব বেশি। তাই নির্জন স্থানে গিয়েও পাখির ডাক, ঝর্নার শব্দ কানে হয়তো পৌঁছবে না। ইয়ারফোন সব সময় লাগিয়ে রাখার ফলে কান পেতে শব্দ শোনার ক্ষমতা হয়তো হারিয়ে ফেলবে তারা।
শুধু জেনারেশন ওয়াই-কে দোষ
দিয়েও লাভ নেই। টেক-স্যাভি প্রবীণ প্রজন্মও মেতেছেন এই নেশায়। বাসে-ট্রামে, মেট্রোয় ধরা পড়ে সেই ছবি। মোবাইল কানে চলতে গিয়ে দুর্ঘটনা আকছার ঘটছে। এই অবসেশনের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে তথ্য প্রযুক্তিরই সাহায্য নিতে বলছেন চিকিত্সকেরা। বিভিন্ন স্মার্টফোন অ্যাপের সাহায্যে নজর রাখা যেতে পারে শব্দ বিপদসীমা ছাড়িয়েছে কি না। ‘নয়েজ ক্যানসেলিং’ ইয়ারফোন ব্যবহার করাই অনেক বেশি নিরাপদ বলে মনে করেন ডাক্তাররা। এতে বাইরের শব্দকে হটানোর জন্য শব্দ বাড়ানোর সুযোগ থাকে না।