মিষ্টি খেলেই হয় না মধুমেহ

জ্বর হলে ভাত খেতে নেই। শুকনো রুটি খাও। মিষ্টি খেলে ডায়বেটিস হয়। তেল মেখে রোদে যাও। হাড় শক্ত হবে। স্বাস্থ্য সম্পর্কে কয়েকটি ভুল ধারণা রয়েছে আমাদের। আমরা অনেকেই বলি থাইরয়েড হয়েছে। যা ঠিক নয়। ভ্রান্ত চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসুন। সুস্থ জীবনযাপন করুন। জানালেন বোলপুর মহকুমা হাসপাতালের রেডিওলজিস্ট স্বাতী মুখোপাধ্যায়জ্বর হলে ভাত খেতে নেই। শুকনো রুটি খাও। মিষ্টি খেলে ডায়বেটিস হয়। তেল মেখে রোদে যাও। হাড় শক্ত হবে। স্বাস্থ্য সম্পর্কে কয়েকটি ভুল ধারণা রয়েছে আমাদের। আমরা অনেকেই বলি থাইরয়েড হয়েছে। যা ঠিক নয়। ভ্রান্ত চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসুন। সুস্থ জীবনযাপন করুন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:৩৫
Share:

পরীক্ষা: রোগী দেখছেন চিকিৎসক স্বাতী মুখোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র

মিষ্টি খেলে ডায়াবিটিস হয়। তাই বেশি মিষ্টি খেও না। ছোট বেলা থেকেই আমরা এ কথা শুনেছি। মিষ্টি বা চিনি খেলে ডায়াবিটিস হয় এমন ধারণা অনেকের মধ্যেই প্রচলিত রয়েছে। তাই অনেকেই ডায়াবিটিস হবে এই ভয়ে মিষ্টি খাওয়া থেকে বিরত থাকেন। তবে মিষ্টি খেলেই ডায়াবিটিস হবে বা সুগার বেড়ে যাবে এই ধারণা ভুল।

Advertisement

৯০ ভাগ মানুষ বিশ্বাস করেন যে মিষ্টি খেলে ডায়েবিটিস হয়। বর্তমানে অসংখ্য মানুষ ডায়াবিটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। এই রোগটি সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। ফলে ডায়াবিটিস থেকে মুক্ত থাকতে চান সবাই। কিন্তু শুধু মিষ্টি খেলে ডায়াবিটিস হবে এটা ভুল। এই রোগ থেকে দূরে থাকতে কিছু নিয়ম-নীতি মেনে চলতে হয়। সাথে নজর দিতে হয় খাবারেও।

আমি প্রথমে ডায়াবিটিস কি সেটা আলোচনা করলে বুঝতে সুবিধা হবে। শরীরে ইনসুলিন নামের হরমোনের ঘাটতি হলে, ইনসুলিনের কাজের ক্ষমতা কমে গেলে বা উভয়ের মিলিত প্রভাবে রক্তে যদি শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায় তখন তাকে ডায়াবিটিস বলে। আসলে চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার খেলেই ডায়াবিটিস হবে কথাটি সঠিক নয়। মূলত পরিবারে কারোর ডায়াবিটিস থাকলে, শরীরের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকলে, শারীরিক পরিশ্রম কম করলে, জীবনযাপনে শৃঙ্খলা মেনে না চললে ডায়াবিটিস হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই চিনি খেলেই ডায়াবিটিস হয় না তবে যদি ডায়াবিটিস হয়েই যায় তখন চিনি খাওয়া কমিয়ে দিতে হবে বা এড়িয়ে যেতে হবে।

Advertisement

আমরা ডায়াবিটিসকে মূলত দুই ভাবে ভাবি। কারণ এর মধ্যে আরও অনেক ভাগ আছে। দুই ধরনের ডায়েবেটিস মূলত একটা বাচ্চাদের এবং একটি বড়দের। বাচ্চাদের মূলত ইনসুলিন যে হরমোন যার জন্য সুগার আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। সেই ইনসুলিন হরমোনটা তৈরি হয় না। তাদের ক্ষেত্রটা সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের ক্ষেত্রটা আমি বাইরে রাখছি। কারণ তাদেরকে ছোট থেকেই ইনসুলিন নিতে হয়। তাদের ক্ষেত্রে মিষ্টি খাওয়া যাবেই না। বা খেলে কিভাবে খাবে সেটা পুরোপুরি আলাদা বিষয়। কারণ তারা ছোট থেকেই ডায়াবেটিক। মানে তাদের ডায়াবিটিস হয়ে গিয়েছে। আর বড়দের কি হচ্ছে, যখন বয়স হচ্ছে ডায়াবিটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। কার ডায়াবিটিস হবে, কার হবে না এরকম বলা যাবে না। কিন্তু আমরা মিষ্টি খেলেই সকলে বাধা দেন। কিন্তু বাঙালি মিষ্টি খাবে না। এটা হতে পারে না! এ বার বড়দের ডায়াবিটিসের ক্ষেত্রে কি হয়?

তাঁর কিন্তু ইনসুলিন ঠিকই বেরোচ্ছে। যেটা বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বের হচ্ছে না। যখন ব্যক্তির বয়স হচ্ছে বা তিনি মোটা হয়ে যাচ্ছেন, তখন তাঁর শরীরে ইনসুলিন ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না। ইনসুলিন হরমোন কতকগুলো রিসেপ্টর এর উপরে কাজ করে। যখন রিেপ্টরগুলোর উপর ফ্যাট জমে তখন সেগুলি কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। তাদের কতগুলো রিসেপ্টর আছে। বয়স হওয়ার জন্য মোটা হওয়ার জন্য বিশেষত মোটা হওয়ার জন্য এই ঘটনা ঘটে। রিসেপ্টরগুলো ফ্যাটের জন্য কাজ করে না। ফলে কি হয়? ইনসুলিন বের হচ্ছে কিন্তু রিসেপ্টর যেহেতু খারাপ তাই কাজ হচ্ছে না তখন সুগার লেবেলটা বেড়ে যায়।

আমি একটা মিষ্টি খেলাম। আমার ততটাই ইনসুলিন শরীর থেকে বেড়োবে। আমি এক কাপ ভাত খেলাম সেই পরিমাণ ইনসুলিন বাড় হল। কখনই সেটা অতিরিক্ত হবে না কখনই সেটা কম হবে না। সেটা একদম ঠিকঠিক পরিমাণে থাকবে। সেরকম ভাবেই আমাদের শরীরটা তৈরি হয়ে আছে। এবার মিষ্টি যদি আমি খেয়ে ফেলি তাহলে কি হল? অনেকটা গ্লুকোজ এক সঙ্গে খেলাম অনেকটা কার্বোহাইড্রেট খেলাম। তাতে কি হবে ব্লাড সুগারটা হট করে বাড়ল, ঠিক ততটাই কিন্তু আমার শরীর থেকে ইনসুলিন ক্ষরিত হয়ে এটাকে স্বাভাবিক করে দেবে।

সুতরাং মিষ্টি খেলাম বলেই আমার ডায়াবিটিস হলো সেটা এক্কেবারেই ভুল ধারণা। মিষ্টি খেলে ডায়াবিটিস হবে এটা কখনই ঠিক নয়।

মিষ্টি বা চিনি খেলে ডায়াবিটিস হয় না। তবে অতিরিক্ত যে কোনও খাবার খাওয়া যেমন ঠিক নয়, তেমনি বেশি মিষ্টি খাওয়াও ঠিক নয়। এতে মানুষের স্থূল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই একটানা অতিরিক্ত মিষ্টি না খেলেই ভালো। তবে যাঁরা নিয়মিত ব্যায়াম করেন, তাঁরা পরিমিত পরিমাণ মিষ্টি খেলে তেমন ক্ষতি হয় না। ডায়াবিটিসের জন্য শুধু সুগারই দায়ী নয়। পুরো জীবনধারণ প্রক্রিয়ার কারণে রোগটি হয়ে থাকে। অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিভিন্ন ধরনের খাবার গ্রহণের ফলে রক্তে গ্লুকোজের উপস্থিতি বেড়ে যায়। সেখান থেকেই ডায়াবিটিসের শুরু হয়। মিষ্টি খেলেই যে ডায়াবিটিস হবে, এমন নয়। তবে যারা খুব বেশি পরিমাণে মিষ্টি খায় এবং কোনও ধরনের পরিশ্রম করে না তাদের ডায়াবিটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি। আপনি যদি প্রতিদিন মিষ্টি খেয়ে সঠিক নিয়ম মেনে পরিশ্রম করেন তাহলে ওই মিষ্টি আপনার কোনও ক্ষতি করবে না। তবে আপনি অলস হলে মিষ্টি কম খাওয়া কিংবা না খাওয়াই ভালো।

আপনি দিনে যদি একটা মিষ্টি খান তাহলে ঠিক আছে। আপনি যদি বেশি মিষ্টি খান তাহলে শরীরে ওজন বেশি বাড়ে। আপনি রোজ পাঁচটা দশটা মিষ্টি খান তাহলে আপনি মোটা হতে থাকবেন। মোটা হওয়াটা কিন্তু ডায়াবিটিসের কারণ। যারা ধরুন রোগা ছিপছিপে লোক আর বয়সকালে যে ডায়াবিটিস হয়েছে খুব একটা শোনা যায় না। তাঁর প্যাংক্রিয়াসে কোনও অসুখ হতে পারে। কিন্তু সাধারণ যে ডায়াবিটিস সেটা খুব একটা হয় না।

সুতরাং মোটা হওয়াটা কিন্তু আটকাতে হবে। সেটার জন্য আমি এক্সারসাইজ করতে পারি। সেটার জন্য আমি ভাত খাওয়াটা কমাতে পারি। সেটার জন্য আমি খাদ্য তালিকায় নর্মাল কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করা কমাতে পারি। সেটার দায় কিন্তু শুধু মিষ্টির নয়। সুতরাং মিষ্টি খেলেই যে ডায়াবিটিস হয় এটা ভুল ধারণা। কিন্তু যাঁর ডায়াবিটিস হয়েছে তাঁর ক্ষেত্রে মিষ্টি খাওয়াটা বারণ। বারণ মানে কেন বারণ। সেটাও বুঝতে হবে।

দেখুন ভাত খেতে আমি বারণ করছি না শুধু বলছি মেপে খান। ভাত না খেলে সে তো বাঁচবেন না। কারণ কার্বোহাইড্রেট মানুষের দরকার। ভাত বা রুটি খেতেই হবে। ভাত, আটা, সিরিয়াল বা স্টার্চযুক্ত খাবার কোনোটাই বাদ দেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু কমিয়ে আনার প্রয়োজন হতে পারে। বিশেষ করে ভাত। এটি খুবই উচ্চমাত্রার কার্বহাইড্রেট। তবে অন্যান্য খাবারের সঙ্গে পরিমাণমতো খেলে পেটও ভরবে, চিনিও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সাধারণত এক কাপ পরিমাণ ভাতে ১৫ থেকে ২০ গ্রাম কার্বহাইড্রেট থাকে, যা প্রতি বেলা কার্বহাইড্রেটের মাত্রার চার ভাগের এক ভাগের মতো। তাই ভাত নিয়ে বেশি বাছ-বিচারের চেয়ে অন্য খাবার থেকে যেন শরীরে চিনি বা কার্বহাইড্রেট কম আসে সেটার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

আবার চালেরও কিছু প্রকার আছে। এমন কিছু চাল আছে যার ভাত পরিমাণে বেশি খেলেও রক্তে সহজে চিনির মাত্রা বাড়ে না। এ ধরনের চালকে বলা হয় লো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বা লো জিআই রাইস। সাদা চাল বা মেশিনে ভাঙানো চালে আঁশ থাকে না বলে এগুলো হাই গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বা হাই জিআই রাইস। এতে সহজেই রক্তে চিনির মাত্রা বাড়ে।

অন্যদিকে সাধারণ চাল কিন্তু ঢেঁকিছাঁটা বা যাতে আঁশ আছে তা সহজে চিনির মাত্রা বাড়ায় না। তাই যারা ভাত খেতে বেশি পছন্দ করে কিন্তু ডায়াবেটিসেও ভুগছে, তাদের উচিত লাল চাল বা ঢেঁকিছাঁটা চালের বা লো জিআই চালের ভাত খাওয়া। এতে স্বাভাবিকের চেয়ে পরিমাণে বেশি ভাত খেতে পারবেন। আবার লো জিআই চালের ভাত খেলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রাও অনেক কম থাকে। তাই ডায়াবেটিসের কারণে হার্টের অসুখ হওয়ার যে ঝুঁকি থাকে তা-ও কমে আসে।

আবার ভাতের সঙ্গে অন্য কিছু খাবার মিশিয়ে খেলে উপকার বেশি পাওয়া যায়। যেমন—শিমবীজ, ডাল, সবজি খিচুড়ি। কিন্তু মিষ্টি কেন বারণ। এক কাপ বা দু কাপ ভাতে যে কার্বোহাইড্রেটটা খেলাম সেই কার্বোহাইড্রেটটা একটা রসগোল্লা তে খেলাম। তাড়াতাড়ি সুগার লেবেলটা বেড়ে গেল। তাই ডায়াবিটিস হলে মিষ্টি খাওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন