Diwali 2023

দীপাবলি-দিওয়ালির বিরোধ নেই

এখানেই বাঙালির আধুনিকতা— সে ভূতচতুর্দশীর দুপুরে চোদ্দো শাক খায়, বিকেলে রঙ্গোলি দেয়, সন্ধ্যায় পূর্বপুরুষকে পিতৃলোকের পথ দেখাতে প্রদীপ জ্বালায় ও রঙিন টুনি বাল্ব ঝোলায়।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০২৩ ০৭:৪০
Share:

মডেল: স্বস্তিকা দত্ত। ছবি: দেবর্ষি সরকার।

নামে অনেক কিছু আসে যায়! আজকাল অনেক শিক্ষিত, শহুরে বাঙালিকেও মাঝে মাঝে বলতে শুনি, আমাদের বাঙালিদের দীপাবলি। আর, অবাঙালিদের দিওয়ালি। এই পণ্ডিতম্মন্যদের কে বোঝাবে, বাংলা সংস্কৃতিতে কোনও দিনই এই সব আমরা-ওরা ছিল না। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ ও রাজশেখর বসুর ‘চলন্তিকা’ দুই অভিধানে ‘দীপাবলি’ ও ‘দেওয়ালি’ দুটি শব্দই সগর্ব বিরাজমান। গত শতকে ‘পল্লীবৈচিত্র’ বইয়ের কালীপূজা নিবন্ধের শুরুতেই দীনেন্দ্রকুমার রায় লিখছেন, ‘উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে, এমন কি, ভারত-রাজধানী কলিকাতাতেও দেওয়ালী উপলক্ষে জনসাধারণের মধ্যে উদ্দীপনাময় তীব্র আনন্দের উচ্ছ্বাস অনুভূত হয়।’

Advertisement

স্বাধীনতার ঢের পরে ১৯৭০ সালে বার হয় প্রাচ্যতত্ত্ববিদ চিন্তাহরণ চক্রবর্তীর বই ‘হিন্দুর আচার-অনুষ্ঠান। সেখানে তাঁর বক্তব্য, ‘কার্তিক মাসের অমাবস্যায় দেওয়ালির দিন যে পূজা হয়, তাহাই সর্বাপেক্ষা বেশি প্রসিদ্ধ। ইহার নাম দীপান্বিতা কালীপূজা।’ আলোকমালা সজ্জিতা, বাজিতে সশব্দা এই অমাবস্যা রাতকে দীপাবলি, দিওয়ালি যা খুশি নামে ডাকতে পারেন, ক্ষতি নেই।

পার্থক্য শুধু আচারের ভিন্নতায়। কালীপুজোর আগের রাতটাই ভূত চতুর্দশী। সে দিন কলমি, হেলেঞ্চা, নটে, পালং, শুষনি, কচু, বেথো, ছোলা, মটর, সরষে, সজনে, পুঁই, কুমড়ো ইত্যাদি ১৪ রকম শাক খেতে হয়। বাংলা ছাড়া অন্যত্র খাল, বিল, পুকুরধারে এত গুল্মবালাই ছিল না, তাই উত্তর ভারতের দিওয়ালিতে চোদ্দো শাকের বিধানও নেই। আজকাল অবশ্য বাজারে, শপিং মলে এক আঁটিতে সাত-আট রকম শাক রেখে সেটিকে ‘১৪ শাক’ নামে চালানোই বাঙালির প্রথাবদ্ধ আধুনিকতা।

Advertisement

শাকান্ন ভক্ষণ ছাড়াও ভূত চতুর্দশীতে আরও কিছু করণীয় আছে। ‘পুরোহিত দর্পণ’ জানাচ্ছে, এ দিন নরকভয় থেকে মুক্তি পেতে স্নান করতে হয়। তার পর ‘যমের নাম উল্লেখ করিয়া তর্পণ করিবে ও দেবতাদিগকে পূজা করিয়া দীপ দান করিবে। দীপদানের মন্ত্রও আছে, ‘নমঃ পিতৃভ্যঃ প্রেতেভ্যো নমো ধর্ম্মায় বিষ্ণবে।’

মুশকিল একটাই। এই অন্ধকার রাত, ভূত-প্রেতের কথা থাকায় আধুনিক বাঙালি আজকাল ভূতচতুর্দশী আর হ্যালোউইনকে প্রায় একাকার করে দেন। হ্যালোউইনের সঙ্গে ধর্ম, নরকবাসের কোনও সম্পর্ক নেই। ব্রিটেন, জার্মানি, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ডে প্রাচীন যে কেল্টিক জাতি বাস করত, তাদের ‘সামহেইন’ নামে একটা উৎসব ছিল। কেল্টরা ভাবতেন, এই দুনিয়ায় সবই আলো বনাম অন্ধকার, ইতিবাচক বনাম নেতিবাচক, সৌভাগ্য বনাম দুর্ভাগ্যের খেলা। ফসল তোলার পরে শীতের শুরুতে সামহেইন উৎসবের দিনে তাই আধিভৌতিক দুনিয়া পৃথিবীতে নেমে আসে, তারা নানা মজা করে। দুষ্টু প্রেতাত্মারা পৃথিবীতে থেকে ফসল নষ্টও করে দেয়। পোপ গ্রেগরি ৫৯০ থেকে ৬০৪ খ্রিস্টাব্দ অবধি খ্রিস্টীয় দুনিয়ার প্রধান, তিনি খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের কেল্টদের কাছে পাঠালেন। কেল্টরা খ্রিস্টধর্ম স্বীকার করে নিল, কিন্তু খ্রিস্টধর্মেও তো অনেক সন্ত আছেন। তাঁরা দ্যুলোক-ভূলোক, স্বর্গ-মর্ত্যের সীমানা ভেঙে অক্লেশে দুই পৃথিবীতে যাতায়াত করেন। ভাল ভূত, খারাপ ভূত, সন্ত, শয়তান, কুমড়ো, আলো-আঁধারি, মজাদার দুষ্টুমি সব নিয়ে তাই সামহেইন পরিণত হল নতুন উৎসবে… হ্যালোউইন।

ভূতচতুর্দশী এতটা ‘সেকুলার’ নয়, আমি যাতে নরকস্থ না হই, সে জন্য যমরাজের পুজো। পুরোহিত দর্পণ জানাচ্ছে, ‘কার্তিকী অমাবস্যাকে দীপান্বিতা বলে। এ দিন প্রদোষ সময়ে লক্ষ্মীর পূজা করিবে এবং দেবগৃহে ভক্তিপূর্বক দীপদান করিবে।’ এই বঙ্গে কালীপুজোর সন্ধ্যায় তাই অনেক জায়গায় লক্ষ্মীপুজোও হয়। তার পর? গত শতকে দীনেন্দ্রকুমার রায়ের বর্ণনা: ‘প্রত্যেক বাড়ী দীপমালায় সজ্জিত। যাহাদের অট্টালিকা আছে, তাহারা বাহিরের বারান্দায়, কার্নিশের উপর সারি সারি প্রদীপ জ্বালিয়া দিয়াছে, ছেলেমেয়েরা চিলেকোঠার উপর উঠিয়া তাহার ধারে সারি সারি প্রদীপ বসাইতেছে।… যাহাদের খড়ের ঘর, তাহারাও বারান্দায় প্রদীপ সাজাইয়া দিয়াছে।’ আগের দিন, ভূত-চতুর্দশীর দুপুরে বাড়ির মেয়েরা শাকভাত খেয়ে ১৪টি প্রদীপ বানিয়ে রেখেছিল। এই প্রদীপ প্রজ্বলন করা ছাড়াও বাঙালির দীপান্বিতায় আছে উল্কাদানের প্রথা। ‘উল্কাদানে পিতৃলোকের পথপ্রদর্শন হয়, ওঁ শস্ত্রাশস্ত্রহস্তানাঞ্চ ভূতানাং ভূতদশয়োঃ’ মন্ত্রপাঠ করিবে। পথ মানে? পিতৃপুরুষরা পিতৃলোক থেকে দেবযান বেয়ে স্বর্গলোক, ব্রহ্মলোকে যান। এখানেই হ্যালোউইনের থেকে আমরা আলাদা।

কতটা আলাদা? বাঙালি দীপাবলিতে পূর্বপুরুষকে পথ দেখাতে প্রদীপ জ্বালায়, কিন্তু সেটিই একমাত্র ‘ভারতীয়ত্ব’ নয়। দশেরা বা দশমীতে রাবণবধ করে লঙ্কা থেকে ফিরে এ দিনই অযোধ্যার সিংহাসনে বসেছিলেন রামচন্দ্র। ১৪ বছর পর রাম-লক্ষ্মণ-সীতাকে দেখে সারা নগরী সে দিন আনন্দে উদ্বেল, প্রতিটি বাড়িতে প্রজ্বলিত ধূপ আর দীপ। তারই স্মরণে আলোময় দীপাবলি বা দিওয়ালি। আজকের রঙিন আলপনা বা রঙ্গোলি দীনেন্দ্রকুমার বা চিন্তাহরণবাবুদের লেখায় নেই, সেগুলি রামচন্দ্রের সিংহাসনে বসার আনন্দমুখরতায় সৃষ্ট। এখানেই বাঙালির আধুনিকতা। সে ভূতচতুর্দশীর দুপুরে চোদ্দো শাক খায়, বিকেলে রামচন্দ্রের জন্য রঙ্গোলি দেয়, সন্ধ্যায় পূর্বপুরুষকে পিতৃলোকের পথ দেখাতে প্রদীপ জ্বালায় ও রঙিন টুনি বাল্ব ঝোলায়।

সবচেয়ে বড় কথা লোক-ঐতিহ্যে। বাঙালি দীপাবলি আর দিওয়ালিকে একাকার করেছে ঠিকই, কিন্তু ভূত চতুর্দশী, কালীপুজো ও পরদিন বিসর্জন নিয়ে দীপাবলি টেনেটুনে তিন দিনের উৎসব। আর দিওয়ালি টানা পাঁচ দিন। প্রথমে ত্রয়োদশীর দিন ধনতেরাস। দিনটা আসলে ধনত্রয়োদশী। সমুদ্রমন্থনের পর এ দিন অমৃতকলস নিয়ে স্বয়ং ধন্বন্তরি উঠে আসেন। ওই যে হাতে ধরা কলস, সেখান থেকেই নতুন বাসনকোসন কেনার লোকবিশ্বাস। আর অমৃত মানেই অনন্য আয়ুসম্পদ! এ দিন তাই আয়ুর্বেদের দেবতা ধন্বন্তরির পাশাপাশি লক্ষ্মী, গণেশ ও কুবেরের উপাসনা বিধেয়, শুধু নতুন গয়না আর বাসনকোসন কিনলেই ধনতেরাস হয় না।

পরের দিন ভূত চতুর্দশীর মতোই নরক চতুর্দশী। নরক মানে নরকাসুর। দ্বারকার রাজা শ্রীকৃষ্ণকে নারদ এবং দেবরাজ ইন্দ্র এসে জানালেন, ওই দানবের অত্যাচারে তিষ্ঠোনো ভার। সে দেবতাদের সব ধনরত্ন আত্মসাৎ করেছে। হরিবংশে বৈশম্পায়ন জানান, ‘নরকের অর্থগৃহে মহানিধি ও রত্নসমূহের যদৃশ রাশি দৃষ্ট হইয়াছিল, তাহা আমরা পূর্বে কুবের, যম অথবা ইন্দ্রের ধনাগারেও দর্শন করি নাই।’ সেখানেই শেষ নয়, ১৬ হাজার নারীকে সে বন্দি রেখেছিল। শ্রীকৃষ্ণ তখন দ্বারকা থেকে গরুড়ের পিঠে রওনা দেন, নরকাসুর ও তাঁর সঙ্গীদের নিহত করে সব ধনরত্ন দ্বারকায় নিয়ে আসেন। বন্দিনী ওই ১৬ হাজার নারীর পাণিগ্রহণ করে তাদেরও দ্বারকায় নিয়ে আসেন। সেই উপলক্ষেই উৎসব। কালীপুজোর আগের রাতে বাংলায় ভূত চতুর্দশী, অন্যত্র নরক চতুর্দশী। এখানেই দীপাবলি
বনাম দিওয়ালির তিথিকল্পে অন্যতম তফাত। উত্তর ভারতে এ দিন অনেক জায়গাতেই আলোর মালা, তাই একে ‘ছোটে দিওয়ালি’ও বলে।

রামচন্দ্রের অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনের দিওয়ালিতে কালীপুজো নেই, পরদিন তাই বিসর্জনের প্রশ্নও নেই। সে দিন বরং গোবর্ধন পূজা। বৃন্দাবনের গোপরা আগে বৃষ্টির জন্য দেবরাজ ইন্দ্রের পুজো করতেন। বালক শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের বললেন, এর বদলে গরুকে পুজো করো। গোপালনেই আমরা আজ বিত্তশালী!

পুজো বন্ধ হওয়ায় দেবরাজ রেগে গেলেন। টানা সাত দিন তুমুল বৃষ্টি। গোপবালকও ছাড়ার পাত্র নয়, বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে আস্ত গোবর্ধন পর্বত তুলে ধরল। সমস্ত গোপ পরিবার তাদের গবাদি পশু নিয়ে তার নীচে ঢুকে পড়ল, পর্বত ছাতার মতো তাদের রক্ষা করল। বাংলায় এই সময় গো-পূজা হয় না, বরং পয়লা বৈশাখ ‘ভগবতী যাত্রা’ নামে একটি উৎসব ছিল। তখন গোয়ালঘরে ধূপধুনো দিতে হত। এখানেই দীপাবলি বনাম দিওয়ালি।

পরদিন যাবতীয় ‘আমরা-ওরা’ শেষ। সে দিন সকলেরই ভাইদুজ বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। উপকথা যার যার, উৎসব সবার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন