Nabin Bhaskar

সৃষ্টির আড়ালে কি বিস্মৃত স্রষ্টা? দক্ষিণেশ্বরের কালীমূর্তির নির্মাতা নবীন ভাস্করের পরিবার কেমন আছে?

রানি রাসমণির নির্দেশে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কালীমূর্তি তৈরি করেছিলেন শিল্পী নবীন ভাস্কর। পূর্ব বর্ধমান জেলার দাঁইহাটে শিল্পীর পরিবারের সদস্যেরা আজও পূর্বপুরুষের স্মৃতি আগলে রয়েছেন।

Advertisement

অভিনন্দন দত্ত

শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২৫ ০৭:৫৯
Share:

দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কালীমূর্তি নির্মাণ করেছিলেন প্রস্তরশিল্পী নবীন ভাস্কর। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

পূর্ব বর্ধমানের দাঁইহাট স্টেশন থেকে টোটোয় চেপে সরু রাস্তা ধরে মিনিট দশেকের পথ। গণপতি ক্লাবের পাশ দিয়ে ভাস্কর পাড়ার রাস্তা ধরে এগোলেই ডান দিকে গলি আরও সরু হতে শুরু করে। যে বাড়ির দরজায় গিয়ে সে পথ শেষ হল, সেখানেই থাকতেন নবীনচন্দ্র ভাস্কর। উনিশ শতকে বর্ধমান তথা বাংলার অন্যতম সেরা প্রস্তরশিল্পী, যিনি একাধিক কালীমূর্তি তৈরি করে খ্যাতিলাভ করেন। আর নবীনচন্দ্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শিল্প নিদর্শন— দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের মা ভবতারিণী।

Advertisement

কাটোয়ার অদূরে এই জনপদের বাসিন্দারা নবীনের কীর্তি সম্পর্কে অবগত। দাঁইহাটে এখনও ভাস্কর পরিবারের অল্প সংখ্যক সদস্য রয়ে গিয়েছেন। কেমন আছেন তাঁরা? বাংলা জুড়ে পরিবারের যাঁরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন, তাঁরা কি পরিবারিক ঐতিহ্য সম্পর্কে অবগত? সত্য অন্বেষণে উঠে এল নানা আঙ্গিক। কখনও সেখানে জনশ্রুতির ভিড়, আবার কখনও সেখানে ইতিহাসের পাতা থেকে ধুলো ঝাড়ার প্রয়োজন পড়ে। ফলাফল জানার আগে জেনে নেওয়া যাক, ভাস্কর বংশের উত্থান এবং নবীনের সাফল্যের আখ্যান।

১৮৩৫ সালে নবীনের জন্ম। শোনা যায়, বাবা রামধন ভাস্করের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন বিহার অথবা পঞ্জাব প্রদেশের মানুষ। দাঁইহাটে আসার পর তাঁরা পাথর থেকে গৃহস্থের ব্যবহৃত সরঞ্জাম তৈরি করে ফেরি করতেন। একসঙ্গেই শ্বেতপাথর এবং কষ্টিপাথর থেকে ঠাকুরের বিগ্রহ তৈরি শুরু করেন। যার মধ্যে কালী, শিবলিঙ্গ, রাধাকৃষ্ণ ছিল অন্যতম। অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলার রাজা-জমিদার মহলে এই পরিবারের নাম-যশ ছড়িয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, বর্ধমান রাজপরিবারের জন্য কৃষ্ণ মূর্তি তৈরির সুবাদে এই পরিবারের সভারাম ‘ভাস্কর’ উপাধি লাভ করেছিলেন।

Advertisement

দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণী ( বাঁ দিকে) এবং ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা মায়ের (ডান দিকে) মূর্তি তৈরি করেন নবীন ভাস্কর। — নিজস্ব চিত্র।

ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে ওঠার পর রামধন তৎকালীন কলকাতার আপার চিৎপুর রোডের কাছে ‘ওরিয়েন্টাল স্টোন ওয়ার্কস’ নামে একটি স্টুডিয়ো খোলেন। শোনা যায়, কষ্টিপাথরের জোগান বজায় রাখতে বর্ধমান রাজপরিবারের সহায়তায় জামালপুরে তিনি একটি পাহাড়ও কিনেছিলেন। বাবার সঙ্গে নবীনও কলকাতার স্টুডিয়োয় একের পর এক শিল্প নিদর্শন তৈরি করতে শুরু করেন। তবে রানি রাসমণির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের নেপথ্যে রয়েছে নানা জনশ্রুতি।

নবীন ভাস্কর প্রসঙ্গে মা সারদা বলেছিলেন, ‘‘ঠাকুরের মুখে শুনেছি, নবীন ভাস্কর সারা দিনে বেলা তিনটের সময়ে এক বার মাত্র হবিষ্যান্ন ভোজন করতেন। অত সংযত হয়ে, অত তপস্যা করে তবে দক্ষিণেশ্বরের মা কালীকে বানিয়েছেন। তাই তো অত জীবন্ত।’’ তবে দক্ষিণেশ্বরের মূর্তি গড়ার আগে নবীন কলকাতারই আরও কয়েকটি জনপ্রিয় মন্দিরের কালীমূর্তি নির্মাণ করেন। কারও মতে ৩টি, কারও মতে বা ৪টি মূর্তি তাঁর কীর্তির মধ্যে অন্যতম।

বরাহনগরের কুঠিঘাটের জয় মিত্র কালী মন্দিরের কৃপাময়ী মায়ের মূর্তিটি নবীন ভাস্করের তৈরি। ১৮৪৭ সালে তা প্রতিষ্ঠিত হয়। কথিত আছে যে, এই মূর্তিটি দেখে রাসমণির পছন্দ হয় বলেই তিনি নাকি নবীনকে দক্ষিণেশ্বরের মূর্তি তৈরির বরাত দিয়েছিলেন। এ ছাড়াও, ১৮৫০ সালে গোয়াবাগানে নিস্তারিণী মা এবং ১৮৫৩ সালে প্রামাণিক ঘাট রোডে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রহ্মময়ী মায়ের মূর্তি। কথিত আছে, এই মূর্তিগুলি নাকি প্রথমে দক্ষিণেশ্বরের জন্যই তৈরি করেছিলেন নবীন। কিন্তু কখনও বিগ্রহের উচ্চতা নিয়ে সমস্যা বা রাসমণির ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ— এই ধরনের নানা কারণে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। তিনটি মূর্তির জন্মবৃত্তান্ত ঘিরে নানা তত্ত্ব ও তথ্য সেখানে মিশে রয়েছে। অবশ্য, এই তর্কের অবতারণা এখানে অপ্রয়োজনীয়। ১৮৪৭ সালে দক্ষিণেশ্বর মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করেন রাসমণি। শেষ পর্যন্ত ১৮৫৫ সালে মে মাসের ৩১ তারিখ দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য, মা ভবতারিণীর আর এক নাম জগদীশ্বরী।

ভাড়াবাড়ির প্রবেশপথ (বাঁ দিকে)। নবীন ভাস্করের নাতনি পদ্মা ভাস্কর (ডান দিকে)। — নিজস্ব চিত্র।

দাঁইহাটে ভাস্কর পরিবারের সদস্যেরা এখন আর কেউ পাথর বা কাঁসা-পিতলের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত নন। তাঁদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠা পদ্মা ভাস্কর। সম্পর্কে তিনি নবীন ভাস্করের নাতনি। তবে দাদুর পৈতৃক ভিটেয় তিনি এখন থাকেন না। ২০১৬ সালে স্বামীর প্রয়াণের পর পদ্মা একই পাড়ায় একটি অন্য বাড়ির নীচের তলায় ভাড়া থাকেন। বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে তাঁর হদিস পাওয়া গেল। সেই বাড়ির অন্দরমহলে মলিনতার ছাপ স্পষ্ট। তবে আতিথেয়তায় কোনও খামতি নেই। চেয়ারে বসে ৮৫ বছরের বৃদ্ধা ধীরে ধীরে বলছিলেন, ‘‘স্মৃতি ক্রমশ দুর্বল হয়ে আসছে। এখন অনেক কিছুই আর মনে থাকে না।’’ নিজের বাড়ি ছেড়ে তিনি এখন কেন ভাড়াবাড়িতে রয়েছেন, সে প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি নন পদ্মা। বরং নবীন ভাস্কর এবং দক্ষিণেশ্বরের প্রসঙ্গ উঠতেই জোর গলায় বলে ওঠেন, ‘‘তিনি (দক্ষিণেশ্বরের কালী) তো আমাদের পরিবারেরই মেয়ে!’’

পদ্মা শুনেছেন, দক্ষিণেশ্বরের কালীমূর্তি নবীন দাঁইহাটে বসেই তৈরি করেছিলেন। তার পর তা কলকাতায় পাঠানো হয়। যদিও অন্য মত বলছে, মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য তৎকালীন সমাজে জাতপাতের দোহাই দিয়ে রাসমণির বিরোধিতা আগেই শুরু হয়। পাশাপাশি, নবীনকেও হুমকিও দেওয়া হয়। তাই শেষ পর্যন্ত রাসমণির নির্দেশে জানবাজারে রানির বাসভবনেই মূর্তিটি তৈরি করেছিলেন নবীন। অবশ্য পদ্মার যুক্তি, ‘‘ পার্সেল করে মূর্তি পাঠানো হয়েছিল বলে শুনেছি। আবার এ রকমও শুনেছি, মা নাকি রাসমণিকে স্বপ্নে বলেন, বাক্সের মধ্যে তাঁর খুব গরম লাগছে। তাই অবিলম্বে মন্দিরে তাঁকে স্থাপন করার নির্দেশ দেন।’’

(বাঁ দিকে) দাঁইহাটে নবীন ভাস্করের আবক্ষ মূর্তি। নবীন ভাস্করের বাড়িতে পূরবী ভাস্কর (ডান দিকে)। — নিজস্ব চিত্র।

নবীন ভাস্করের প্রামাণ্য দু’টি ছবি এখনও বাড়ির দোতলার ঘরে আগলে রেখেছেন তাঁর নাতবৌ পূরবী ভাস্কর। বাইরের ঘরের দেওয়ালে নবীনের একটি রঙিন তৈলচিত্র। ভিতরে শোয়ার ঘরে খাটের পাশে বাঁধানো পূর্ণ অবয়বের ছবিটি সাদা-কালো। পূরবীর দাবি, এই ঘরেই নাকি থাকতেন নবীন ভাস্কর। বাড়ির পিছনের দিকে দুর্গা দালানের সংস্কার হয়েছে। সেখানে প্রতি বছর দুর্গাপুজোও হয়। দুর্গা দালানের পুরনো ছবিও নিজের ঘরে সযত্নে রেখেছেন পূরবী। বর্তমানে বাড়ির একটা বড় অংশ বিভিন্ন শরিকের মধ্যে বিভক্ত। অন্য একটি অংশ বিক্রি হয়ে গিয়েছে। এক সময়ে রামধনের পাথরের কারখানারও বর্তমানে কোনও অস্তিত্ব নেই। পূরবী বলছিলেন, ‘‘বাড়ির যেটুকু সংস্কার আমার স্বামী (নিমাই ভাস্কর) করেছিলেন, তা-ই আগলে রয়েছি। এর পর কী হবে জানি না।’’ তিন বছর আগে স্বামীকে হারিয়েছেন পূরবী। তিন মেয়ে বিবাহিত। বর্তমান প্রজন্ম পারিবারিক ঐতিহ্য সম্পর্কে অবগত হলেও তা সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে কেউ উদ্যোগী নন বলেই জানালেন পূরবী। তাঁর কথায়, ‘‘এখন তো সকলেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন। চাকরি বা ব্যবসা করছে। আর ওঁর (নবীন ভাস্কর) হাতের যে কয়েকটি কাজও বা ছিল, সব হারিয়ে গিয়েছে।’’

নবীন ভাস্করের জীবনী নিয়ে নানা ধরনের জনশ্রুতি রয়েছে। প্রামাণ্য নথি নেই বললেই চলে। অবশ্য শহরবাসী যে নবীনকে ভুলে যাননি, তার প্রমাণ ভাস্কর পাড়ায় প্রবেশের মুখে ২০১৯ সালে স্থাপিত নবীন ভাস্করের আবক্ষ মূর্তি। গত দু’দশক ধরে তথ্য সংগ্রহ করে নবীনের জীবনী লিখেছেন দাঁইহাটের বাসিন্দা অশেষ কয়াল। তিনি বলছিলেন, ‘‘ছোট থেকেই দেখেছি, নবীন ভাস্কর বিস্মৃতির আড়ালেই রয়ে গিয়েছেন। হয়তো দাঁইহাটের একটি প্রজন্ম তাঁকে চেনে। কিন্তু সারা বাংলা চেনে কি?’’

তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের মতামতের সম্মুখীন হয়েছেন অশেষ। নবীন প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা মা, বাংলার একাধিক রাজপরিবারের কুলবিগ্রহ, মন্দির থেকে শুরু করে বাংলাদেশ এবং কাশীতেও ওঁর তৈরি মূর্তি রয়েছে।’’ তাঁর মতে, নবীনের কাজের ব্যাপ্তি এতটা বেশি বলেই সময়ের সঙ্গে সেখানে নানা বৈপরিত্যময় মতামত এবং জনশ্রুতি মিশে গিয়েছে। পরিবারের তরফে নবীনের উত্তরাধিকারকে এক অর্থে সংরক্ষণ করা হয়নি বলে বহু প্রামাণ্য নথি হারিয়ে গিয়েছে, অনুমান অশেষের।

ভাস্কর পরিবারের দুর্গা দালান (উপরে)। নবীন ভাস্করের বাড়ির পিছনের অংশ। — নিজস্ব চিত্র।

কর্মজীবনে প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করতেন পদ্মা। শ্বশুরবাড়ি কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে। কিন্তু চাকরিসূত্রে আজীবন দাঁইহাটেই রয়ে গিয়েছেন তিনি। এখন তাঁর সময় কাটে কী ভাবে? মুচকি হেসে উত্তর আসে, ‘‘পরনিন্দা- পরচর্চা এবং টিভিতে সিরিয়াল দেখে। আবার পুরনো দিনের বাংলা গানও শুনি।’’ দক্ষিণেশ্বরে শেষ কবে পুজো দিতে গিয়েছিলেন, তা এখন আর মনে করতে পারেন না পদ্মা। তাঁর আক্ষেপ, মন্দিরের ট্রাস্টি বোর্ড তাঁদের পরিবারকে মনে রাখেনি। বিভিন্ন সময়ে পরিবারের তরফে সাহায্য চেয়েও কোনও ফল হয়নি বলেই অভিযোগ করেন তিনি।

এই অভিযোগ অবশ্য মানছেন না দক্ষিণেশ্বর মন্দির কর্তৃপক্ষ। তাঁদের তরফে দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের ট্রাস্টি এবং লোকমাতা রানি রাসমণি ফাউন্ডেশন-এর প্রতিষ্ঠাতা ও আহ্বায়ক কুশল চৌধুরী বলেন, ‘‘এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।’’ তবে নবীন ভাস্করের পরিবারের সঙ্গে যে সে ভাবে এখন আর যোগাযোগ নেই মন্দিরের, সে কথা জানান তিনিও।

পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ অন্য কথা, আর সৃষ্টির সঙ্গে স্রষ্টার যোগ আলাদা। দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠার পর কেটে গিয়েছে ১৭০ বছর। ১৯০৮ সালে প্রয়াত হয়েছেন নবীন ভাস্করও। প্রতি বারের মতো এ বছরও তাঁরই তৈরি মূর্তির পুজো হবে মন্দিরে। দাঁইহাটের ভাস্করপাড়ার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরের যোগসূত্র স্বয়ং ভবতারিণী। ফলে এ বন্ধন ছিন্ন হওয়ার নয়।

তথ্য ঋণ: কালী কথা/ তমোঘ্ন নস্কর, সোমনাথ মুখোপাধ্যায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement