মুম্বইয়ের তারকাবাড়ির দুর্গোৎসবের অন্দরমহল। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
৭৯-তে পা দিল মুম্বইয়ের অন্যতম বড় দুর্গোৎসব। ‘নর্থ বম্বে সার্বজনীন দুর্গাপুজো’। আরবসাগরের তীরে বাঙালিয়ানার চেনা আসর। মুখোপাধ্যায় বাড়ির পুজো বলে কথা! কাজল, রানি মুখোপাধ্যায়, অয়ন মুখোপাধ্যায়ের মতো তারকাদের পরিবারের আবেগ, স্মৃতি মিলেমিশে একাকার। বলিউডের তারকারা ছাড়াও বিশাল এই পুজোর দায়িত্বভার রয়েছে যাঁদের উপরে, তাঁদেরই এক জন সম্রাট মুখোপাধ্যায়। আনন্দবাজার ডট কম-এর সঙ্গে আড্ডায় পুজোর গল্প শোনালেন কাজল, অয়ন, রানির তুতো ভাই সম্রাট।
প্রশ্ন: মুম্বইয়ের দুর্গাপুজো মানেই মুখোপাধ্যায় বাড়ির উৎসব। কিন্তু সেই ঘরোয়া পুজো এখন কেবল আর বাঙালিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—
সম্রাট: আমাদের ঠাকুরদা শশধর মুখোপাধ্যায় এবং ঠাকুরমা সতীরানি মুখোপাধ্যায় ‘নর্থ বম্বে সার্বজনীন চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’-এর এই পুজো প্রথম বার শুরু করেন। সেই পুজো এখন মরাঠি, গুজরাতি, পঞ্জাবি, সকলের। এ উৎসব কেবল আর হিন্দুদের নয়, শিখ-মুসলিমেরাও সমান ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। আসলে আমাদের পরিবারের এই পুজোর যখন জন্ম হয়, তখনও বলিউডের সমস্ত তারকাকে নিয়েই শুরু হয়েছিল, এখনও তারকারা নিজের পুজো মনে করেই অংশগ্রহণ করেন। আগে পরিচালনা, অভিনয়, সঙ্গীত, কলাকুশলীদের মধ্যে বাঙালির সংখ্যাই বেশি ছিল মুম্বইয়ে। তাঁরা অংশগ্রহণ করতেন। এখনও অমিতাভ বচ্চন, জয়া বচ্চন থেকে শুরু করে রণবীর কপূর, আলিয়া ভট্ট, সবাই এখানে এসে সদস্য হিসেবেই পুজোর কাজে হাত লাগান। তিন-চার প্রজন্ম ধরে এই পুজোর সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে বলিউডের অনেক তারকার। এ যেন পরিবারের ঐতিহ্যবাহী প্রথা গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রশ্ন: সেই তারকাদের দেখার জন্য তো প্রবল ভিড় হয়, আপনারা সামলান কী ভাবে? আপনার তুতো বোনেরা কাজল ও রানি কখনও বিরক্ত হন না?
সম্রাট: একেবারেই বিরক্ত হয় না ওরা। যে কারণেই আসুন, মানুষ দেবীর আশীর্বাদ নিতে আমাদের মণ্ডপে পা রাখছেন, এর থেকে বেশি আনন্দের আর কী-ই বা হতে পারে! বলিউডের তারকারা ছাড়াও অম্বানী পরিবারের সদস্যেরাও আমাদের দেবীদর্শনে আসেন। সবাই আনন্দ করেন, ভোগ খান। এককথায় বললে, এটি একটি ঘরোয়া পুজো। তবে হ্যাঁ, যেহেতু মুম্বইয়ে সবচেয়ে বড় দুর্গাপুজোগুলির মধ্যে এটি একটি, তাই ভিড় সত্যিই হয়। পুজোর চার দিন তো ভোর ৪টে-৫টা পর্যন্ত লোক থাকে। প্রতি বছর প্রায় ২ লক্ষ মানুষের পা পড়ে এই প্যান্ডেলে!
‘নর্থ বম্বে সার্বজনীন দুর্গাপুজো’র তারকারা। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: ২ লক্ষ!
সম্রাট: হ্যাঁ ২ লক্ষ, কখনও বা তারও বেশি। তাই কখনও সখনও পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ভোরের দিকে দরজা বন্ধ করে দিতে হয়। আমাদের খেয়াল রাখতে হয়, যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে কোনও। আসলে আমাদের মণ্ডপে ভোগের বন্দোবস্তও যে এলাহি হয়! তাই ভিড় তো হবেই।
প্রশ্ন: ভোগ কি একেবারে বাঙালিয়ানায় ভরপুর?
সম্রাট: হ্যাঁ, সব খাবার বাঙালি রেসিপি মেনেই রান্না হয়। ভোগ রান্নার জন্য মস্ত বড় দলকে নিযুক্ত করা হয়। প্রতি দিন এত মানুষকে খাওয়াতে হবে তো! আমাদের মণ্ডপে যিনিই আসুন না কেন, খালি পেটে কাউকে পাঠাই না। ভোগ শেষ হয়ে আসতে পারে মনে হলে ফের রান্না চাপানো হয়। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীতেই ভোগ খাওয়ানো হয়। সে যে কত কী রান্না হয়, বলে শেষ করা যাবে না।
মুম্বইয়ের তারকাখচিত দুর্গাপুজো। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: এলাহি ভোগের বিবরণ শুনে মনে হচ্ছে, বেশ লোভনীয়! দু’চার টুকরো যদি বলা যায়—
সম্রাট: খিচু়ড়ি, অন্তত দু’টি করে সব্জি, ডাল, পোলাও, বেগুনি, প্রচুর ভাজা, চাটনি, পায়েস, ল্যাংচা, মিষ্টি দইয়ের মতো পদ দিয়ে মিষ্টিমুখ হয়— মোদ্দা কথা, বাঙালিয়ানায় কোনও খামতি রাখা হয় না।
প্রশ্ন: ভোগ খাওয়ার ছবি তো দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রিয় তারকাকে হাত দিয়ে খাবার খেতে, বসে বসে আড্ডা দিতে দেখতে ভালবাসেন সকলে।
সম্রাট: নিশ্চয়ই। তা ছাড়া বেশির ভাগ সময়েই বলিউডের খ্যাতনামীরা পরিবেশন করেন নিজে হাতে। তা-ও আবার নিজেরা খাওয়ার আগে। আমি, কাজল, রানি, অয়ন, এরা তো সবাই বাড়ির লোক, তাই আমরা একেবারে শেষে ভোগ খেতে বসি।
প্রশ্ন: আপনারা খাওয়ার আগে খাবার শেষ হয়ে যায়নি কোনও দিন?
সম্রাট: কী ভাবে জানি না, এমন পরিস্থিতি কখনও তৈরি হয়নি। তবে অত ক্ষণ ধরে খাটাখাটনির পর আমাদের আর এমনিতেও খিদে থাকে না। তার পর যা পাব, তা-ই তো মায়ের ভোগ। অতিথিরা খেয়ে বেরোন কি না, সে দিকেই নজর দেওয়ার জন্য ব্যস্ত থাকে গোটা পরিবার।
বাঙালিয়ানার চেনা আসর। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: মুম্বইয়ে তো মুখোপাধ্যায় বাড়ি ছাড়াও আরও বাঙালি তারকার দুর্গাপুজো হয়। যেমন বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়, অভিজিৎ ভট্টাচার্য— নিজেদের মধ্যে আদানপ্রদান রয়েছে আপনাদের?
সম্রাট: অবশ্যই। আমাদের কাছে সাহায্য চাইলে আমরা দু’হাত বাড়িয়ে দিই সর্বদা। ৭৯ বছর ধরে আমাদের পুজো হচ্ছে বলে অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছে অনেকটা। তাই আমরা সব সময়ে আছি সকলের পাশে। তা সে আয়োজনের জন্য হোক বা পরামর্শের জন্য। তা ছাড়া, বিশ্বজিৎদা তো সম্পর্কে আমার মামা হন। সকলের পুজোই আমাদের বৃহত্তর পরিবারের অংশ। আমরা সকলে একে অপরের পরিচিত। আর যত দুর্গাপুজো হবে, ততই আমাদের মধ্যে যৌথতার বোধ তৈরি হবে। দেখুন, কলকাতায় পাড়ার পুজোয় সবাই একে অপরকে সাহায্য করতে পারে যত সহজে, মুম্বইয়ে সেটা অত সহজ নয়। তাই আমাদের তো একে অপরকে প্রয়োজন পড়বেই।
প্রশ্ন: কিন্তু এ বছর আপনাদের পরিবারে স্বজন বিয়োগ ঘটে গিয়েছে। পুজোর জৌলুস কি তবে খানিক ম্লান হয়ে যাবে এ বার?
সম্রাট: এ বছর মাত্র দু’মাসের মধ্যে আমার বাবা রণ মুখোপাধ্যায় এবং অয়নের বাবা দেব মুখোপাধ্যায় চলে গিয়েছেন। বাবা ছিলেন সভাপতি আর কাকা ছিলেন সচিব। ফলে আমাদের জন্য এই বছরটা খুব কঠিন। পরিবারে এ বার অশৌচ পালন করা হচ্ছে। কিন্তু দেবীর পুজোয় কোনও খামতি আমরা রাখব না। কেবল পরিবারের লোকজন অঞ্জলি দেব না, পুজোয় অংশ নেব না। কিন্তু আয়োজনে সবাই আছি। যাঁরা আজ নেই, তাঁদের কথা মনে রেখেই আমরা সমস্ত কিছুর বন্দোবস্ত করব।
মুখোপাধ্যায় পরিবারের উৎসব এখন সকলের। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: যেন এক অধ্যায়ের ইতি।
সম্রাট: হ্যাঁ। এ বার আমাদের আরও বেশি দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ তাঁদের হাত আর আমাদের কাঁধে নেই। কিন্তু এটাই আমাদের মুখোপাধ্যায় বাড়ির পুজোর ঐতিহ্য। প্রতি প্রজন্ম তার পরের প্রজন্মকে অনেক দিন ধরেই প্রস্তুত করতে থাকে।
প্রশ্ন: তবে কি এ বার কাজল-রানির সন্তানেরা যুগ, নায়সা, আদিরার প্রশিক্ষণ শুরু হবে?
সম্রাট: দেখুন, বাংলায় বড় হওয়া খুদেদের চোখের সামনে একটি নয়, শয়ে শয়ে পুজোর উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু আমাদের বাড়ির ছোটদের কাছে এমন ব্যাপক আয়োজনে পুজো কেবল একটিই। তাই ওদের কাছে এটা শিক্ষণীয় যে, একটা ঘরোয়া পুজো কী ভাবে, কত পরিশ্রম করে এই পর্যায়ে নিয়ে আসা যায়। ওরা শিখছে, এখানে কোনও শর্টকাট হয় না। প্রত্যেক সদস্য সমস্ত নিয়ম মেনে পুজোর আয়োজন করি। ৬-৮ মাস আগে থেকে পুজোর আয়োজন শুরু করি। আমাদের পরের প্রজন্ম সে ভাবেই শিখবে বলে আশা রয়েছে আমাদের। ওরা এগিয়ে নিয়ে যাবে এই পুজোকে।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম এগিয়ে নিয়ে চলেছে এই দুর্গাপুজোকে। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: আপনারা যখন তাদের বয়সি ছিলেন, সে সময়ে পুজোর আয়োজনে দায়িত্ব দেওয়া হত, না কি ছোটরা খেলাধুলোতেই বেশি ব্যস্ত থাকত?
সম্রাট: আমরা তো খুব উত্তেজিত থাকতাম ওই ক’টা দিন। রানি, আমি, কাজল, তনিশা, অয়ন সবার জন্যই এই সময়টা ছিল পরিবারের গেট-টুগেদারের মতো। আমরা এই পুজোর আকার বাড়তে দেখেছি বছর বছর। কিন্তু খেলাধুলোর মাঝেও দায়িত্ব নেওয়ার শখ ছিল ষোলআনা। কিন্তু বড়দের কাছ থেকে খানিক ছিনিয়ে নিতে হত।
প্রশ্ন: কেন? অনুমতি ছিল না?
সম্রাট: অনুমতি ছিল। খানিকটা পর্যন্ত। আমরা তো আরও দায়িত্ব নিতে চাইতাম। যেমন ধরুন, খুব ছোটবেলায় অতিথিদের ভোগ পরিবেশনে ছোটদের কাঁধে ভার পড়ত জল দেওয়ার। তখন খিচুড়ি পরিবেশন করতে দেওয়া হত না আমাদের। খিচুড়ি বা চচ্চড়ির বাসন তুলতেই পারতাম না। ধীরে ধীরে বড় হতে হতে সেই জল পরিণত হল চাটনি আর মিষ্টিতে। বয়স বাড়ার পর, চঞ্চলতা কমে যাওয়ার পর খিচুড়ি পরিবেশনের দায়ভার পাই। সে যে কী আনন্দের! তখন তো এত ভিড় হত না। ৫০০ জন আসতেন হয়তো, তার পর এক হাজার, ৫ হাজার, এখন তো ১০ হাজার মানুষ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তাঁবুতে বসে খাওয়াদাওয়া করেন।
প্রশ্ন: তা ছাড়া সিঁদুর খেলা, বিসর্জনও নিশ্চয়ই খুদে বয়সে আপনাদের কাছে আকর্ষণীয় ছিল?
সম্রাট: বিসর্জন তো এখনও আমাদের মূল আকর্ষণ! সিঁদুর খেলা অবশ্যই মহিলাদের জন্য বেশি আনন্দের। তবে ছোটবেলায় আমাদের কাছে সিঁদুর খেলা মানে হোলির উৎসব (হেসে)। তা ছাড়া ধরুন, যে দিন জলসা বসে, সে দিন নানা ধরনের অনুষ্ঠান হয়। সেখানে প্রীতম, সোনু নিগম, শ্রেয়া ঘোষালের মতো তারকারা অনুষ্ঠান করেন। খুবই সুন্দর হয় সে সব। কিন্তু বিসর্জনের কথা আমি বিশেষ ভাবে বলতে চাই।
ভোগ খাওয়া, সিঁদুরখেলা থেকে বিসর্জন, এলাহি আয়োজন পুজোয়। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: দেবী দুর্গার উচ্চতা সম্ভবত ২০ ফুটের, তাই না? তাঁর বিসর্জন তো রাজকীয় হবেই!
সম্রাট: আমার মতে, আমাদের মতো বিসর্জন কোথাও হয় না। জুহুর সমুদ্রসৈকতে ভিড় করি আমরা। ক্রেন দিয়ে মাঝআকাশে নিয়ে যাওয়া হয় প্রতিমাকে। আমরা সকলে গোল করে দাঁড়াই। দৃশ্যত সেটা অকল্পনীয় সুন্দর। অন্যেরাও দাঁড়িয়ে দেখেন।
প্রশ্ন: তা হলে বলছেন, কলকাতার পুজোর পাশাপাশি মুখোপাধ্যায় বাড়ির পুজোও সকলের দেখা উচিত?
সম্রাট: বিসর্জনের এমন দৃশ্য দেখার জন্য আমি সকলকে আমন্ত্রণ জানাতে চাই। শুধু বিসর্জন কেন, এক বার অন্তত প্রত্যেকের এই পুজোর অভিজ্ঞতা হওয়া উচিত। আপনারাও আসুন সকলে মিলে।