fake wedding party

গান-নাচ-সাজগোজ সব আছে, নেই শুধু বর-বৌ! দিল্লির ভুয়ো বিয়ে নিয়ে চলছে চর্চা, কলকাতা কী বলছে?

সম্প্রতি দিল্লিতে আয়োজিত হয়েছিল ভুয়ো বিবাহের আসর। বিয়ের আগে যে সঙ্গীতের অনুষ্ঠান হয় উত্তর ভারতে, তেমন একটি পার্টি ঘিরে জোর চর্চা শুরু হয়েছে। কলকাতা কি বিয়ের নামে এমন পার্টিতে আগ্রহী?

Advertisement

অভিনন্দন দত্ত

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০২৫ ০৮:৫৩
Share:

দিল্লিতে নকল বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অনেকেই। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।

পহলে দর্শনধারী! সমাজমাধ্যমের দৌরাত্ম্যে এখন আরওই এ কথা সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা এবং দেখানো জরুরি কাজ বলা চলে। তা সে সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়াই হোক না কেন!

Advertisement

বিয়ের অনুষ্ঠানে সাজতে অনেকেই পছন্দ করেন। কিন্তু রোজ তো পরিচিত পরিমণ্ডলে তেমন আসর বসে না। বসলে তখন শুধু বাঙালি বিয়ের রীতিতে সীমাবদ্ধ থাকেন না আজকাল বাঙালিরাও। সঙ্গীত বা মেহন্দির মতো অন্য প্রদেশের রীতিরও দিব্যি প্রবেশ ঘটেছে বাঙালিদের বিয়েতে। কিন্তু ইচ্ছে হলেই তো বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া যায় না। তার জন্য তো অন্তত এক জোড়া বর-কনে প্রয়োজন!

দিল্লিতে সে সবের বালাই চুকিয়ে এ বার বর-কনে ছাড়াই বিয়ের আসর বসানো হয়েছিল। আয়োজন করা হয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান। অর্থাৎ, বর নেই, কনেও নেই। বিয়েও হবে না পরদিন। শুধু এক দিনের হুল্লোড়। নাচ-গান-খাওয়াদাওয়া। পার্টির থিম হল বিয়ের সঙ্গীত।

Advertisement

সেই অনুষ্ঠানের আয়োজনের কথা জানাজানি হতেই চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে। অম্বানী পরিবার বা কোনও তারকার বিয়ের বাইরে সাধারণ একটি সঙ্গীতের অনুষ্ঠান ঘিরে কৌতূহল কেন? কারণ, সবটাই তো নকল!

অনুষ্ঠানের নামও তেমন ভাবেই ছড়িয়েছে। লোকে ‘ফেক ওয়েডিং’, অর্থাৎ, ভুয়ো বিয়ে বলেই চর্চা করছে। সমাজমাধ্যমে অনুষ্ঠানের যে ছবি এবং ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়েছে, সেখান থেকে জানা যাচ্ছে, খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে মেহন্দি এবং ডিজে— অনুষ্ঠানে উত্তর ভারতের আর পাঁচটা বিয়ের মতোই আয়োজন ছিল। শুধু, ছিলেন না কোনও পাত্র-পাত্রী। অভ্যাগতদের সাবেকি সাজেই দেখা গিয়েছে। দিল্লির মতো কলকাতাও কি এমন উৎসবে মাতার জন্য প্রস্তুত?

বিদেশে ‘ফেক ওয়েডিং’ পার্টির চল রয়েছে। এ দেশে বিষয়টা তুলনামূলক ভাবে নতুন। তাই দিল্লির নকল সঙ্গীতের অনুষ্ঠানটি দাবানলের মতো ভাইরাল হয়। কুতুব মিনারের কাছে এক রেস্তরাঁর ছাদে ভুয়ো বিয়ের এই অনুষ্ঠানটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘জুম্মা কি রাত’। টাকা দিয়ে অনলাইনে পাস কিনে পৌঁছে গেলেই হল। সূত্রের দাবি, টিকিটের দাম ছিল ৫৫০ টাকা। সাবেকি পোশাকের খরচ আলাদা। সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন প্রায় কয়েকশো অতিথি।

অনুষ্ঠানের এই আমন্ত্রণপত্রই সমাজমাধ্যমে অনেকের নজর কেড়েছে। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।

সাধারণত, কোনও সিনেমার শুটিং বা সমাজমাধ্যম প্রভাবীদের প্রয়োজনে নকল বিয়ের মহড়া তৈরি করা হয়। কিন্তু নেহাত বিয়ের আবহ উপভোগ করার জন্য নকল মহড়া নতুন ‘ট্রেন্ড’ বলেই মনে করছেন অনেকে। সঙ্গীতশিল্পী লগ্নজিতা চক্রবর্তীকে কলকাতার বহু পার্টিতে দেখা যায়। কিন্তু এ রকম কোনও পার্টিতে যেতে স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন না বলেই জানালেন লগ্নজিতা। তিনি বললেন, ‘‘কাজের সূত্রে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতে হয়। খুব কাছের মানুষ হলে, সেই বিয়েবাড়িতেও যাই। কিন্তু এখানে তো দেখছি পাত্র-পাত্রীই থাকছে না! তা হলে যাব কেন?’’

লগ্নজিতার বক্তব্য, এখন অনেক কিছুই হচ্ছে, যেটা আগে কোনও দিন কল্পনাও করা যায়নি। তাই কলকাতাতেও এই ধরনের অনুষ্ঠান হলে অবাক হবেন না তিনি। কিন্তু নিজে সেখানে যাবেন না।

ইন্ডাস্ট্রির কোনও পার্টিতে গেলেও তা যেন কর্মসূত্রে হয়, সে দিকে বিশেষ খেয়াল রাখার চেষ্টা করেন শিল্পী সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর উত্তর, ‘‘আমার কাজই আমার পরিচিতি। কোনও হুজুগে গা ভাসিয়ে সমাজমাধ্যমে ছবি পোস্ট করে সস্তা প্রচারের প্রয়োজন আমার নেই।’’ সুজয়প্রসাদ পরিচিতদের বিয়ের আমন্ত্রণ রক্ষা করেন। তিনি বললেন, ‘‘কৈশোরে হয়তো বর্ষযাপনের পার্টিতে অপরিচিতের ভিড়ে গিয়েছি। কিন্তু এখন তো সেটা পারব না। আর করতেও চাই না।’’

বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে অনেকেই বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেন। আবার সমকামী বিয়ের সাক্ষীও থাকছে সমাজ। সুজয়প্রসাদ বললেন, ‘‘আমার যদি কোনও সঙ্গী থাকত, আমি হয়তো বন্ধুদের জন্য একটা ডিনার পার্টির আয়োজন করতে পারি। তার একটা অর্থ রয়েছে। কিন্তু যেটা হয়েছে, সেটা তো অযৌক্তিক।’’

সুজয়প্রসাদের কাছে বিয়ে সনাতন ঐতিহ্য। তাই কোনও নকল সঙ্গীত বা বিয়ের অনুষ্ঠান কোনও সাংস্কৃতিক উপলক্ষ হতে পারে না। তাঁর কথায়, ‘‘সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা কোন সীমায় পৌঁছেছে, তা দেখে অবাক লাগছে। তবে এই ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কোনও বক্তব্য প্রকাশিত হয় না!’’ শহর কলকাতায় যে হুজুগের অভাব নেই, সে কথা স্বীকার করে নিয়েই সুজয়প্রসাদের অনুমান, এ রকম কোনও আয়োজন হলে, সেখানে ভিড়ের কমতি হবে না!

(বাঁ দিক থেকে) সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, লগ্নজিতা চক্রবর্তী এবং সত্যম ভট্টাচার্য। ছবি: সংগৃহীত।

ভারতের মতো দেশে সময়ের সঙ্গে বিয়ের খরচ বেড়েছে। এমনকি, অর্থের অভাবে অনেকেই সন্তানের বিয়ে মনের মতো করে দিতে পারেন না। এখনও ‘গণবিবাহ’ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে খরচ করে নকল বিয়ের অনুষ্ঠানকে বিয়ের নামে ‘প্রহসন’ বলেই দেখছেন অভিনেতা সত্যম ভট্টাচার্য। গত বছর দীর্ঘ দিনের বান্ধবীর সঙ্গে সাত পাকে বাঁধা পড়েছেন সত্যম। তিনি বললেন, ‘‘কালীঘাটে আমার বাবার অফিস। আগে কালীঘাট মন্দির থেকে প্রচুর মানুষকে বিয়ে করে বেরোতে দেখতাম। তাঁদের যথাযথ সামর্থ্য নেই বলেই হয়তো তাঁরা মন্দিরে বিয়ে করছেন। সেখানে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে নকল পার্টির অর্থ আমার জানা নেই।’’

সত্যমের কাছে বিবাহ পবিত্র বন্ধন। তা নিয়ে কোনও রকম মশকরায় তিনি বিশ্বাসী নন। তাঁর কথায়, ‘‘বিবাহবিচ্ছেদ বেড়েছে। কিন্তু বিয়ে তো মানুষ এক বার ভেবেই করে থাকেন। আর কোনও কিছু যদি সারা জীবনের জন্য হয়ে থাকে, তা হলে সেটাকে যোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা উচিত।’’

টলিপাড়ায় বিভিন্ন রকমের পার্টি হয়। সেখানে নানা থিমও থাকে। তাই সত্যমের প্রশ্ন, ‘‘যদি পার্টি করতেই হয়, তা হলে সাবেকি পোশাক ড্রেস কোড রাখা যেতে পারে। নকল সঙ্গীতের অনুষ্ঠান তো খুবই নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। আমি কোনও দিন এ রকম অনুষ্ঠানের অংশ হতে চাই না।’’

‘ফেক সঙ্গীত পার্টি’র বিষয় ভাবনা শুনে অবাক হয়েছেন শহরের পরিচিত ওয়েডিং ফোটোগ্রাফার অনির্বাণ ব্রহ্ম। প্রায় ১৬ বছরের অভিজ্ঞতাকে সম্বল করেই অনির্বাণ বললেন, ‘‘আমি দেশ জুড়ে এক হাজারেরও বেশি সঙ্গীত এবং বিয়ের অনুষ্ঠানে ছবি তুলেছি। কিন্তু এ রকম কিছু এখনও পর্যন্ত শুনিনি।’’ অবাঙালিদের বিয়ের আগের দিন অনুষ্ঠিত হয় সঙ্গীত। সেখানে নাচ-গান বা খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি দুটি পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। অনির্বাণের কথায়, ‘‘সঙ্গীতের মাধ্যমে দুই পরিবার একে অপরকে চিনতে পারে। পেশাদার সেখানে পারফর্ম করতে পারেন। আবার পরিবারের সদস্যেরাও নাচ-গান করতে পারেন। এই আত্মিক আবহ তো কোনও নকল পার্টিতে পাওয়া সম্ভব নয়।’’

অনির্বাণ জানালেন, কখনও পাত্র-পাত্রীর পাসপোর্ট বা ভিসার খাতিরে নকল ফোটোশুটের প্রয়োজন হয়। কিন্তু নকল সঙ্গীতের পার্টিকে সেখানে তরুণ প্রজন্মের ‘নতুন চমক’ বলেই মনে করছেন তিনি। অনির্বাণের মতে, এ রকম পার্টি বা ‘মিউজ়িক্যাল নাইট’ নতুন কোনও ট্রেন্ড শুরু করতে পারবে না। আসল বিয়ে এবং নকল বিয়ের অনুষ্ঠানের পার্থক্যকে তিনি সাবেকি পুজো বনাম থিমের পুজোর সঙ্গে তুলনা করতে চাইছেন। অনির্বাণের কথায়, ‘‘নতুন কোনও জিনিস নিয়ে মানুষের এক-দু’বার আগ্রহ জন্মাতে পারে। তবে সময়ের সঙ্গে মানুষ ভুলেও যাবেন।’’ শহরে এ রকম কোনও পার্টিতে ছবি তোলার ডাক পেলে কী করবেন অনির্বাণ? হেসে বললেন, ‘‘আমি পেশাদার। তাই উপযুক্ত পারিশ্রমিক পেলে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেব না। পাশাপাশি, অন্য রকম অভিজ্ঞতাও হবে।’’

কলকাতার ইভেন্ট ম্যানেজিং সংস্থাগুলির কাছে কি কখনও এ রকম প্রস্তাব এসেছে? ভবিষ্যতে এলে তাদের ভাবনা কী রকম? শহরের প্রথম সারির একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা গত ডিসেম্বরে কানাডিয়ান রক শিল্পী ব্রায়ান অ্যাডামসকে কলকাতায় নিয়ে আসে। সংস্থার অন্যতম কর্ণধার কিঞ্জল ভট্টাচার্য জানালেন, এখনও পর্যন্ত তাঁদের কাছে নকল বিয়ের অনুষ্ঠানের বরাত আসেনি। কিন্তু তাঁর বক্তব্য, ‘‘সমাজমাধ্যমের দৌলতে এখন নতুন কোনও উদ্যোগের সাক্ষী থাকতে মানুষ টাকা খরচ করতে রাজি। তাই ওই পার্টিটা ভাইরাল হলে, আগামী দিনে এই ধরনের পার্টির আয়োজন হতেও পারে।’’

কিঞ্জল জানালেন, দিল্লির পার্টির খবর তিনি সমাজমাধ্যম থেকেই জানতে পেরেছেন। কিন্তু অনুষ্ঠানের আয়োজকদের তিনি চেনেন না। যে কোনও অনুষ্ঠানের নেপথ্যে উপলক্ষ থাকে। কিঞ্জলের কথায়, ‘‘হতেও তো পারে যাঁরা বিয়েতে বিশ্বাসী নন বা যাঁদের সংসার এক সময়ে ভেঙে গিয়েছে, তাঁরাই এই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। এটা বিবাহ প্রতিষ্ঠানের প্রতি এক ধরনের প্যারোডি, যাকে ব্যবহার করে টিকিট বিক্রি হয়েছে।’’

শহরে এই ধরনের পার্টির আয়োজন করবেন কি না, তা নিয়ে এখনই নিশ্চিত নন কিঞ্জল। বিবাহ বিষয়ক কোনও বহুজাতিক সংস্থা বিয়ের থিমে পার্টি করলে তার মধ্যে কোনও ক্ষতি নেই বলেই বিশ্বাস করেন কিঞ্জল। আবার বর্ষযাপনের পার্টিও বিয়ের থিমে করা হলে মৌলিকত্বের নিদর্শন তুলে ধরতে পারে। কিন্তু ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে যে কোনও নতুন পদক্ষেপের নেপথ্যে বাজারের চাহিদাকে বিচার করা প্রয়োজন। কিঞ্জলের যুক্তি, ‘‘এখন যে কোনও জিনিসকেই সহজে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা যায়। তাই নকল বিয়ের অনুষ্ঠান নির্দিষ্ট কোনও শ্রেণির মানুষ বা সংস্কৃতিকে আঘাত করছে কি না, তা না বুঝে ট্রেন্ডে গা ভাসাতে আমরা কোনও হঠকারী সিদ্ধান্ত নেব না।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement