প্রতীকী চিত্র। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
পুজোর ঢাকে কাঠি পড়েছে। কুমোরটুলিতে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা তুঙ্গে। সেই সঙ্গে উত্তর কলকাতার কুমোরপাড়ার সরু গলিতে ভিড় বাড়ছে ফোটোগ্রাফার, ভ্লগার এবং মডেলকন্যাদের। পুজোর আগে কুমোরটুলির ছবি তোলা এখন আর ‘ট্রেন্ড’ নয়, বরং আলোকচিত্রীদের কাছে রীতিমতো ‘রুটিন’-এ পরিণত হয়েছে। বছরের অন্য সময়ে ভিড় কম থাকলেও পুজোর মাস দেড়েক আগে থেকে মৃৎশিল্পীদের কর্মক্ষেত্রে তাঁদের আনোগোনা বাড়তে থাকে। গত ১০ বছরে ক্যামেরার সহজলভ্যতায় পুজোর আগে কুমোরটুলি আলোকচিত্রীদের কাছে ‘পাখির চোখ’। কিন্তু এই ট্রেন্ড কি জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে? না কি ফোটোগ্রাফারদের চাপে তিন শতকেরও বেশি বয়স্ক কুমোরপাড়ার নাভিশ্বাস উঠছে?
দুর্গাপুজোর আগে সপ্তাহের প্রতিটা দিনই কুমোরটুলিতে ভিড় চোখে পড়ে। তবে তা বাড়ে সপ্তাহান্তে ছুটির দিনে। তাই সকাল থেকেই বাবা-মায়েদের হাত ধরে কোনও খুদে ঠাকুর গড়ার কর্মযজ্ঞ চাক্ষুষ করতে চলে আসে। আর দুপুরের পর থেকে ভিড় বাড়ে ফোটোশিকারিদের। কেউ চিত্রসাংবাদিক, কেউ ফ্যাশন ফোটোগ্রাফার আবার কেউ নেহাতই শখে মোবাইল হাতে চলে এসেছেন। ছাত্রছাত্রীদের ভিড়ও নেহাত মন্দ নয়। এমনকি প্রি-ওয়েডিং ফোটোশুটের জন্যও যুগলেরা এখানে চলে আসছেন।
কুমোরটুলিতে ছবি তোলাকে কেন্দ্র করে শিল্পীদের সঙ্গে অতীতেও ফোটোগ্রাফারদের বিতর্কের কথা প্রকাশ্যে এসেছে। কিন্তু এই ছবি তোলাকে কেন্দ্র করে তৈরি সমস্যা নিয়ে শিল্পীরা কিছুটা সাবধানি। প্রশ্ন করতেই উত্তর আসে, ‘‘এখন ব্যস্ত আছি। পরে আসুন।’’ আবার বিক্ষিপ্ত আক্ষেপও চাপা থাকল না।
কুমোরটুলিতে নিজস্বী তুলতে ব্যস্ত কলেজপড়ুয়ারা। —নিজস্ব চিত্র।
পুজোর আগে লক্ষ্যমাত্রাকে মাথায় রেখে শিল্পীদের কাজ করতে হয়। কারণ, এখন মহালয়ার দিন থেকেই বিভিন্ন মণ্ডপে প্রতিমা নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়। হাতে সময় কম। তার উপর থাকে বৃষ্টির চোখরাঙানি। তাই কাজের ফাঁকে ফোটোগ্রাফারদের জন্য পোজ় দেওয়া বা তাঁদের পছন্দের শটটির সুযোগ করে দিতে নারাজ অনেকেই। প্রায় তিন পুরুষ ধরে কুমোরটুলিতে মৃৎশিল্পের পারিবারিক ব্যববসা চালাচ্ছেন জগদীশ দত্ত। বলছিলেন, ‘‘ছবি তোলার হিড়িক দিনে দিনে বাড়ছে। তবে একাধিক সমস্যা রয়েছে। স্টুডিয়োয় ঢুকে কেউ ছবি তুলে চলে গেল। পরে দেখলাম, ঠাকুরের হাত ভেঙে গিয়েছে! তখন তা জোড়া দেওয়া আর এক সমস্যা।’’
দুপুর গড়াতেই কুমোরটুলি যেন ‘জীবন্ত দুর্গা’দের বিচরণস্থল। তবে কেউ কাউকে একচুল জমি ছাড়তে নারাজ। মডেলকন্যারা প্রায় সকলেই লাল পাড় সাদা শাড়িতে সজ্জিতা। সঙ্গে ব্যক্তিগত ফোটোগ্রাফার। সহকারীদের ব্যাগ থেকে উঁকি দিচ্ছে দেবীর অস্ত্রশস্ত্র এবং পদ্ম। যাঁর যেমন বিষয়ভাবনা, সেই মাফিক আয়োজন। বরাহনগর থেকে দুর্গাবেশে এসেছিলেন মৌমিতা দাস। বিষয় ‘আগমনী’। চলতি বছরেই তাঁর প্রথম বার কুমোরটুলিতে আসা। বললেন, ‘‘এখন তো প্রতি শনি-রবি আসতে হবে। সব কনসেপ্ট আমার ভাবা। সেই মতো সমাজমাধ্যম থেকে ফোটোগ্রাফারও পেয়ে যাই। দু’পক্ষের মতের মিল হলে শুট করতে চলে আসি।’’ আবার মাতৃরূপে প্রকাশ্যে ফোটোশুট যে কখনও ‘শালীনতা’র মাত্রা অতিক্রম করে, তা নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করলেন মৃৎশিল্পীদের একাংশ।
কুমোরটুলিতে চলছে আগমনী ফোটোশুট। —নিজস্ব চিত্র।
কুমোরটুলিতে ছবি তোলার হিড়িক যে দিনে দিনে বাড়ছে, তা মেনে নিচ্ছেন অনেকেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিল্পীর কথায়, ‘‘মোবাইল এসে তো সবটা শেষ করে দিল। সবাই ফোটোগ্রাফার! যাঁরা প্রকৃত ফোটোগ্রাফার, তাঁরা কিন্তু আমাদের কাজে ব্যাঘাত ঘটান না।’’ কথা বলে জানা গেল, পুজোর আগে এখানকার ছবি সমাজমাধ্যমে পোস্ট করলে বেশি ভিউ আসে। শখের ফোটোগ্রাফারদের কাছে তাই কুমোরটুলিতে আসা হয়ে দাঁড়ায় বাধ্যতামূলক। আবার কেউ কেউ শুধুই সময় বার করে মৌলিক ফ্রেমের সন্ধানে চলে আসেন। আবার যাঁদের শিল্পের ছবি বা ভিডিয়ো তুলে আলোকচিত্রীরা উপার্জন করছেন, তাঁদের ভাঁড়ারে তার কানাকড়িও আসে না বলেও আক্ষেপ রয়েছে অনেকের।
বিদেশিদের হেরিটেজ ওয়াক বা ফোটোগ্রাফারদের তোলা ছবির দৌলতে কুমোরটুলি সারা বিশ্বে জনপ্রিয়। কিন্তু ছবি এবং ভিডিয়োর দৌলতে স্থানীয়দের নানা ধরনের সমস্যা বার বার আলোচনা উঠে এল। ১৪ বছর বয়স থেকে প্রতিমা গড়ার কাজে যুক্ত রয়েছেন মালা পাল। বর্তমানে এলাকার ‘দোলনা স্পোর্টিং ক্লাব’-এ তিনি ছাত্রছাত্রীদের মৃৎশিল্পের প্রশিক্ষণ দেন। ক্লাসের ফাঁকে তাঁর আক্ষেপ, ‘‘ছবি তোলা নিয়ে সমস্যা নেই। তবে অজান্তে ব্যক্তিগত পরিসর যদি ছবি বা ভিডিয়োর বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে তো মুশকিল!’’ তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘প্রতিমার ছবি তুলুন। কিন্তু এটা কি দেবী সেজে ত্রিশূল হাতে ছবি তোলানোর জায়গা?’’ পাশ থেকে আরও এক নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক শিল্পীর সরস মন্তব্য, ‘‘হঠাৎ করে ফোনে দেখলাম, ফেসবুকে আমার ঘুমোনোর ছবি পোস্ট হয়েছে। তাতে একগুচ্ছ লাইক। এ দিকে কখন তা তোলা হয়েছে, জানি না! ভাল লাগে, বলুন তো!’’
পুজোর আগে কুমোরটুলিতে ফোটোশুটের প্রবণতা বাড়ছে। —নিজস্ব চিত্র।
তবে এর বিপরীতে অন্য চিত্রও দেখা গেল। বছরের এই সময়ে কুমোরটুলির ভিড় মানে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মুনাফা বৃদ্ধি। শোভাবাজার-সুতানুটি মেট্রো স্টেশনের সামনে অটোচালকদের ‘কুমোরটুলি’ বলে হাঁক বাড়ে। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে খাবারের দোকানের ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে। কুমোরপাড়ার কেন্দ্রে গত ছ’বছর ধরে চলছে ‘দ্য ট্রাম টি শপ’। দোকানের কর্ত্রীর কথায়, ‘‘মানুষ এলে বিক্রি ভাল হয়। ভাল ব্যবসা কে না চায়!’’
উল্লেখ্য, কুমোরটুলিতে ছবি তোলার জন্য ‘কুমোরটুলি মৃৎশিল্প সংস্কৃতি সমিতি’র তরফে প্রতি বছর একটি কার্ড ইস্যু করা হয়। ১০০ টাকার বিনিময়ে ১ মাসের জন্য ছবি তোলার অনুমতি মেলে। তবে সংগঠনের সম্পাদক বাবু পাল বললেন, ‘‘কার্ডে দুপুর ১টা থেকে ৩টে পর্যন্ত ছবি তোলা নিষেধ। তা ছাড়া অনুমতি ব্যতিরেকে কোনও স্টুডিয়োয় ভিতরে প্রবেশ করে ছবি তোলাও নিষেধ। কিন্তু কেউ সেটা মানেন না।’’
(উপরে) কুমোরটুলিতে ছবি তোলার পাস। বিকেল হতেই ভিড় বাড়তে থাকে উৎসাহীদের (নীচে)। —নিজস্ব চিত্র।
ছবিশিকারিদের কাছে প্রয়োজনীয় কার্ড রয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য ভলান্টিয়ার সংখ্যায় কম। তাই বচসা চলতেই থাকে। পাশাপাশি, নিজের মোবাইলে ছবি তুললে আপত্তি কোথায়, এই যুক্তি নিয়ে বচসাও যে নিত্যদিনের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে দিকেও ইঙ্গিত করলেন বাবু। সমিতির পর্যবেক্ষণ, গত বছর আরজি কর-কাণ্ডের জেরে কুমোরটুলিতে ভিড় কমেছিল। কিন্তু চলতি বছরে এলাকা আবার স্বমহিমায়। ভবিষ্যতে ছবি তোলা নিয়ে কড়া নিয়মকানুনের কথাও ভাবছে সংগঠন।
পুজোর আগে কুমোরটুলি যেন শিল্পের জন্য শিল্পীদের ‘রণক্ষেত্র’। প্রতিমাশিল্পীদের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছেন আলোকচিত্রীরা। শখের আলোকচিত্রীদের দাপটের মাঝখানেই খড়ের কাঠামো থেকে একমেটে, দোমেটে হয়ে ক্রমে রঙের পরত চড়ছে, রূপ পাচ্ছেন মৃন্ময়ী। মহালয়ার বেশি দেরি নেই। ফোটোশিকারিদের ক্যামেরার ঝলকানি এড়িয়ে তার আগেই আবির্ভূতা হবেন দশভুজা। এর পর ক্যামেরার চোখ বন্ধ হয়ে যাবে। কাঁপা কাঁপা হাতে মহালয়ার দিন তুলি ধরবেন বৃদ্ধ পালমশাই। ঝলসে উঠবে ত্রিনয়ন। শিল্পীর সম্বচ্ছরের অপেক্ষা তো সেই ক্ষণটির জন্যই। তখন ক্যামেরার নজর সরে যাবে অন্য কোনও দিকে। ত্রিনয়নেই জগৎ দেখবেন দেবী। তার সামনে ক্যামেরার নয়ন তখন মূল্যহীন।