মানসিক স্বাস্থ্যের পরিষেবার ডাকে শহর জুড়ে পোস্টার। নিজস্ব চিত্র।
‘‘আপনার কি মন খারাপ হয়?’’
‘‘কথা বলার মানুষ কাছে পান?’’
‘‘পরিবারের কেউ মনের কথা বললে আপনি শোনেন?’’
‘‘রাস্তায় চলতে চলতে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে মনোরোগ নিয়ে কথা বলতে রাজি হবেন?’’
গড়িয়াহাটের মোড়ে বাস, গাড়ির আওয়াজ। পথচলতি মানুষের তাড়া। তার মাঝে জনা কয়েক মহিলা এমনই সব প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন ভিড়ের দিকে। প্রশ্ন শুনে কেউ দাঁড়াচ্ছেন, কেউ অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে যাচ্ছেন। যাঁরা দাঁড়িয়ে পড়ছেন, তাঁদের দু’টি ছবি দেখানো হচ্ছে। রাস্তায় সাঁটানো পোস্টারের ছবি। পরের ধাপের প্রশ্ন, ‘‘এমন পোস্টার কোথাও দেখেছেন আগে?’’ বা ‘‘ছবিতে কী দেখতে পাচ্ছেন?’’ অথবা ‘‘ছবি দেখে মনের ভিতর প্রশ্ন জাগছে?’’ উত্তরে কেউ নীরব রয়েছেন, কেউ ভাবার চেষ্টা করছেন, কেউ বা দেখার চেষ্টা করছেন।
মনোরোগের চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে পোস্টার সাঁটা হল গড়িয়াহাটে। নিজস্ব চিত্র।
গড়িয়াহাট মোড় থেকে বাসন্তীদেবী কলেজ পর্যন্ত নানা জায়গায় এমনই পোস্টার সাঁটা হয়েছে। মহিলাদের দল থেকেই এক-দু’জন আঠা দিয়ে পোস্টার সাঁটছেন রাস্তার থামে, ট্রান্সফরমারের গায়ে। আর সে ছবিগুলিই মূল চরিত্রে। প্রথম কয়েক সেকেন্ড দেখে হয়তো কিছুই বোধগম্য হবে না। কিন্তু ধীরে ধীরে চোখে পড়বে মানুষের মুখ, চিৎকার, ঝড়, মানসিক স্বাস্থ্য, সঙ্কট, ভয়ঙ্কর নিম্নচাপ। রঙের উপর রং। চোখধাঁধানো তুলির কাজ। ঠিক যেন সার্কাসের পোস্টার। দু’টি ছবিই কথা বলছে মনোরোগের চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসার জন্য সকলের আগে প্রয়োজন পরিষেবার সহজলভ্যতা। সেটিই কোথাও পাওয়া যায় না। তাই তা থেকে দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে মানুষ।
ছবি দেখে সে কথাই বোঝার চেষ্টা করছেন পথচলতি অনেকে। যদিও সচেতনতা ছড়ানো সহজ নয়। ঘণ্টা দুইয়ের চেষ্টায় মাত্র ২৬ জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা গেল। কিন্তু উদ্যোক্তারা তাতে দমেন না। কারণ, যে ক’জন দাঁড়ালেন, তাঁদের অনেকের কাছ থেকেই এল নানা প্রশ্ন বা মন্তব্য, যা কাজটি এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে হয়তো। ছবি দেখতে দেখতে এক তরুণী বলেই ফেললেন, ‘‘আমার মা-বাবা মানসিক রোগের ব্যাপারে খুব একটা বোঝেন না। ভাবেন যে, সবই আমার মনের ভুল, বা আমি ফাঁকি দিচ্ছি।’’
মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পোস্টার। নিজস্ব চিত্র।
মধ্যবয়স্ক এক পুরুষ দাঁড়িয়ে পড়লেন পোস্টার দেখে। তার পর বললেন, ‘‘চিকিৎসার কথা ভাবতে পারি না, কারণ বড্ড খরচ যে। কিন্তু থেরাপি হিসেবে কথা বলতে তো ইচ্ছে করেই। কেবল আমাদের বয়সি মানুষদের জন্য নয়, ছোটদেরও খুব দরকার।’’ প্রায় ৭০ বছরের এক বৃদ্ধও থামলেন পোস্টার দেখতে। খানিক কাঠিন্য তাঁর কণ্ঠে। সব পোস্টার দেখে তাঁর মন্তব্য, ‘‘রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি এত খারাপ, মন তো খারাপ হবেই। কিন্তু এই বয়সে আর আলাদা করে মনের যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আর ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনি থাকে আমেরিকায়। সাধারণ কথা বলারই সুযোগ নেই। মন নিয়ে আবার কী বলব! শুনবই বা কী!’’
আংটি-বিক্রেতা মধ্যবয়স্ক পুরুষের দোকানটিতে ভর্তি খদ্দের। কিন্তু যে মুহূর্তে কাজের ফাঁকে বিরতি পেলেন, মহিলাদের দল থেকে তাঁর কাছে যাওয়া হল কথা বলতে এবং পোস্টারের ছবি দেখাতে। লেখা বুঝিয়ে দেওয়ার পর তিনি বললেন, ‘‘খুবই প্রয়োজনীয় ভাবনা, কিন্তু আমার বা আমার বাড়ির কারও মন নিয়ে ভাবার সময় নেই। আমরা বেশ ভালই আছি। প্রার্থনা করব, যেন তা-ই থাকি।’’
বাসন্তীদেবী কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে চার জন তরুণ-তরুণীকে একই ভাবে পোস্টার দেখানো হল। তাঁদের মধ্যে এক তরুণ বেশ খানিক ক্ষণ ধরে ছবিটি দেখে বোঝার চেষ্টা করলেন। তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এল শোষণ ও শোষিতের গল্প। কিন্তু বন্ধুরা তাড়া দেওয়ায় বেশি সময় ব্যয় করতে পারলেন না তিনি।
কলকাতার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মনোসমাজকর্মীরা। নিজস্ব চিত্র।
অবশ্য প্রত্যেকের হাতেই ধরিয়ে দেওয়া হল হলুদ রঙের একটি কাগজের টুকরো। যেখানে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, প্রয়োজন হলে ডাক দিলেই হবে। সঙ্গে সঙ্গে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে রাজি সেই মহিলার দল।
তাঁরা হলেন কলকাতার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মনোসমাজকর্মী। যাঁরা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কলকাতা শহরের নানা এলাকায় গিয়ে এই পোস্টার সাঁটিয়ে আসছেন। তার পর দাঁড়িয়ে দেখছেন, মানুষের নজর কাড়ছে কি না। কিন্তু প্রথম সপ্তাহে খুব একটা সাফল্য না মেলায় পরের সপ্তাহ থেকে সরাসরি কথোপকথনে অংশ নিচ্ছেন তাঁরা। আর সেখান থেকেই মানুষের মনের ভিতরটা পড়ার চেষ্টা চলছে, এমন পোস্টার দেখার অভ্যাস তৈরি করানোর চেষ্টা চলছে, আর চলছে সাহায্য করার চেষ্টা।
মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায়ের মস্তিষ্কপ্রসূত এই প্রকল্প একেবারেই সূচনাপর্বে রয়েছে এখন। শিল্পী সুমন্ত্র মুখোপাধ্যায় এই পোস্টারগুলি তৈরি করেছেন। রত্নাবলী বলছেন, ‘‘আমাদের দু’জনের মনেই প্রবল অস্থিরতা কাজ করছিল। দু’জনেই ভাবছিলাম, কী ভাবে মনের অদৃশ্য ফাটলগুলিকে দৃশ্যমান করা যায়! তাও আবার এমন এক পৃথিবীতে, যা নিজেই ক্রমশ ভেঙে পড়ছে? আমরা চেয়েছিলাম, মানসিক স্বাস্থ্যের আলোচনা ক্লিনিক ও কনফারেন্সের গণ্ডি পেরিয়ে রাস্তায় নিয়ে আসতে। সেই রাস্তায়, যেখানেই আসলে সঙ্কটের বাস, আর যেখানে যন্ত্রণায় মলম লাগানোর জন্য কেউ নেই।’’
এই সময়টা আসলে সঙ্কটের। প্রায় সব কিছু ভেঙে পড়ছে। এমনই মনে করছেন সুমন্ত্র। তিনি বলেন, ‘‘যে ভাঙন চোখে পড়ছে, সে ভাঙন সারানোর জন্যই প্রস্তুত বিশ্ব। তা সে ব্রিজ হোক বা রাস্তা। কিন্তু যে ভাঙন অদৃশ্য? যে ভাঙনের সময়ে বিস্ফোরক আওয়াজ হয় না? যে ভাঙন নীরব? সে সব নীরবতা দিয়েই তৈরি হয়েছে এই ছবিগুলি।’’ সুমন্ত্র এবং রত্নাবলী জানাচ্ছেন, এই পোস্টারগুলির মাধ্যমে তাঁরা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছেন না। কেবল ভাবনায়, মননে অস্বস্তি জাগাতে চেয়েছেন। চেয়েছেন ভাবাতে, প্রশ্ন করাতে।
এক একটি ছবির মধ্যে তাই ধরা পড়ছে সেই নীরব চিৎকারগুলি। এখন দেখার, কত জনের চোখে পড়ে সেই ছবি, সেই লেখা, মানসিক যন্ত্রণা।