জয়া ভট্টাচার্যের শৈশব কেটেছে অত্যাচারে। ছবি: সংগৃহীত।
মায়ের কারণেই সিনেমাজগতে পা রাখা। কিন্তু সেই মায়ের কারণেই শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, যৌবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। হিন্দি ছবি ও টেলিভিশনের অভিনেত্রী জয়া ভট্টাচার্যের জীবনটা খানিক এমনই। লখনউয়ের বাঙালি পরিবারে্র সন্তান জয়ার ছোটবেলা আদর-যত্নে কাটেনি। সারা ক্ষণ ভয় ও আতঙ্কে ভরা জীবন, অবহেলা ও নির্মমতার কথাই মনে পড়ে তাঁর। তাঁর মা ও বাবার সম্পর্ক বেশ খারাপ ছিল। তাঁদের বিবাদের প্রভাব সন্তানের উপর এসে পড়ত বার বার। জয়া এক সাক্ষাৎকারে এই কঠিন সময়গুলির কথা জানিয়ে বলেছিলেন, মেয়ে হয়ে জন্মানোই যেন তাঁর দোষ ছিল। তাঁর মা নিজের সমস্ত না পাওয়ার জন্য দায়ী করতেন মেয়েকে। আর সেই রাগ, অভিমান শারীরিক অত্যাচারের আকার নিত। হাতের কাছে যা থাকত, তা-ই ছুড়ে মারতেন নিজের মেয়েকে। শৈশব থেকে যৌবন একাকীত্বেই কেটেছে জয়ার।
মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক এতই খারাপ হয়ে যায় যে, জয়া স্থির করে নিয়েছিলেন, জীবনে মায়ের মতো মানুষ তিনি হবেন না। বাইরের লোকে জয়ার সম্পর্কে খারাপ কথা বললে বিশ্বাস করতেন মা। মেয়ের প্রতি ভরসা ছিল না। এমনকি, বাইরের লোকের সামনে মেয়ের নিন্দা করতে পছন্দ করতেন জয়ার মা। বাবাকে ভালবাসতেন জয়া। কিন্তু বাবাও জয়াকে তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত নিতে দেননি। অভিনয় নিয়ে কোনও স্বপ্নই ছিল না জয়ার। তবু খুব ছোটবেলাতেই জোরজবরদস্তি অভিনয় পেশার দিকে ঠেলে দেওয়া হয় তাঁকে।
অভিনেত্রী জয়া ভট্টাচার্য। ছবি: সংগৃহীত।
মায়ের হাতে শারীরিক হেনস্থার শিকার জয়া এমন অনেক শিশুর প্রতিনিধি, যারা নিজেদের ঘরেই সুরক্ষিত নয়। ছেলেমেয়েকে বকাঝকা করে বড় করে তোলায় অনেকে বিশ্বাসী। কিন্তু সেই বকুনি যে কখন অত্যাচারে পরিণত হয়ে যায়, তা অনেকে মা-বাবাই বুঝতে পারেন না। কিন্তু এই দুই প্রকার অভিভাবকত্বে বিস্তর ফারাক রয়েছে। মনোবিদ আত্রেয়ী ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘অনেকেই বিশ্বাস করতেন, সন্তানের সুচরিত্র গঠনের জন্য তার প্রতি একটু কঠোর মনোভাব রাখা প্রয়োজন। কিন্তু কঠোরতার মাপকাঠি কী হওয়া উচিত, তা কিন্তু এক এক জনের কাছে এক এক রকমের। কতটা কঠোর হওয়া উচিত, কোনখানে পৌঁছলে সেটি সীমা লঙ্ঘন করে, তা অনেকেই বোঝেন না। তাই সেই মাত্রা বাড়তে বাড়তে শিশুর জন্য ক্ষতিকারক পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এমনকি তাতে তাদের প্রাণহানিও হতে পারে। কিন্তু হয়তো অভিভাবকের উদ্দেশ্য ছিল কেবল সন্তানকে বোঝানো।’’ এ ভাবে শিশুর প্রতি হেনস্থার প্রবণতা বাড়তে পারে।
তবে এ ছাড়াও আরও নানা কারণে মা-বাবা তাঁদের সন্তানের উপর অত্যাচার করে ফেলেন। কেউ আবার সচেতনতার অভাব থেকে এই ধরনের আচরণ করে ফেলেন। কতটা শাসন বা মারধর করলে সন্তানের ক্ষতি হবে না, সে সম্পর্কে ধারণা থাকে না অনেক অভিভাবকের। কখনও সখনও নিজেদের রাগ উগরে দেওয়ার জন্য সন্তানদের ব্যবহার করে থাকেন বাবা-মা। ঠিক যেমন ভাবে জয়াকে দুর্বল ভেবে তাঁর উপর অত্যাচার করতেন তাঁর মা।
শিশু নির্যাতনের ঘটনা বাড়তে থাকায় ২০১৫ সালে ‘ইন্ডিয়ান জাস্টিস জুভেনাইল অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন পাশ হয়েছিল। সেখানে সমস্ত রকমের শিশু নির্যাতনের উদাহরণ তুলে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল, কী ভাবে কঠোর অভিভাবকত্ব শিশু নির্যাতনে পরিণত হতে পারে। এর ফলে সন্তানের উন্নতির বদলে ক্ষতি বেশি হচ্ছে। শিশু নির্যাতনের ঘটনা ভারতে খুবই বেশি। ৫০ শতাংশ শিশু (ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে) যৌন নির্যাতনের শিকার। আর ৮০ শতাংশ শিশু শারীরিক নির্যাতনের কবলে পড়ে।
আত্রেয়ীর কথায়, ‘‘আমাদের দেশে শিশু নির্যাতনের ঘটনার পাশাপাশি যৌন নির্যাতনের ঘটনাও দেখা যায়। অভিভাবকের হাতে যৌন নিগ্রহের শিকারও হয় শিশুরা। তাই বাবা-মাকে কখনওই ঈশ্বরের জায়গায় রাখা উচিত নয়। মা, বাবা, দাদু, দিদিমা বা ঠাকুমার আচরণ নানা ভাবে সন্তানের ক্ষতি করতে পারে।’’
আরও এক ভাবে নির্যাতনের শিকার হতে পারে ছোটরা। মানসিক ভাবে অবহেলা অনেক সময়ে সন্তানের উপর অত্যাচারের পর্যায়ে চলে যায়। খাবার না দেওয়া, জামাকাপড় কিনে না দেওয়া, গুরুত্ব না দেওয়া— এমন নজিরও অবিরল। এতে মানসিক ভাবে ভয়ঙ্কর ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারে শিশুরা। এই ধরনের অত্যাচারকে চিহ্নিত করা সবচেয়ে কঠিন।
অভিভাবকের দ্বারা নির্যাতিত শিশুর মনে কী কী প্রভাব পড়তে পারে, বলছেন মনোবিদ—
১. মানসিক বৃদ্ধি এবং বিকাশ ব্যাহত হতে পারে।
২. শিশুরা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে পারে।
৩. নিজের শরীর, আত্মসচেতনতা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হতে পারে।
৪. পরবর্তী কালে নিজেকে চিনতে শেখা, অপরের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।