অভিনেত্রী নীলাঞ্জনা শর্মা। গ্রাফিক— আনন্দবাজার অনলাইন
হিল-তলা বুট্স। চামড়ার। গোড়ালি ছাড়িয়ে আরও একটু উপরে পৌঁছেছে সে জুতো। যেন কোনও এক হলিউড সিরিজ়ের নায়িকার পা! বলে দিতে হবে না, জুতোটি নামজাদা বিদেশি ব্র্যান্ডের। শীত শেষের কলকাতার সাহেবি আমেজের সঙ্গে দিব্যি মানানসই। গায়ে কোমর ঝুলের কোট। চুল খোলা। নুড শেডের লিপস্টিক। টানটান দাঁড়িয়ে থাকা উষ্ণ হাসি থেকে ছিটকে আসে আলো। ঠিক যেমন কানের সলিটেয়র এবং আঙুলের হিরে বোঝাই আঙটিগুচ্ছের থেকে জ্যোতি ঠিকরে বেরোচ্ছে। পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই মানবীকে দেখে আর যা-ই হোক, ‘ব্রোকেন’ বা ব্যথিত ভাবার বিশেষ অবকাশ নেই। কিছু ক্ষণ পর স্যুপের চামচ থেকে ঠোঁট তুলে নিয়ে সেই তিনিই বলবেন, ‘‘না চেনা পথ খুঁজে পেয়েছি। নতুন ভাবে বাঁচার চেষ্টা করছি!’’
গত জুলাই মাস থেকে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন বেশ চর্চায়। অভিনেত্রী-প্রযোজক নীলাঞ্জনা শর্মার একটি পোস্ট নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। সমাজমাধ্যমে নিজের একটি ছবি দিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘ব্রোকেন বাট বিউটিফুল’’। যার মানে করা যায়, ভেঙে পড়লেও এখনও সুন্দর তিনি। এমন সময়ে তাঁকে যাঁরা ভালবাসায় ভরে রেখেছেন, পাশে আছেন, তাঁদের নাম লিখে ধন্যবাদ জানান সেই পোস্টে। নাম আছে তিন জনের। দুই কন্যা সারা ও জ়ারা। আর সঙ্গে আছেন দুই কন্যার মাসি, নীলাঞ্জনার সহোদরা, অভিনেত্রী অঞ্জনা ভৌমিকের ছোট কন্যা— চন্দনা শর্মা।
আপাত ভাবে সরল সেই পোস্ট ঘিরে শুরু হয়েছিল চর্চা। বিবাহিতা এক নারীর ‘পাশে থাকা’ মানুষের তালিকায় স্বামীর নাম নেই কেন? মেয়েরা তারকা-পিতা যিশু সেনগুপ্তের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন তো? ইত্যাদি ইত্যাদি। সে সবই নীলাঞ্জনার কানে পৌঁছেছে। কোথাও তা নিয়ে উত্তর দিতে শোনা যায়নি। নীলাঞ্জনা বরং যাপন-ভঙ্গি বদলাতে ব্যস্ত থেকেছেন। ইতিমধ্যে নামেও বদল এসেছে। আর সেনগুপ্ত নয়, শর্মা লেখেন নিজের পদবী। পিতৃদত্ত পরিচয়ে নতুন করে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। সমাজমাধ্যমে এখন তিনি নীলাঞ্জনা শর্মা। পাশাপাশি, নতুন জিনিস শিখছেন। ভাবছেন। দেখছেন। এবং মানুষ চিনছেন। ছ’মাস আগে শুরু হওয়া ফিসফাস এখনও ধিকিধিকি করে জ্বলছে। আর তিনি কী করছেন? সকালে উঠে মেথির জল, সাত তাড়াতাড়ি নৈশভোজ, জিম— এ সব করে ব্যস্ত রাখছেন নিজেকে? মোটেই না। আনন্দবাজার অনলাইনকে নীলাঞ্জনা বলেন, ‘‘একটি জিনিস অভ্যাস করছি। যাঁরা বলেন, তাঁদের বলতে দিই। আমি বিচলিত হই না। ঠিক করেছি সমালোচনা নিয়ে ভাবব না।’’ ফলে এর মধ্যে কোনও সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকারও দেননি। বললেন, ‘‘এত দিনে এই প্রথম ঠিক করে ইন্টারভিউ দিচ্ছি!’’
এই পোস্ট ঘিরে শুরু হয় জল্পনা। ছবি: সংগৃহীত।
সময়ের সঙ্গে জীবন বদলাচ্ছে। তার ধারাও তাই বদলে নিয়েছেন নীলাঞ্জনা। তাঁর জীবন এখন কেমন, কী করেন, কী ভাবেন, কার কথা শুনতে ভাল লাগে— আনন্দবাজার অনলাইনকে বদলে যাওয়া সেই জীবনধারার কথাই খোলাখুলি জানালেন।
বিচলিত হবেন না বললেও, তা না হওয়া সহজ যে নয়, সে কথা নীলাঞ্জনার আলাদা করে বলে দিতে হয় না। কথার প্রতি ভাঁজে স্পষ্ট। তবে নীলাঞ্জনা এখন আমেরিকার মনোবিদ-লেখক মেল রবিন্সের ভক্ত হয়েছেন। তাঁর পডকাস্ট শোনেন নিয়মিত। সেখান থেকে একটি কথা শুনে রপ্ত করছেন, ‘লেট দেম’ তত্ত্ব। কী সেটি? মেলের বক্তব্য, কারও কথা বা কাজ পছন্দ না হলে তা নিয়ে বিচলিত হওয়ার দরকার নেই। যদি তাঁরা কখনও দুঃখ দেন, দিতে দিন। যদি তাঁরা আপনাকে বাদ দিয়ে ভাল থাকেন, থাকতে দিন। যে যা করেন, করতে দিন। ‘লেট দেম’! সবটা নিজের হাতের মধ্যে থাকে না। যা নিজের এক্তিয়ারের বাইরে, তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। সেটিই নীলাঞ্জনার নতুন মন্ত্র। তা আগলে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন।
কাজ হয় সেই মন্ত্র জপে? ‘‘অনেকটাই স্বস্তি পাওয়া যায়, যদি ঠিক ভাবে সে মন্ত্র ধারণ করেন,’’ বক্তব্য সদ্য শেষ হওয়া ‘হরগৌরী পাইস হোটেল’-এর প্রযোজক নীলাঞ্জনার।
নিজেকে অস্বস্তিতে থাকার সময় বিশেষ
দেন না। সকাল শুরু করেন ধ্যান করে। তার পর স্নান। পুজো। মাঝে জ়ারাকে স্কুলের জন্য
প্রস্তুত হতে সাহায্য করা। মা হওয়ার দায়িত্ব তো আছেই। বেশ কিছু দিন হল তাঁর বাবা,
অনিল শর্মাও নীলাঞ্জনার সঙ্গে থাকছেন। ফলে বাড়িতে অনেক দায়িত্ব। যথেষ্ট সময় দিতে
হয়। বছর দুই হল নতুন করে নিজের প্রযোজনা সংস্থা ‘নিনি চিনিজ় মাম্মাজ়
প্রোডাকশন’-এর কাজও চালু করেছেন। টেলিভিশনের আর একটি ধারাবাহিক ‘আনন্দী’-র কাজ
চলছে। রোজ অফিস যান ঘড়ি ধরে। মিটিং করেন, শুটেও যান। তবে ওইটুকুই। শুধু কাজ আর
পরিবার। এই ঘেরাটোপে আপাতত বেঁধে নিয়েছেন নিজেকে। বাকি? উত্তর আসে, ‘‘লেট দেম!’’
নিজেকে গুছিয়ে রাখছেন এ ভাবেই।
ঠিক এক বছর হল মা, অঞ্জনা ভৌমিককে হারিয়েছেন নীলাঞ্জনা। ছবি: সংগৃহীত।
এক সময়ে নীলাঞ্জনার বাড়ি গমগম করত তারকা-বন্ধুদের সমাগমে। পুজো, বড়দিন, নতুন বছর, জন্মদিন— উপলক্ষ পেলেই আড্ডা, গান, খাওয়াদাওয়া লেগে থাকত। এখন সে সব ছবি বিশেষ দেখা যায় না। নীলাঞ্জনা বললেন, ‘‘বন্ধু চিনতে শিখছি!’’ কপাল বা ঠোঁটে অবশ্য কোনও ভাঁজ পড়ে না কথা বলার সময়ে। শুধু জানান, আগে যাঁরা কথায় কথায় যাওয়া-আসা করতেন, এখন তাঁদের অনেকেই আর নিমন্ত্রণ করেন না নিজেদের কোনও অনুষ্ঠানে। জীবন বদলায়। তাঁর নতুন যাপন-ভঙ্গি নিয়েই এখন কথা বলায় বিশ্বাস করেন তিনি। পুরনো সব বন্ধু নেই তো কী, সময় তো পাচ্ছেন! তা দিয়ে কী করবেন, ঠিক করছেন। এর আগে সাংসারিক ব্যস্ততায় বহু কাজ করে ওঠা হয়নি।
এত বদলের তো চাপ আছে। সাধারণত বলা হয় মনের উপর চাপ পড়লে তার ছাপ পড়ে চেহারাতে। এত কিছুর মাঝে নিজেকে এত ঝকঝকে, ঝরঝরে, ছিপছিপে রাখেন কী করে? যোগ অভ্যাস করেন নাকি? ‘‘কোনও ধরনের শরীরচর্চা করি না। একদম ভাল লাগে না। এক বার ইন্টার্মিটেন্ট ফাস্টিং করে ওজন কমিয়েছিলাম। তবু জিম যাইনি,’’ বলেন নীলাঞ্জনা। এ বার অবশ্য সাঁতার শিখবেন ঠিক করেছেন।
যিশু সেনগুপ্তের সঙ্গে নীলাঞ্জনার দূরত্ব তৈরি হয়েছে কি? তা নিয়ে শুরু হয় গুঞ্জন। ছবি: সংগৃহীত।
এর আগে সাঁতার শেখার সময় হয়নি? সঙ্গে সঙ্গে উত্তর আসে, ‘‘জলে ভয় আছে। ভয় কাটানোর ইচ্ছা হয়নি এর আগে।’’ বড় কন্যা সারার পরামর্শে এ বার ভয়কে জয় করার প্রস্ততি নিচ্ছেন। সংসার করছেন ৩০-এ পা রাখার আগে থেকেই। তারও অনেক অনেক বছর আগে কাজ শুরু করেন। ৯০-এর দশকের জনপ্রিয় হিন্দি ধারাবাহিক ‘হিপ হিপ হুর্রে’-র মোনা জোশী চরিত্রে অভিনয় করতেন। সেই থেকে পর পর নানা ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন। বাংলা ছবিতেও অভিনয় করেছেন। তার পর সংসার। এ বার মোড় ঘুরছে জীবনের। মেয়ের সঙ্গে এক রকম ট্যাটু করবেন, একা বেড়াতে যাবেন। এখন নিজেকে সময় দেওয়া অভ্যাস করছেন। বলেন, ‘‘মেয়েরা একটু ও রকম হয়, সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে নিজেদের দিকে নজর দিতে ভুলে যায়। আমিও তেমন।’’ ‘‘কখনও একা একা বেড়াতে যাইনি আগে, ভাবতে পারছেন!’’ স্বাধীন-দৃঢ় ভাবভঙ্গির নীলাঞ্জনা বলেন খানিক নিজেকেই অবাক করে। ২০২৩ সালে প্রথম একা বেরোন। পুদুচেরি গিয়েছিলেন। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে নিজের জীবনধারা নিয়ে বহু চিন্তা মনে এসেছে। ২০২৫ নতুন সব কিছুর বছর। জানালেন, এর আগে বেড়াতে গিয়েছেন, আনন্দ করেছেন, বেশিটাই পরিবারের সঙ্গে। এই সময়টা বদলের। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে মা অঞ্জনা ভৌমিকের মৃত্যু তাঁকে নাড়িয়ে দিয়েছে। তার পর থেকে জীবন হঠাৎ নতুন করে ঘটনাবহুল হয়ে উঠেছে। এ বছর বড় কন্যা সারাও পা়ড়ি দিলেন মুম্বই, নিজের কাজের জন্য। বাড়ি আরও একটু খালি হয়ে গেল। জীবনটা নিজের মতো করে সাজাতে তো হবে! ‘‘ঠিক করেছি লেখাপড়াও শুরু করব আবার। এমএ করব, পিএইচডি করব। আমি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী,’’ বলেন নীলাঞ্জনা।
দুই মেয়ে সারা ও জ়ারাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেন নীলাঞ্জনা। ছবি: সংগৃহীত।
অনেকে ভাবেন, মেয়েদের জীবনে একটা সময়ের পর সংসারই পড়ে থাকে। না হলে কিছুই থাকে না। তাঁদের মধ্যে পড়েন না নীলাঞ্জনা। বরং বয়স নিয়ে অবান্তর ভুল ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেন। নতুন করে নিজের প্রযোজনা সংস্থার কাজ শুরু করেছেন বছর দুই আগে, চল্লিশের শেষ প্রান্তে। কুড়িতেই শুরু করতে হবে, ষাটে গিয়ে অবসর নিতে হবে— এ সব তাঁর হিসাবের খাতায় নেই। ২৫ বছর বয়সে মুম্বইয়ে প্রথম ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন। তা ছিল না সে অর্থে বয়সের সঙ্গে মানানসই। আবার ৪০-এর আশপাশে সংসারের প্রয়োজনে বাইরের কাজ একেবারে বন্ধ রেখে ঘর সামলেছেন। সেটিও বয়সোচিত নয় তথাকথিত অর্থে। তখন সাধারণত কর্মজীবন থাকে মধ্যগগনে।
তিনি সে সবের তোয়াক্কা করেন না বলেই জানালেন। যখন যেমন প্রয়োজন, সময়ের দাবি মেনে এগিয়ে চলায় বিশ্বাস রাখেন। হঠাৎ এখন সংখ্যা নিয়ে ভাববেন কেন তবে? বরং সে বিষয়ে কোনও প্রশ্ন উঠলে সটান উত্তর আসে, ‘‘বয়স্ক বানিয়ে দিতে চাইছেন কি?’’ অর্ধশতবর্ষ সকলের এক রকম হয় না। যেমন মুম্বই থেকে এখন ধারাবাহিকে অভিনয়ের সুযোগ আসছে নতুন করে, জানালেন নীলাঞ্জনা। ‘‘না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি চলে গেলে সংসারের সবটা ওলটপালট হবে। মেয়েদেরকে তো আমাকেই দেখতে হবে। মেয়েরাই আগে আমার কাছে। যা করব, ওদের ভালমন্দ বুঝে, তবে,’’ বলেন নীলাঞ্জনা। নিজের মতো করে এ ভাবেই ভাল থাকার চ্যালেঞ্জটা নিয়ে নিয়েছেন ‘নিনিচিনি’জ়মাম্মা’!