কম বয়সে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে তরুণ প্রজন্ম

কলকাতার এক নামী কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সুচেতা ভট্টাচার্য ওই কলেজের আর এক পড়ুয়ার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু কয়েক মাস পরে সে সম্পর্কের ইতি ঘটে। সুচেতা সে দিন বন্ধুদের সঙ্গে ‘ব্রেকআপ পার্টি’ করেন। সিনেমা দেখা, খাওয়া-দাওয়া, ইনস্টাগ্রামে ছবি আপলোড— সবই চলে। হঠাৎ এক দিন কলেজ থেকে ফিরে হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিনি।

Advertisement

তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৭ ০৮:২০
Share:

প্রতীকী ছবি।

দিন কয়েক ধরে মন খারাপ। পরপর তিনটে টেবিল টেনিস ম্যাচে হেরে গিয়েছে বছর সতেরোর অরিত্র দত্ত। কিন্তু ফেসবুকে লাগাতার ‘ফিলিং হ্যাপি’ আপডেট!

Advertisement

পরিচিতদের কাছে ‘সুপার কুল’ ভাবমূর্তিটা ধরে রাখতে হবে যে। তার হেরে যাওয়ার খবর বন্ধু কিংবা বাবা-মা জানতে পারলে যে বদলে যাবে তার সম্পর্কে ধারণাটা। ইতিমধ্যে ফাইনাল পরীক্ষায় ফলও খারাপ হল। হঠাৎ এক রাতে ঠাকুরমার ঘুমের ওষুধ কয়েক মুঠো খেয়ে নিয়েছিল সে। ঠিক সময়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ায় সে যাত্রায় বেঁচে যায় অরিত্র। চিকিৎসক জানালেন, মানসিক অবসাদে থেকেই আত্মহত্যার চেষ্টা করে অরিত্র।

কলকাতার এক নামী কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সুচেতা ভট্টাচার্য ওই কলেজের আর এক পড়ুয়ার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু কয়েক মাস পরে সে সম্পর্কের ইতি ঘটে। সুচেতা সে দিন বন্ধুদের সঙ্গে ‘ব্রেকআপ পার্টি’ করেন। সিনেমা দেখা, খাওয়া-দাওয়া, ইনস্টাগ্রামে ছবি আপলোড— সবই চলে। হঠাৎ এক দিন কলেজ থেকে ফিরে হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিনি। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পরে চিকিৎসক সুচেতার পরিবারকে জানান বেশ কিছু দিন ধরে অবসাদে ভুগছিলেন সুচেতা।

Advertisement

অরিত্র কিংবা সুচেতা ব্যতিক্রম নয়। ২০১৭ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি রিপোর্ট জানায়, বিশ্ব জুড়ে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। এই বয়সের মানুষের মধ্যে মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে আত্মহত্যাকে। ২০২০-র মধ্যে আত্মহত্যাই এই বয়সের ছেলেমেয়েদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে রিপোর্টে। কারণ এই প্রবণতা খুব বেশি হারে বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, এই শহরও ব্যতিক্রম নয়। তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশের এই প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। মনের বিভিন্ন অনুভূতি প্রকাশ করতে না পারায় অবসাদে ভুগছে এই প্রজন্ম। ব্যস্ত জীবনে বাবা-মায়ের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ কমছে। বেশির ভাগ সময় নিজেদের মতো করে কাটাচ্ছে। কিন্তু বন্ধুদের কাছেও সমস্যার কথা বলতে পারছে না। সমস্যার কথা জানালে দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যাবে, সেই ভয় কাজ করছে। কোনও কাজে যে বিফলও হতে হয়, তারা তা মানতে পারছে না। মনোরোগ বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য এ জন্য অতিরিক্ত প্রতিযোগী মনোভাবকে দায়ী করছেন। সব বিষয়ে প্রথম হওয়ার মানসিকতা আরও সমস্যা বাড়াচ্ছে। তাঁদের মতে, সন্তান মানসিক অবসাদে ভুগছেন কি না, তার হদিস সকলের আগে পেতে পারেন বাবা-মা। তাঁরা একটু খেয়াল করলে এ ধরনের সমস্যা এড়ানো সহজ হবে।

কী ভাবে বুঝবেন সন্তান মানসিক অবসাদে ভুগছে কি না?

বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, সন্তান যদি স্কুল থেকে ফিরে চুপ করে থাকে এবং একা ঘরে সময় কাটায়, তা হলে বুঝতে হবে কোনও সমস্যা হয়েছে। খেয়াল করা দরকার সকলের সঙ্গে খোলামেলা মিশছে না কি, আত্মীয়-পড়শিদের এড়িয়ে চলছে সন্তান। পাশাপাশি, স্কুলের পরীক্ষার ফলের দিকেও নজর রাখা জরুরি। কারণ মন ভাল না থাকলে কোনও কাজেই যথাযথ ফল মিলবে না।

এই প্রসঙ্গে মনোবিদ সঞ্জয় গর্গ বলেন, ‘‘ছোট থেকে সন্তানের সব আবদার মেনে নেওয়া ঠিক নয়। সব চাহিদা মিটবে না, তাদের এটা শেখা জরুরি। পাশাপাশি, দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। দরকার হলে বাড়ির কিছু দায়িত্ব তাদের দিতে হবে। দায়িত্ব নিতে শিখলে জীবনের প্রতি দায়িত্ববোধও তৈরি হবে।’’ পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বলেন, ‘‘গত ১৫ বছরে ছেলেমেয়েদের বড় হওয়ার পরিবর্তন ঘটলেও অভিভাবকত্বে পরিবর্তন ঘটেনি। অধিকাংশ ছেলেমেয়ে হাতের কাছে সব পেয়ে যায়। ফলে কঠিন পরিস্থিতিতে সে লড়াই করতে শিখছে না। সন্তানকে কতটা স্বাচ্ছন্দ্য দিতে হবে, অভিভাবকদের শেখা জরুরি।’’

মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল বলেন, ‘‘হতাশা বাড়ছে, তাই বাড়ছে আত্মহত্যা প্রবণতা। প্রত্যাশা এমন একটা জায়গায় পৌঁছচ্ছে যে, তা মিটছে না। সন্তানদের কৃত্রিম মোড়কে না রেখে বাস্তবটা চেনাতে হবে। না পাওয়ার যন্ত্রণাটাও পাওয়া দরকার। যাতে তারা ধৈর্য ধরতে শেখে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন