herd immunity

হার্ড ইমিউনিটি-ই কি করোনার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে আমাদের?

করোনার বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে কি হবে না।

Advertisement

সুজাতা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ মে ২০২০ ১০:০০
Share:

হার্ড ইমিউনিটির উপর ভরসা খুঁজছে বিশ্ব। ছবি: পিটিআই।

হার্ড কথার অর্থ হল জনগোষ্ঠী। আর ইমিউনিটি হল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। সমাজের বেশির ভাগ মানুষের শরীরে যখন কোনও বিশেষ জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা তৈরি হয়ে যায়, হয় টিকা নিয়ে, নয়তো জীবাণু সংক্রমণের মাধ্যমে, আর তার সুবিধে পেতে শুরু করেন বাকিরাও, তাকেই বলে হার্ড ইমিউনিটি।

Advertisement

ধরুন, আপনি টিকা নেননি, সংক্রমণও হয়নি আপনার, কিন্তু আপনার আশপাশে যাঁরা আছেন তাঁরা এই পদ্ধতির মধ্যে কোনও একটার মাধ্যমে ইমিউনড, তা হলে আপনি ইমিউনড না হওয়া সত্ত্বেও আপনার সংক্রমণ হবে না। বা যদি বাইরে অন্য কারও থেকে সংক্রমণ নিয়ে আসেন, আপনার রোগ হতে পারে, কিন্তু যাঁরা আপনার সঙ্গে ওঠবোস করেন, তাঁদের মধ্যে তা ছড়াতে পারবে না। অর্থাৎ, একের থেকে অন্যের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ানোর শৃঙ্খল ভেঙে যাবে। কমবে রোগের প্রকোপ। ইতি হবে মহামারির। যেমন হয়েছে বসন্ত, হাম, মাম্পস, পোলিও ইত্যাদির ক্ষেত্রে। সমাজের বেশির ভাগ মানুষ টিকা নিয়েছেন। যাঁরা নেননি, তাঁরাও নিরাপদ রয়েছেন অন্যদের দৌলতে। হার্ড ইমিউনিটির দৌলতে।

এ বার তা হলে প্রশ্ন, করোনার বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে কি হবে না। করোনার টিকা এখনও নেই। কাজেই হার্ড ইমিউনিটি হতে হলে, তাকে আসতে হবে সংক্রমণের পথ ধরেই। সেটা কি ঠিক না ঠিক নয়, সেই প্রসঙ্গে এখন দ্বিধাবিভক্ত চিকিৎসক সমাজ। কেউ মনে করছেন যে কোনও মূল্যে সংক্রমণ ঠেকাতে হবে, না হলে ঘোর বিপদ। কেউ ভাবছেন, টিকা যখন নেই, তা হলে এ ভাবে যদি মানুষ বাঁচতে পারেন, তো বাঁচুন না। এই সব ভাবনার মূলে ইন্ধন জুগিয়েছে সুইডেন, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ইটালি। আসুন সেই চিত্রগুলি এক বার দেখে নেওয়া যাক।

Advertisement

আরও পড়ুন: বিবর্তিত হতে হতে করোনা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে, বলছে গবেষণা

হার্ড ইমিউনিটিকেই কোভিডের বিরুদ্ধে অস্ত্র করতে চাইছে গোটা দেশ।

পথপ্রদর্শক সুইডেন

সচেতন ভাবে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করার রাস্তায় হেঁটেছে সুইডেন। করোনা ঠেকাতে সারা পৃথিবী যখন লকডাউনের পথ বেছে নিয়েছে, ব্যতিক্রম সুইডেন। অফিস-কাছারি থেকে শুরু করে রেস্তরাঁ, পাব, সিনেমা হল, খোলা রয়েছে সব। কারণ তাঁরা চান, মানুষে মানুষে মেলামেশা হোক। রোগ ছড়াক সুস্থ-সবল-তরতাজা মানুষের মধ্যে। শুধু ঘিরে দিয়েছেন কেয়ার হোমের চারপাশ, অর্থাৎ যেখানে বয়স্ক মানুষেরা থাকেন। বিশেষ সাবধানতা নিয়েছেন রুগ্ণ ও প্রতিরোধক্ষমতা কম এমন মানুষদের জন্য।

শুরু থেকে এক নিয়ম। যার ফলে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা থেমে নেই। ১৯ এপ্রিল, ২০২০-তে সে দেশে আক্রান্ত হয়েছেন ১৩,৮২২ জন, মারা গিয়েছেন ১.৫১১ জন। ৮ মে পর্যন্ত আক্রান্ত ২৪৬২৫, মৃত ৩০৪০। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূল স্থপতি চিকিৎসক অ্যান্ডারস টেগনেল বলছেন, “সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, কিছু মানুষ মারা যাচ্ছেন, কিন্তু তার মানে এই নয় যে লকডাউন না করার সিদ্ধান্ত ভুল। আমরা সন্দেহভাজন প্রতিটি মানুষকে ধরে ধরে পরীক্ষা করেছি। আলাদা রেখেছি। চিকিৎসা দিয়েছি। তাতে ভাল কাজ হয়েছে। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ইস্টারে বাড়লেও এখন কমছে। কেয়ার হোমে থাকা বয়স্কদের আরও বেশি নিরাপত্তা দেওয়া গেলে মৃত্যুহার আরও কমত। আমরা আপাতত সেই চেষ্টায় আছি। কমবয়সিদের নিষেধ করা হয়েছে যাতে সমস্যা না কমা পর্যন্ত বয়স্কদের সঙ্গে দেখা না করেন। এর পাশাপাশি আমরা আশা করছি সামনের মাসের মধ্যেই স্টকহলমের বেশ কিছু অংশে, যেখানে রোগ বেশি হয়েছে, হার্ড ইমিউনিটি পুরোদস্তুর তৈরি হয়ে যাবে।”

হার্ড ইমিউনিটির এই তত্ত্বে ঘরে-বাইরে সমালোচিত হয়েছেন টেগনেল। সমালোচিত হয়েছে সুইডেন। হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পও। কিন্তু তাতে পিছু হটেননি তাঁরা।

“পিছু হটার তো প্রশ্ন আসে না,” জানালেন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী। “রীতিমতো হিসেবনিকেশ করে, আটঘাট বেঁধে কাজে নেমেছেন তাঁরা। তাঁরা জানেন কত জন অসুস্থ হতে পারেন, কত জন মারা যেতে পারেন আর কত জন সেরে উঠবেন। চিকিৎসা পরিষেবা ঢেলে সাজা হয়েছে। যাঁদের রোগ হলে বিপদের আশঙ্কা বেশি, তাঁদের ঘিরে রেখেছেন নিশ্ছিদ্র সুরক্ষা বলয়ে। এত কিছু করার পর একটা রিস্ক নিয়েছেন। হিসেবনিকেশ করে নেওয়া রিস্ক, যাতে জিতে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।”

আরও পড়ুন: উপসর্গ কমলে টেস্ট ছাড়াই হাসপাতাল থেকে ছুটি, বিতর্কে নতুন কেন্দ্রীয় নিয়ম

সুইডেনের মডেলে আমরা চলতে পারি?

জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী জানিয়েছেন, “সুইডেনে ৪.৫ লক্ষ বর্গ কিমিতে থাকেন এক কোটি মানুষ, আর পশ্চিমবঙ্গে ৮৮ হাজার বর্গ কিমিতে ৯ কোটি। লকডাউনের অর্থ তো সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও একসঙ্গে প্রচুর রোগীর চাপ ঠেকানো, সচেতন থাকলে ও সব দেশে তা এমনিই হয়ে যায়। আমাদের ১৩০ কোটির দেশে এ মডেল চলে কখনও! এ তো হাম বা মাম্পস নয় যে সংক্রমণ হলেও প্রাণ নিয়ে টানাটানি নেই। কোভিডে সংক্রমণ করিয়ে হার্ড ইমিউনিটি আনতে গেলে কম করে দু-কোটি মানুষ মারা যেতে পারেন। অপরিকল্পিত ভাবে হার্ড ইমিউনিটির কথা ভেবে ইংল্যান্ড, ইটালি, আমেরিকাতে কী হল তা তো সারা পৃথিবী দেখছে। আমাদের দেশের অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে।”

কতটা ভয়াবহ হতে পারে, আসুন সে হিসেব দেখে নেওয়া যাক। হার্ড ইমিউনিটি থ্রেসহোল্ড বলে একটি সূচক আছে। যার অর্থ হল মহামারি কমাতে গেলে কত জন মানুষের মধ্যে সেই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তথা জোরদার অ্যান্টিবডি তৈরি হতে হবে। মাম্পসের ক্ষেত্রে যেমন ৯২ জনের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ গড়ে উঠলে বাকি ৮ জন নিরাপদ। কোভিড ১৯-এর হার্ড ইমিউনিটি থ্রেসহোল্ড এখনও পর্যন্ত যা বোঝা গিয়েছে তা হল ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ সমাজের ৭০ শতাংশ মানুষের রোগ হয়ে সেরে যাওয়ার পর শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি হলে বাকি ৩০ শতাংশ মানুষের নিরাপদ থাকার সম্ভাবনা আছে। ১৩০ কোটির ৭০ শতাংশ এক বিশাল সংখ্যা। এ বার তাঁদের মধ্যে কম করে ১০ শতাংশকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে, যার সংস্থান আমাদের দেশে নেই। মারা যাবেন কম করে দু-কোটি মানুষ। তার পর এত প্রাণের বিনিময়ে ক’দিনের সুরক্ষা পাওয়া যাবে?

করোনার বিরুদ্ধে গবেষণায় রত গোটা বিশ্ব।

ক’দিনের সুরক্ষা মিলতে পারে?

২০০২-’০৩ সালে সার্স মহামারিতে যাঁরা আক্রান্ত হয়ে সেরে উঠেছিলেন, তাঁদের শরীরে ওই রোগের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তথা ইমিউনিটি কার্যকর ছিল বছর তিনেক। সার্স ভাইরাস যেহেতু করোনা পরিবারেরই সদস্য, তাই খুশি হয়েছিলেন অনেকে। বছর তিনেকের মধ্যে নিশ্চয়ই প্রতিষেধক তৈরি হয়ে যাবে। ফলে পুরো জনগোষ্ঠীর না হলেও, যাঁদের যাঁদের রোগ হচ্ছে, তাঁরা অন্তত নিশ্চিন্ত থাকবেন বছর তিনেক। তার উপর কানে আসছিল আরও কিছু খবর, যেমন—

• ভ্যাকসিন ও স্বাভাবিক উপায়ে নরওয়েতে সোয়াইন ফ্লু অর্থাৎ এইচ১এন১ ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের শরীরে আংশিক ইমিউনিটি তৈরি হয়েছে, যাকে বিজ্ঞানীরা বলছেন পার্শিয়াল হার্ড ইমিউনিটি।

• এই একই কারণে ২০১০-’১১ সালে নরওয়েতে ফ্লু-তে মৃত্যুহার অনেক কমেছে।

এই সব খবরাখবর শুনে সবাই ভাবছিলেন, জলবসন্ত, হাম, মাম্পস বা পোলিও-র মতো জীবনভর না হলেও, দু-চার বছর অন্তত নভেল করোনার হাত এড়িয়ে সুরক্ষিত থাকা যাবে। কিন্তু সে আশায় ছাই দিয়ে একের পর এক দুঃসংবাদ আসতে লাগল। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চের সংক্রামক রোগ বিভাগের প্রধান জানালেন, “চিন, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে এমন বেশ কিছু রোগীর খবর এসেছে, যাঁরা সেরে যাওয়ার পর আবার নতুন করে রোগে পড়েছেন। দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রায় ১৫০ জনের হয়েছে এমন। হয়েছে আমাদের দেশেও। হিমাচল প্রদেশের উনা জেলায়। সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই ফের উপসর্গ এবং রিপোর্ট পজিটিভ।”

অর্থাৎ?

সুবর্ণ গোস্বামী জানালেন, “করোনা ভাইরাসের এখনও পর্যন্ত ২৯টি টাইপের কথা জানা গিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিমান বন্ধ বলে আপাতত আমাদের দেশে রোগ হচ্ছে দু-তিনটি টাইপ থেকেই। এক বার একটা টাইপ দিয়ে রোগ হওয়ার পর পরের বার যদি অন্য টাইপের ভাইরাস দিয়ে হয়, তা হলে আগের ইমিউনিটি তো কাজ করবে না। বরং রোগ আরও জটিল রূপে আসবে, যার কারণ ডাক্তারি পরিভাষায় এনহান্সড অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডি রিঅ্যাকশন। সহজ কথায় বলতে গেলে, আগের বার তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি খুব বেশি লড়াই করতে গিয়েই বিপদে ফেলবে শরীরকে। তবে সব সময় তো আর নতুন টাইপের ভাইরাসই আক্রমণ করবে, এমন নয়। সে ক্ষেত্রে এক বার সংক্রমণের পর অবশ্যই কিছু দিন সুরক্ষা পাওয়া যাবে।”

আরও পড়ুন: ভাইরাস ভয় ভাঙতে ছোঁয়াচে হোক শিল্প

কারা সুরক্ষা পাবেন, কারা নয়?

অমিতাভ নন্দী বললেন, “নতুন ভাইরাস সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হয়ে কিছু বলা যায় না। তবে যেহেতু যে কোনও আরএনএ ভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে গেলে কম-বেশি সপ্তাহ তিনেক সময় লাগে, মনে হয়, যাঁদের সংক্রমণ একটু হালকা ধাঁচের হয় ও উপসর্গ হতে হতে বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে যায়, অর্থাৎ যত লম্বা হয় ইনকিউবেশন পিরিয়ড, দ্বিতীয় বার রোগে পড়ার আশঙ্কা থাকে তত কম থাকে। তবে যাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, যেমন বয়স্ক মানুষেরা, তাঁরা এই সুবিধে পান না সব সময়।”

এই ভাইরাস তো মিউটেট করছে ঘন ঘন। তখনও কি হার্ড ইমিউনিটি হবে?

অমিতাভবাবু বলছেন, ‘‘হবে। পার্শিয়াল হার্ড ইমিউনিটি হবে। কারণ, ভাইরাস তো ১০০ শতাংশ পাল্টাবে না নিজেকে। কাজেই অ্যান্টিবডি তাকে পুরো না চিনলেও তার চেনা চেনা ঠেকবে। ফলে সে লড়বে ঠিক। হয়তো শেষ পর্যন্ত সামলাতে পারবে না। রোগ হবে, তবে সে হবে অনেক মৃদু। সাধারণ স্বাস্থ্য ভাল থাকলে হয়তো কখন হল আর কখন সেরে গেল, তা টেরও পাওয়া যাবে না।”

অর্থাৎ, জলবসন্ত, হাম, পোলিও বা মাম্পসের মতো জীবনভর পুরোপুরি সুরক্ষা না পেলেও কিছুটা প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মাবে আমাদেরও, যাকে চিকিৎসকরা বলছেন পার্শিয়াল হার্ড ইমিউনিটি। সুইডেনে যা হচ্ছে বিস্তর হিসেবনিকেশ করে, আমাদের হবে নিজের নিয়মে। সময়ের সঙ্গে।

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন