ঠিক কোন-কোন উপসর্গ থাকলে সোয়াইন ফ্লু পরীক্ষার জন্য রোগীর থুতুর নমুনা সংগ্রহ করা হবে তা নিয়ে বিভ্রান্তি ছিলই। এ বার নতুন বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে এইচ১এন১-এর প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন নিয়ে।
সোয়াইন ফ্লু প্রতিরোধে এই ভ্যাকসিন দেওয়া উচিত কিনা এবং দিলে কাদের দেওয়া উচিত তা নিয়ে চিকিৎসকেরাই দ্বিধাবিভক্ত। দ্বিমত রয়েছে স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরেও। স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষ কর্তারা জানিয়েছেন, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ওই ভ্যাকসিন দেওয়া হবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ দিকে, বেলেঘাটা আইডি হাসপাতাল ইতিমধ্যে ট্রেজারি থেকে টাকা চেয়ে নিয়ে প্রায় ২০০ সোয়াইন ফ্লু প্রতিষেধক বাজার থেকে কিনে নিয়েছে। সেগুলি চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের দেওয়া হয়েছে। সেখানকার কর্তৃপক্ষের যুক্তি, “আমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমরাই করে নিয়েছি।” স্বাস্থ্যকর্তারা যা শুনে বলছেন, “ওরা ওদের মতো কিনেছে। স্বাস্থ্য দফতর এর জন্য আলাদা করে ওদের টাকা দেয়নি।”
সোয়াইন ফ্লুয়ের প্রতিষেধক নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে দ্বিমতের ফলে সবচেয়ে বেশি দিশেহারা হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এত দিন বাজারে এই প্রতিষেধক পাওয়া যাচ্ছিল না। গত দু’ সপ্তাহ ধরে বাজারে একাধিক সংস্থার প্রতিষেধক পাওয়া যাচ্ছে। প্রত্যেক সংস্থাই দাবি করছে, তাদের তৈরি প্রতিষেধকে অন্তত এক বছর সোয়াইন ফ্লু আটকাবে। এই প্রতিষেধকের দাম পড়ছে ৭০০-১০০০ টাকার মধ্যে।
কিছু চিকিৎসক মনে করছেন, কিছুটা হলেও এই প্রতিষেধকে রোগ আটকাবে, তাই তাঁরা নিজেরাই রোগীদের বিশেষত সর্দি-কাশি-শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসা শিশুদের এই প্রতিষেধক দেওয়ার সুপারিশ করছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ের জ্বর-সর্দি হলেই মা-বাবা উদ্বিগ্ন হয়ে নিজেরাই চিকিৎসককে প্রতিষেধক দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। অনেক প্রাপ্তবয়স্কককেও এই প্রতিষেধক দেওয়া হচ্ছে।
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর অবশ্য পুরোপুরি প্রতিষেধকের বিরুদ্ধে। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী শনিবার বলেন, “এই ধরনের ভ্যাকসিন কতটা কার্যকর জানা নেই। ফলে এটা দিলেই সোয়াইন ফ্লু হবে না এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই।” তাঁর কথায়, “ভ্যাকসিন দেওয়ার পরে শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হতেও তিন সপ্তাহ লেগে যায়। তখনও মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। আমরা কাউকে ভ্যাকসিন দেব না।”
এ দিকে দিল্লিতে ‘ইন্টিগ্রেটেড ডিজিজ সার্ভিলেন্স প্রোগ্রাম’-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার প্রদীপ খাসনবীশ বলেন, “বিভিন্ন রাজ্যে সরকারি হাসপাতালে যে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীরা সোয়াইন ফ্লুয়ের রোগীদের চিকিৎসা করছেন তাঁদের জন্য আমরা ভ্যাকসিন পাঠাচ্ছি।” এ ব্যাপারে বিশ্বরঞ্জনবাবুর জবাব, “আমাদের কিছু পাঠানোও হয়নি, জানানোও হয়নি।”
তবে বিসি রায় শিশু হাসপাতাল, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, বেলেঘাটা আইডি-সহ একাধিক সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের একাংশ সোয়াইন ফ্লুয়ের প্রতিষেধক না পেয়ে ক্ষুব্ধ। যাঁদের প্রতি দিন সরাসরি সোয়াইন ফ্লু রোগীদের দেখতে হচ্ছে বা সেই সব ওয়ার্ডে কাজ করতে হচ্ছে তাঁরা অনেকেই আতঙ্কিত। ক্ষুব্ধ স্বাস্থ্যকর্মীরা অভিযোগ করেছেন, “টাকা বাঁচাতে দফতর প্রতিষেধক কিনতে চাইছে না এবং কর্মীদের সুরক্ষার ব্যবস্থাও হচ্ছে না।”
সোয়াইন ফ্লুয়ের প্রতিষেধক নিয়ে বিভিন্ন চিকিৎসক বিভিন্ন মত দিয়েছেন। শিশু বিশেষজ্ঞ অপূর্ব ঘোষ যেমন জানান, ৬ মাসের উপরের শিশুদের বছরে এক বার এই প্রতিষেধক দেওয়াই যায়। তাতে সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার সঙ্গে সোয়াইন ফ্লু-ও অনেকটা আটকানো যায়। পরজীবী বিশেষজ্ঞ অমিয় হাটি-রও মত, শিশু-প্রাপ্তবয়স্ক নির্বিশেষে এই প্রতিষেধক দেওয়া যেতে পারে।
তাঁর কথায়, “এতে বিশেষ করে ফুসফুস-হৃদযন্ত্রের অসুখে ভোগা রোগী, ডায়াবেটিসের রোগী, অপুষ্টি এবং শ্বাসকষ্টের রোগী, মহিলা-শিশু-বয়স্করা সোয়াইন ফ্লু থেকে অনেকটা বাঁচবেন। এঁদের সোয়াইন ফ্লু হলে সাধারণত সেটা মারাত্মক হতে পারে।” ভাইরোলজিস্ট নিমাই ভট্টাচার্যের আবার মত, সোয়াইন ফ্লু আটকাতে প্রতিষেধক খুব একটা প্রয়োজনীয় নয়। বরং বার-বার সাবান দিয়ে হাত ধোওয়া, মুখ ঢেকে হাঁচি কাশি বা আক্রান্তের সংস্পর্শ বাঁচিয়ে চললে অনেক বেশি রোগ এড়ানো যায়।
প্রতিষেধক নিয়ে এই বিতর্কের মধ্যেই শনিবার নতুন করে ২১ জনের দেহে সোয়াইন ফ্লু পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে ৫টি শিশু রয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে ১২ জন কলকাতার বাসিন্দা। বাকিরা যথাক্রমে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হুগলি, হাওড়া ও পূর্ব মেদিনীপুরের।
অসমে আক্রান্ত বেড়ে ২১
অসমে সোয়াইন ফ্লু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ২১। এ পর্যন্ত গুয়াহাটি মেডিক্যাল কলেজ ও ডিব্রুগড়ের আরএমআরসিতে ৮০ জনের নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এদের মধ্যে ২১ জনের নমুনায় এইচ১এন১ থাকার প্রমাণ মিলেছে। আজ গোলাঘাটে দুই সিআরপিএফ জওয়ান এই রোগের লক্ষ্মণ-সহ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। অন্য দিকে, মণিপুরে সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্তের সংখ্যা এখনও অবধি দুই। মিজোরাম থেকেও ১০ জনের লালা-কফের নমুনা কলকাতায় পাঠানো হয়েছিল। রিপোর্ট বলছে, এদের মধ্যে ৪ জনের দেহে সোয়াইন ফ্লু সংক্রমণ রয়েছে।