Suicidal Tendency in Indian Society

আত্মহত্যা এক নীরব মহামারি, শুধু এক বার বলা, ‘আমি তোকে বুঝি’ কথাটুকুই কারও জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে

আত্মহত্যা প্রতিরোধের পথ একটাই— খোলা মন, সহানুভূতি এবং পেশাদারের সাহায্য নেওয়া। আমাদের স্কুল, কলেজ, পরিবারে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা উচিত।

Advertisement

গার্গী দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০২৫ ১৭:০১
Share:

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম। গ্রাফিক সহায়তা: এআই।

ভারতের একটা ছোট শহরের কথা দিয়ে শুরু করি। কোটা। রাজস্থানের একটা শহর। সেখানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছাত্রছাত্রীরা পড়তে যান। পড়তে যাওয়া বলতে কোনও স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষার কোচিং নিতে।

Advertisement

কোটা শহরে কত পড়ুয়া যান বা কত কোচিং সেন্টার আছে, সে পরিসংখ্যানে না গিয়ে অন্য একটা হিসাব দিই। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাসের শুরু পর্যন্ত ১৪ জন পড়ুয়া কোটায় আত্মহত্যা করেছেন। সংখ্যাটা ঠিকই পড়ছেন, ১৪। গত বছর সংখ্যাটা ছিল ১৭। তার আগের বছর, তারও আগের বছরেও এই সংখ্যাটা কম ছিল না। পড়ুয়াদের আত্মহত্যার কারণ নিয়ে অনেকে বলেন, ‘অপূর্ণ প্রত্যাশা’, অনেকে বলেন ‘প্রত্যাশার চাপ’, কেউ কেউ আবার বলে থাকেন, পড়াশোনা চাপ নিতে না-পারার কারণই এই আত্মহত্যা। আসলে হতাশা!

আমাদের সমাজে একটা অংশের মানুষ মনে করেন, মৃত্যুতেই সব সমস্যার সমাধান লুকিয়ে আছে। সেই মতাদর্শীদের অনেকে তাই আত্মহননের পথ বেছে নেন। তাঁরা বুঝতে পারেন না, এটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এক মুহূর্তের হতাশার ফল। আদতে ‘আত্মহত্যা’ শব্দটি যতটাই সরল, ঠিক ততটাই জটিল ‘গল্প’ অন্তর্নিহিত এর ভিতরে। এর মধ্যে রয়েছে থমকে যাওয়া ভবিষ্যৎ। শুধু তা-ই নয়, এর মধ্যে রয়েছে আত্মহত্যার পর পড়ে থাকা ছিন্নভিন্ন পরিবার। ফলে আত্মহত্যা শুধু ব্যক্তি নয়, গোটা সমাজের জন্য গভীর সঙ্কট হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Advertisement

বছর তিনেক আগের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)-র তথ্য বলেছিল, ২০২২ সালে দেশে প্রতি দিন গড়ে ৪৬৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। বছরের হিসাব সাধারণ পাটিগণিতে ফেলে দেখবেন, সেই সংখ্যাটা ছুঁয়ে ফেলেছে ১.৭১ লক্ষেরও বেশি। ভাবা যায়! কিন্তু এই সংখ্যার চেয়েও বেশি ‘শূন্যতা’ এই মৃত্যুগুলি রেখে গিয়েছে। অথচ আমরা এ বিষয়ে মুখ বন্ধই রাখি প্রায়। আত্মহত্যা নিয়ে সমাজে এখনও নানা কুসংস্কার, ভুল ধারণা এবং ভয়।

মাস দুয়েক আগে ভরদুপুরে নিউ টাউনের একটি বহুতলের ছ’তলা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত এক যুবক। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। এমন ঘটনা শুধু এই শহরে নয়, দেশের নানা প্রান্তে প্রতিনিয়ত হয়ে চলেছে। কলকাতা শহরে আত্মহননের আলাদা মাধ্যম হয়েছে—কলকাতা মেট্রো।

তবে আমার কাছে ইদানীং আরও উদ্বেগের বিষয় কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়া। পড়াশোনার চাপ, পারিবারিক প্রত্যাশা, প্রেম-ভালবাসায় ছ্যাঁকা, অনলাইন বুলিং— সব মিলে তারা একটা মানসিক ভার বহন করতে থাকে। যা অনেক সময় অসহনীয় হয়ে যায়। মানসিক ভাবে প্রস্তুত না-থাকা, আবেগ সংক্রান্ত বিভ্রান্তি (ইমোশনাল কনফিউশন) এবং নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে না-পারার কারণে অনেক সময়েই কিশোর-কিশোরীরা নিজেদের গুটিয়ে ফেলে। বহু সময় তারা পরিবারের অজান্তেই অবসাদে ডুবে যায়। কিন্তু আমরা বড়রা বেশির ভাগ সময়েই কিশোর-কিশোরীদের সমস্যাগুলোকে ছোট করে দেখি। ভুলে যাই যে, কারও মনে আত্মহত্যার ভাবনা এলে তাকে নিছক ‘মনখারাপ’ বলে উড়িয়ে দেওয়া অনুচিত।

আত্মহত্যার কারণ কিন্তু সব সময়ে একরকম নয়। কখনও তা মানসিক রোগের ফল। যেমন অবসাদ (ডিপ্রেশন), বাইপোলার ডিজ়অর্ডার বা স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া। অনেকে পারিবারিক সমস্যার চাপে পড়ে জীবনকে অর্থহীন ভাবেন। শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে পরীক্ষার চাপ, ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা, সামাজিক প্রত্যাশা তাদের আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দেয়। আরও উদ্বেগের বিষয়, দেশের প্রথম সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতেই আত্মহত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশি। যে বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিক্যাল কলেজগুলি আমাদের ভবিষ্যৎ তৈরি করে, সেখানেই এখন সবচেয়ে বেশি তরুণ-তরুণী নিজেদের জীবন হারিয়ে ফেলছেন হতাশা আর নিঃসঙ্গতার অন্ধকারে। সাফল্যের চাপ, সামাজিক প্রত্যাশা এবং আত্মপরিচয় নিয়ে দ্বন্দ্ব— এই তিনটি কারণেই অনেক কিশোর ও তরুণ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। বিশেষত, কৈশোর এবং বয়ঃসন্ধির পর্বে তাদের মনে অনেক প্রশ্ন থাকে যার উত্তর আমরা বড়রা দিতে পারি না।

বেকারত্ব এবং আর্থিক সমস্যাও কিন্তু এখন আত্মহত্যার অন্যতম কারণ। দৈনিক মজুরির শ্রমিক, কৃষক, এমনকি। শহুরে শিক্ষিত যুবকেরাও যখন দীর্ঘ সময় ধরে কাজ খুঁজে পান না অথবা তাঁদের স্বপ্নভঙ্গ হয়, তখন তাঁদের মধ্যে হাল ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। ২০২২ সালের এনসিআরবি-র ওই রিপোর্ট বলছে, আত্মহত্যাকারীদের সবচেয়ে বড় অংশ দৈনিক শ্রমজীবী মানুষ।

অথচ, আমরা এখনও আত্মহত্যাকে ‘দুর্বলতার লক্ষণ’ বলে অপমান করি। কেউ যদি বলেন, তাঁর আর ভাল লাগছে না! বাঁচতে ইচ্ছে করছে না’’, তখন আমরা বলি, ‘‘ও সব ভাবা বন্ধ করো। এত ড্রামা কোরো না।’’ এই বাক্যগুলো কখনও কখনও একটা জীবনকে শেষ ধাক্কাটা দিয়ে অতল খাদে ফেলে দেয়। যেখান থেকে আর উঠে আসা যায় না।

আমরা বুঝতে চাই না যে, মানসিক অসুস্থতাও শারীরিক রোগের মতোই। কেউ আত্মহত্যার চিন্তা করলেই ‘দুর্বল’ হয়ে যান না। এটা একটা মানসিক বিপর্যয় (সাইকোলজিক্যাল ব্রেকডাউন)। এবং এটা সম্পূর্ণ প্রতিরোধযোগ্য। সময় মতো সাহায্য করা গেলে আত্মহত্যা রুখে দেওয়া যায়।

আত্মহত্যা রোখার পথ খোলা মন, সহানুভূতি এবং পেশাদারি সাহায্য। স্কুল, কলেজ এবং পরিবারে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আরও সচেতনতা গড়ে তোলা উচিত। কিশোর-কিশোরীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা বাধ্যতামূলক করা দরকার। কাউকে হতাশ বা চুপচাপ দেখলে যাতে তার পাশে দাঁড়ানো যায়। যাতে বোঝা যায়, সে ভাল নেই। যাতে জানতে চাওয়া যায়, কেমন আছিস? মন ভাল আছে? এই সামান্য প্রশ্নও অনেক সময় কারও জীবন ফিরিয়ে আনতে পারে।

আত্মহত্যা প্রতিরোধে সহায়তার জন্য বিভিন্ন হেল্পলাইন নম্বর রয়েছে। কিন্তু আমরা অনেকেই সেই নম্বরগুলো জানি না। জানলেও লজ্জা পাই ফোন করতে। এই লজ্জা আমাদের শিক্ষায়, সংস্কারে ঢুকে বসে আছে। আত্মহত্যা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা, সংবাদমাধ্যম ও স্কুলে মনোবিদদের যুক্ত করা এবং পরামর্শ পরিষেবা সহজলভ্য করা ছাড়া উপায় নেই। আত্মহত্যা নিয়ে চুপ করে থাকা নয়, বরং এ নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা জরুরি। অনেকেই ভাবেন, আত্মহত্যা নিয়ে কথা না-বললেই সমস্যা মিটে যায়। সমস্যা কমে যায়। ভুল ভাবেন। আত্মহত্যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুধু একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা মনোবিদের কাজ নয়। এটা আমাদের সকলের দায়িত্ব। আজ যারা বেঁচে আছেন, হয়তো কাল তাঁরাই ভাববেন, ‘‘আর পারছি না!’’ তখন যেন আমরা পাশে থাকি। একটা ফোন, একটা আলোচনার জায়গা কিংবা শুধু এক বার বলা, আমি তোকে বুঝি! এই কথাটুকুই কাউকে বাঁচিয়ে দিতে পারে।

আত্মহত্যা সমাধান নয়। কথা বলুন, শুনুন, সাহায্য করুন। প্রতিটি জীবন অমূল্য। পরীক্ষায় ভাল নম্বর দরকার ঠিকই। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের প্রয়োজন মুক্তি, কথা বলার জায়গা, ব্যর্থ হওয়ার স্বাধীনতা আর সবচেয়ে বড় জিনিস— বাঁচার অধিকার।

(লেখক মনোবিদ। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে কর্মরত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement