নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানাতে টুকরো একটি ভিডিও। সাবেক প্রজেক্টরে ঘড়ঘড়িয়ে ঘুরতে ঘুরতে ফিল্মের রিল থিতু হল নির্দিষ্ট ফ্রেমে। যেন কোনও সিনেমা শুরু হচ্ছে। ৪, ৩, ২, ১ করে ‘কাউন্টডাউন’ শেষে বার্তা, ‘ছবির মতো শুরু হোক ২০১৬’! একটি বিজ্ঞাপন নির্মাতা সংস্থার উদ্যোগে শুভানুধ্যায়ীদের কাছে হোয়াট্স অ্যাপ মারফত পৌঁছে যাচ্ছে নতুন বছরের সম্ভাষণ।
কিংবা ধরা যাক পরপর শটে ঝপাঝপ মাথা তুলছে সারি-সারি ‘ক্রিসমাস ট্রি’। আবহে ক্রিসমাস ক্যারল। বড়দিন উপলক্ষে এই শুভেচ্ছা-ছবির সঙ্গে বার্তা, ‘আরও গাছ লাগান’। কলকাতার একটি রিয়েলএস্টেট সংস্থার উদ্যোগ।
বড়দিন-নতুন বছরে কর্পোরেট শুভেচ্ছায় এ যেন অন্য রদবদল। ২০১৬-য় হাতে হাতে স্মার্টফোনের জমানায় শুভেচ্ছার ভাষাও অন্য রকম। ক’বছর আগেও কর্পোরেট-গোষ্ঠীর তরফে বিজ্ঞাপন নির্মাতাদের দিয়ে ‘কার্ড’ তৈরি করানোর চলটাই জোরদার ছিল। ইদানীং সে-প্রবণতা অনেক কম। ই-কার্ডের চটকও আর আগের মতো নেই। তার বদলে নতুন আবিষ্কার ১০-১৫-২০ সেকেন্ডের খুদে ভিডিও ছবি। হোয়াট্স অ্যাপ ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যার কাটতি বেড়েই চলেছে।
স্মার্টফোনের সুবাদে ইন্টারনেটের ব্যবহার আজ ক্রমশ সর্বজনীন। আনকোরাদের পক্ষেও পরপর শট জুড়ে ছোটখাটো সিনেমা তৈরি করে ফেলা অসম্ভব নয়। এবং রাম-শ্যাম-যদু-মধু থেকে নামজাদা চিত্রপরিচালকেরা অবধি শুধু ইন্টারনেটের জন্য আলাদা করে ছোট ছবি তৈরি করছেন। রেসপন্স সংস্থার ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর জয় আইচভৌমিক মজেছেন জনসংযোগের এই নতুন ভাষায়। বললেন, ‘‘এ-ও এক ধরনের শর্ট ফিল্ম। নামমাত্র খরচেই সম্ভব। হোয়াট্স অ্যাপ বা ফেসবুক ওয়ালে চট করে ছড়িয়ে দিতে সমস্যা নেই। দেশে-বিদেশে প্রচারও সহজ।’’ চিত্রপরিচালক অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী বললেন, ‘‘শিল্পসৃষ্টির আনন্দ এবং বিজ্ঞাপনী প্রচার, এক ঢিলে দুই পাখি মেরে সহজে ফিল্ম বানাতে ইন্টারনেটের জবাব নেই!’’
কয়েক মাস আগেই ‘কহানি’-খ্যাত চিত্রপরিচালক সুজয় ঘোষের শর্টফিল্ম ‘অহল্যা’ আর অনিরুদ্ধর ‘দেবী’ ভাষার ব্যবধান ঘুচিয়েও দারুণ সাড়া ফেলেছিল। ফেসবুক, হোয়াট্স অ্যাপে ছবিগুলো ‘শেয়ার’ও হয়েছে বিস্তর। গল্পের মজাটুকুর মোড়কে দু’টি ছবিই কিন্তু ‘সারোগেট’ বা বকলমে বিজ্ঞাপনের আদর্শ নমুনা। একটি চেনা হুইস্কি ব্র্যান্ড নিবেদিত ‘অহল্যা’য় কাহিনির ভেতরেও পানীয়ের মহিমা-প্রচার লক্ষণীয়। পুজোর সাবেকিয়ানা নিয়ে অনিরুদ্ধর ছবিতে একটি রান্নার তেলের ব্র্যান্ডের জয়জয়কার।
নতুন বছর বা বড়দিনে হোয়াট্স অ্যাপে বিভিন্ন সংস্থার তরফে শুভেচ্ছার চলচ্ছবিও জনসংযোগের আদলে বিজ্ঞাপনী কৌশল। কলকাতার একটি কেক প্রস্তুতকারী সংস্থা যেমন কয়েক সেকেন্ডের ফিল্মে গাদা-গাদা কেক ‘প্যাক’ করে সান্তাক্লজের স্লেজে চড়ার ছবি তুলে ধরেছে। সুপরিচিত রিয়েল এস্টেট গোষ্ঠীর কর্তা সঞ্জয় জৈনের কথায়, ‘‘স্মার্টফোনের সুবাদে শুভেচ্ছা জানানোর নতুন রাস্তা খুলেছে। হোয়াট্স অ্যাপে বা ফেসবুক পেজে ছোট-ছোট ভিডিও অনেকেরই মনে ধরছে।’’ মুম্বই-কলকাতার বিজ্ঞাপনী ছবি নির্মাতা সংস্থা পপকর্ন ফিল্মসের কর্ণধার অংশুমান রায়ের কথায়, ‘‘স্মার্টফোনে ‘অ্যাড ফিল্ম’ জনপ্রিয় করে তোলাই এখন বিজ্ঞাপন-নির্মাতাদের নতুন চ্যালেঞ্জ।
বাস্তবিক। ‘টিভি কমার্শিয়াল’-এর সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার ছবি গুলিয়ে ফেলতে রাজি নন বিজ্ঞাপন বিশেষজ্ঞেরা। অনেক বিজ্ঞাপনেরই ইউ-টিউব, ফেসবুক বা হোয়্যাট্স অ্যাপের জন্য আলাদা করে সংস্করণ তৈরি হচ্ছে। মুম্বইয়ের কনট্র্যাক্ট সংস্থার সিনিয়র ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর রাহুল ঘোষের কথায়, ‘‘স্মার্টফোনের স্ক্রিনে ঠিকঠাক দেখা যাবে, এটা মাথায় রেখেই এ-সব ছবির প্রতিটা শট তৈরি হয়।’’ তবে কয়েকটা সমস্যা ফেলনা নয়। জেডব্লিউটি সংস্থার সিনিয়র ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর অর্জুন মুখোপাধ্যায় মনে করাচ্ছেন, ‘‘এ দেশে ইন্টারনেটের স্পিড আরও উন্নত হওয়া দরকার।’’ ফোর-জি প্রযুক্তি এখনও সবার হাতে আসেনি। ফোনে ঠোক্কর খেতে খেতে অ্যাড ফিল্ম দেখাটা সুখকর না-ও হতে পারে!
তবে হোয়াট্স অ্যাপ বা ফেসবুক অনেক বেশি অন্তরঙ্গ আঙ্গিক। সেটাই আদতে বার্তা, মনে করছেন প্রবীণ বিজ্ঞাপন বিশেষজ্ঞ রাম রায়। বিশ শতকের নামী মিডিয়া-বিশেষজ্ঞ মার্শাল ম্যাকলুহানের বিখ্যাত উদ্ধৃতি (মিডিয়াম ইজ দ্য মেসেজ) তুলে ধরে তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘অনেকের কাছে হোয়াট্স অ্যাপ বা ফেসবুকটা একান্ত ব্যক্তিগত ‘স্পেস’। সেখানে বিজ্ঞাপনের নাক গলানো সবার পছন্দ হয় না।’’ হোয়াট্স অ্যাপ বা ফেসবুকে দুম করে ঢুকে কোনও ব্র্যান্ডের প্রচারে গ্রাহক চটে যেতে পারেন বা প্রেরককে ব্লক করতে পারেন। এমনিতে অবশ্য হোয়াট্স অ্যাপ গ্রুপে স্কুলের পুরনো বন্ধু বা অফিসের সহকর্মীরা দল বেঁধে গালগল্পে মাতেন। চুটকি-কার্টুনও শেয়ার হয়। অনেকেরই মত, ওই তল্লাটে জনপ্রিয় হতে গেলে বিজ্ঞাপনে বিনোদনের মশলাটা বেশি জরুরি।
‘‘খুব ছোট বিজ্ঞাপনেও গল্প বা গানের মজা অনেকের ভাল লাগে!’’ বলছেন কলকাতার পরিচিত বিজ্ঞাপন নির্মাতা সৌভিক মিশ্র। একটি অনলাইন কেনাকাটির পোর্টাল যেমন বিজ্ঞাপনের জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকেই নিশানা করেছে। এ যুগের মেয়েদের স্বকীয় অস্তিত্বের হয়ে সওয়াল করে কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য বা একলা মেয়ের লড়াই নিয়ে ছোট ছোট গল্পের চিত্রনাট্য বুনে দেশ জুড়ে ঝড় তুলেছে তারা। এবিপি সংস্থার এবেলা পত্রিকার ওয়েবসাইট প্রচারের একটি গানও সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয়। মানানসই ছবিতে গানটি হোয়াট্স অ্যাপ, ফেসবুকে পায়ের তলায় সর্ষে নিয়ে ঘুরছে।
নতুন বছরের ‘কর্পোরেট মেসেজে’ও সুর-তাল-ছবির মজাটাই এখন প্রধান। শুকনো শুভেচ্ছায় চিঁড়ে ভিজছে না।