Parenting Tips

তুলনার পথে ভুলেও না

প্রতিযোগিতার এই পৃথিবীতে সন্তানের চাই সমর্থন, তার গুণাবলির কদর। কিন্তু অন্যকে দেখিয়ে তাকে তার অক্ষমতা নিয়ে বকাঝকা করলে সৃষ্টি হবে ক্ষত ও ক্ষতি। রইল বিশেষজ্ঞের পরামর্শ।

চিরশ্রী মজুমদার 

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৯:৩৪
Share:

অপমান করার জন্য তুলনা করা হচ্ছে, না অনুপ্রাণিত করার জন্য, সেটা ভাবা দরকার। ছোটরা যাতে অনুপ্রাণিত হয় তার জন্য নানা কিংবদন্তির গল্প বলা যায় ওদের।

সন্তানকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করার সময় অভিভাবক মোটেও তার কোনও ক্ষতি চান না। বরং তাঁর মূল উদ্দেশ্য সন্তানের উন্নয়ন, উত্তরণ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাঁর পদ্ধতিতে ত্রুটি থাকে। “আকৃতি কত শান্ত দেখেছ, কেমন সকলকে আগলে রাখে, তুমি ওর মতো ‘ভাল’ নও কেন?” কিংবা, “তোমারই পাশে বসে, একই স্যরের কাছে পড়ে, তবু কৃষভ ম্যাথ অলিম্পিয়াডে যাচ্ছে, আর তুমি পারলে না!”— অভিভাবকের এমন হতাশাময় তুলনার অভ্যাসে ছোটদের কোমল মন ব্যথায় ভরে যায়। সেই বেদনা তাদের আচরণে কী ভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তা নিয়ে বহু বার সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞ ও মনোবিদরা। বলেছেন, ওরা নিজেদের অবহেলিত মনে করতে শুরু করে। ভাবে ওদের দ্বারা কিছু হবে না, ওরা মা-বাবার ও পরিবারের অগৌরবের কারণ, ওরা যা-ই করুক, তা কখনওই যথেষ্ট হবে না। বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা— ভাইবোন, প্রতিবেশী কিংবা সহপাঠীর সঙ্গে তুলনা করে সন্তানকে নিরুৎসাহিত করবেন না, বরং তাকে নিজের মানোন্নয়নের জন্য অন্য কৌশলে অনুপ্রাণিত করুন।

বিপদের পদধ্বনি

পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বললেন, “সিবলিং রাইভ্যালরি বা ভাইবোনের মধ্যে রেষারেষির অন্যতম কারণ এই তুলনা করার প্রবণতা। বিষয়টা বড়দের পরিপ্রেক্ষিতে ভাবুন। ধরা যাক, আমাদের কোনও জায়গায় খামতি আছে। কেউ যদি আমাদের ভালর জন্যও সেই বিষয়ে অন্য কারও সাফল্যের কথা বলে ঠেস দেয়, পরিণত মস্তিষ্কও তা গ্রহণ করতে চায় না। বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও তাই। যিনি তুলনা করছেন তাঁর প্রতি এবং যার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে তার প্রতিও বিরক্তি তৈরি হয়। তুলনা করার ধার্য মাপকাঠিতে এক জন পৌঁছাল, আর এক জন যে পৌঁছাল না, সেটাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখালে অপদস্থ করার মতোই গায়ে লাগে।” এর ফলে বাচ্চা জেদি, বিরক্ত হয়ে ওঠে, আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি হয়, জীবনপথে এগোনোর বদলে পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়ে। মা-বাবার উপরে রাগও তৈরি হতে পারে। সম্পর্কে তিক্ততা আসে।

স্কুলে যে বাচ্চাটি সহপাঠীকে ‘বুলি’ করে, হয়তো দেখা যাবে যাকে হেনস্থা করছে, সেই শান্তশিষ্ট পড়ুয়াটির সঙ্গে তার তুলনা করা হয়েছে। পরীক্ষার খাতা লুকানোর, মিথ্যা বলার (লোকজনকে মিথ্যা নম্বর বলা দিয়ে শুরু), হিংসা করে অন্যের ক্ষতি করে দেওয়ার কথা ভাবা এবং কিশোর অপরাধী হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও তৈরি হয়। অর্থাৎ বাচ্চার মানসিক গড়নটাই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।

অপমান করার জন্য তুলনা করা হচ্ছে, না অনুপ্রাণিত করার জন্য, সেটা ভাবা দরকার। ছোটরা যাতে অনুপ্রাণিত হয় তার জন্য নানা কিংবদন্তির গল্প বলা যায় ওদের।

জোরের জায়গায় শান দিন

এমন কোনও উপায় আছে কি, যেখানে তুলনা করা হল না, আবার বাচ্চার মধ্যে আরও ভাল করার তাগিদও উৎপন্ন করা গেল? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আজকের দুনিয়ায় প্রতিযোগিতাকে এড়িয়ে যাওয়াটা বাস্তবসম্মত নয়। তবে নজর রাখতে হবে, সন্তান যেন ‘বার্ন আউট’ হয়ে না যায়, অর্থাৎ তার প্রাণশক্তিতে যেন ভাটা না আসে। তা হলেই নানা ক্ষেত্রে সে পিছিয়ে পড়তে পারে। দেখা গিয়েছে, পড়া বা পারিপার্শ্বিক চাপ নয়, ‘বার্ন আউট’-এর মোদ্দা কারণ মানসিক ক্লান্তি। অন্যের সঙ্গে তুলনা টানা, পরিবারে সহানুভূতির অভাব, কেবলই অন্যকে দেখিয়ে এমন লক্ষ্য স্থির করা যা শিশুর পক্ষে ছোঁয়া কষ্টকর— সবই বার্ন আউট-এর জন্য দায়ী। বাড়ির পরিবেশ হালকা রাখুন। কোথাও ব্যর্থ হলে সন্তান যেন নির্ভয়ে আপনাকে এসে বলতে পারে। পরের বার সেই ক্ষেত্রে কী ভাবে সফল হতে পারে, পরামর্শ দিয়ে তাকে সাহায্য করুন। এ ভাবে তাকে স্ট্রেস সামলানোর পদ্ধতি শিখিয়ে দিন। স্ট্রেস সামাল দেওয়ার দক্ষতা যে কোনও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে টিকে থাকার ও নিজের সেরাটা বার করে আনার চাবিকাঠি। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক মহেন্দ্র সিংহ ধোনির উদাহরণ দেওয়া যায়।

প্রতিটি শিশুই ‘জিনিয়াস’— এই তত্ত্বে আস্থা হারাবেন না। যে অঙ্কে ভাল নম্বর পাচ্ছে না, হয়তো সে খুব ভাল ছবি আঁকে। যে পড়াশোনায় সুবিধে করতে পারছে না, সে হয়তো দারুণ ক্রিকেট খেলে। প্রতিযোগিতায় দৌড়ানো, সাঁতার, বল ছোড়ার— নানা বিভাগের জন্যই সেরার পুরস্কার রাখা থাকে। জীবনও তেমনই। সন্তানের সেই জোরের জায়গাটা চিনে উৎসাহ দিন। ‘থ্রি ইডিয়টস’-এর আপ্তবাক্য মেনে, সাফল্য নিজে থেকেই দৌড়ে আসবে সন্তানের কাছে। যদি তথাকথিত সাফল্য না-ও আসে, পরিবারের কাছ থেকে সান্ত্বনাটুকু অন্তত পাওয়া যাবে, এই ভরসা যেন তৈরি হয় সন্তানের মধ্যে। তার জোরেই সে পরের বার আরও ভাল করার চেষ্টা করবে।

পায়েল বললেন, “জোরের জায়গা চেনার আর একটা সুবিধা রয়েছে। বিশেষত ৫-১১ বছরের বাচ্চারা, অভিভাবক না বললেও নিজেই অন্যদের সঙ্গে তুলনা করে। বলে— ‘ও তো সবসময়ই ভাল করে, আমি পারি না।’ অর্থাৎ, ও প্রশংসার প্রত্যাশা করছে। এ ক্ষেত্রেও, তার জোরের জায়গাটা নিয়ে উৎসাহ দিলে মুখে হাসি ফুটবে। ‘বন্ধুর চেহারা কেমন সুন্দর, আমি কি অতটা ভাল দেখতে?’ এই তুলনাও প্রায়ই করে ওরা। অত্যন্ত সংবেদনশীল ভাবে বাচ্চাকে প্রকৃত সৌন্দর্যের বিষয়ে বোঝাতে হবে বাবা-মাকেই। যে ক্ষেত্রে ও একটু দুর্বল, সে দিকে বিশেষ নজর দিতে ছোট ছোট লক্ষ্য স্থির করুন। যে অঙ্কে ৬০ পেল তাকে একেবারে ৯৫ পাওয়ার জন্য চাপ দিলে দিশাহারা হয়ে পড়বে। পরিবর্তে বলুন, দেখো তো একটু চেষ্টা করে, আর পাঁচ নম্বর বাড়ানো যায় কি না। সে হয়তো পরের পরীক্ষায় ৭০ পেল এবং সেটাই আনন্দের সঙ্গে এসে বলল। তাতে উৎসাহ দিন। এতে তার ওই তথাকথিত দুর্বলতার ক্ষেত্রেও আরও ভাল করার ইচ্ছা জাগবে।”

চ্যাম্পিয়নের হিট রেসিপি

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রাম বললেন “জগতে কোনও কিছু বা কারও মূল্যায়ন হয় তুলনা বা তুলাদণ্ডের মাধ্যমে। অপমান করার জন্য তুলনা করা হচ্ছে, নাকি অনুপ্রাণিত করার জন্য— সেটা কিন্তু বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কী ভাবে তুলনা করা হল, সকলের সামনে বলা হল কি না— সেগুলো বাচ্চাদের বেশি বিচলিত করে।” তাঁর মতে, কারও দৃষ্টান্ত নিয়ে সদর্থক আলোচনা করলে কিন্তু তা সন্তানকে উৎসাহিতই করবে। রোল মডেল ধারণাটার উৎপত্তিই তো সেখানে। তার মানে সন্তানকে খাটো করা নয়। বৈভব রাজবংশী, রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ প্রমুখ কিশোর প্রতিভাকে সামনে রাখলে নিজের গুণাবলিকে বিকশিত করার, আরও পরিশ্রম করে আরও ভাল ফলাফল লাভের প্রেরণা পাবে বাচ্চাটি। তবে শুধু জেতার নয়, হেরে যাওয়ার গল্পও বলতে পারেন। হার মেনে নিতে শেখা খুব জরুরি। এতে বাস্তববোধ তৈরি হবে।

মূল কথা, প্রতিযোগিতা থাকবে। সেই দৌড়ে যোগ দেওয়ার জন্য বা পিছিয়ে পড়ার জন্য শিশুকে কোনও রকম খোঁচা দেবেন না। বরং সব রকম ভাবে উৎসাহিত করুন যাতে সে দৌড়টা উপভোগ করে, তা হলেই তার প্রতিভা আপনিই চোখে পড়বে।


মডেল: সুস্মিতা দে, তন্ময় মজুমদার, মোনালিসা পাহাড়ি শতপথী, রাইমা গুপ্ত, উদিতা মুনশি, ওঙ্কার ভট্টাচার্য;

মেকআপ: নব মাইতি (তন্ময়, ওঙ্কার);

ছবি: অমিত দাস, সর্বজিৎ সেন

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন