যখন ঘুম আসে না

স্বাস্থ্য ভাল রাখার জন্য ঘুম জরুরি। কিন্তু অনেকেই ঘুমের সমস্যায় ভোগেন। কী ভাবে এর থেকে মুক্তি মিলবে তা নিয়ে আলোচনা করলেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সানি চট্টোপাধ্যায়। সাক্ষাৎকার প্রদীপ মুখোপাধ্যায়স্বাস্থ্য ভাল রাখার জন্য ঘুম জরুরি। কিন্তু অনেকেই ঘুমের সমস্যায় ভোগেন। কী ভাবে এর থেকে মুক্তি মিলবে তা নিয়ে আলোচনা করলেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সানি চট্টোপাধ্যায়। সাক্ষাৎকার প্রদীপ মুখোপাধ্যায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৮ ০২:২৫
Share:

প্রশ্ন: ঘুম কী?

Advertisement

উত্তর: ঘুম হল মস্তিষ্কের একটি জটিল ক্রিয়া। এর প্রধান কাজ আমাদের শরীরকে বিশ্রাম দেওয়া এবং আমাদের শারীরিক ক্ষমতাকে পুনরুদ্ধার করা। সুস্থ থাকার জন্য এক জন মানুষের নির্দিষ্ট সময় স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে ঘুমনো আবশ্যিক।

প্রশ্ন: স্বাস্থ্যসম্মত ঘুম বলতে কী বোঝাচ্ছেন?

Advertisement

উত্তর: যে ধরনের ঘুমের মাধ্যমে শরীরের সার্বিক অবস্থার উন্নতি হয়, তাকেই স্বাস্থ্যসম্মত ঘুম বলে। এই ক্ষমতা আমাদের মধ্যে তখনই সঞ্চারিত হয়, যখন আমরা সহজেই ঘুমিয়ে পড়ি এবং সেই ঘুম কোনরকম ব্যাঘাত ছাড়াই নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলতে থাকে।

প্রশ্ন: এক জন সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষের দিনে কতক্ষণ ঘুমনো দরকার?

উত্তর: এটা নির্ভর করে বয়সের উপরে। বয়সের সঙ্গে ঘুমের সময় বা ধরন ব্যস্তানুপাতিক। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দৈনিক সাত-আট ঘণ্টা ঘুম হল পর্যাপ্ত। আবার কিশোর-কিশোরীদের ঘুমের প্রয়োজন খুবই বেশি। কারণ, এই সময় তাদের দ্রুত শারীরিক বিকাশ ঘটে। কিন্তু এই সময় প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে বেচারারা ঠিকমতো ঘুমনোর সময় পায় না। ফলে শরীরে অনেক রকম সমস্যা তৈরি হয়। সদ্যোজাত থেকে ৪-৫ বছর বয়স পর্যন্ত ১৬-১৮ ঘণ্টা ঘুম দরকার। এর পর থেকে ১২-১৩ বছর বয়স পর্যন্ত অন্তত ১০-১২ ঘণ্টা ঘুমের দরকার। বার্ধক্যে অবশ্য ঘুম কমে যায়। এটা ব্যক্তি বিশেষের উপরে নির্ভর করে।

প্রশ্ন: এই নির্দিষ্ট সময় ঘুম না হলে কী সমস্যা হতে পারে?

উত্তর: ঘুম না হলে মস্তিষ্ক দুর্বল হতে পারে। স্মৃতিশক্তি, মনঃসংযোগ করার ক্ষমতা কমে যায়। এ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপ, সুগার, চোখের সমস্যা, হজমের সমস্যা-সহ নানা রকম রোগ দেখা দিতে পারে। এক কথায় বলা যেতে পারে ঘুম না হলে শরীরের সব ব্যবস্থার উপরেই প্রভাব পরে। এতে শেষ পর্যন্ত মনোরোগ দেখা দিতে পারে।

প্রশ্ন: ঘুম না হওয়ার কারণ কী?

উত্তর: অনেক কারণেই ঘুমের সমস্যা হয়। তার মধ্যে অন্যতম কারণ হল মানসিক চাপ। বর্তমান সময়ে প্রায় প্রতিটি মানুষের জীবনেই মানসিক চাপ কাজ করছে। মানুষের জীবনযাত্রা যত উন্নত হচ্ছে, মানুষের চাহিদাও তত বাড়ছে। চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রাখতে না পারলে তৈরি হচ্ছে চাপ। এই চাপের জন্য শরীরের নানা স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় প্রভাব পড়ছে। এ জন্য ঘুমেরও সমস্যা হচ্ছে।

প্রশ্ন: কোন বয়সের মানুষের ঘুম না হওয়ার সমস্যা বেশি হয়?

উত্তর: সব থেকে বেশি ঘুম সংক্রান্ত সমস্যা দেখা যায় বয়স্ক মানুষদের মধ্যে। তবে মানসিক চাপের জন্য ঘুম সংক্রান্ত সমস্যা বিভিন্ন বয়সের মানুষের জীবনেই রয়েছে। এমনকী স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যেও এই সমস্যা দেখা গিয়েছে।

প্রশ্ন: ঘুমের সমস্যা হলেই মানুষের একটা প্রবণতা থাকে ঘুমের ওষুধ খাওয়া। এটা কি ঠিক?

উত্তর: একেবারেই নয়। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঘুমের ওষুধ খাওয়া একেবারেই ঠিক নয়। এতে ঘুমের জন্য ওষুধের উপরে নির্ভরতা তৈরি হয়ে যায়। দিনে দিনে দেখা যায় ওষুধের মাত্রা বাড়তে থাকে। এর ফলে শরীরে অনেক রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। কাজেই ঘুমের ওষুধ ব্যবহার করা একেবারেই উচিত নয়। অনেক সময় এমন দেখা গিয়েছে, এক জন রোগী দীর্ঘদিন ধরেই ঘুমের ওষুধ খাচ্ছেন, তিনি ঠিকঠাক ঘুমাচ্ছেন। কিন্তু তিনি নিজে বলছেন ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না। চিকিৎসাবিদ্যার পরিভাষায় একে বলা হয় ‘প্যারাডক্সিক্যাল ইনসমনিয়া’।

প্রশ্ন: ‘প্যারাডক্সিক্যাল ইনসমনিয়া’ কেন হয়?

উত্তর: এটা অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ ব্যবহারের জন্য হয়। ঘুম যে পর্যাপ্ত হয়েছে, সেই স্মৃতিটাই এই ওষুধগুলি থাকতে দেয় না। জেগে থাকার স্মৃতিটা থাকলেও ঘুমের স্মৃতিটা থাকে না। এতে তাঁর মধ্যে অন্য সময় ঘুমনো, ওষুধের মাত্রা বাড়ানো বা ওষুধ পরিবর্তন করার একটা প্রবণতা চলে আসে। মাঝেমধ্যে রোগীকে অবসাদও গ্রাস করে।

প্রশ্ন: অনেক সময় দেখা যায় আগের রাতে ঘুম হয়নি, তাই পরের দিন অনেকে ঘুমিয়ে নেন। এটা কি ঠিক?

উত্তর: এটা করা উচিত নয়। এটা নিয়মিত হতে থাকলে অনিদ্রা বা ইনসমনিয়া চেপে বসবে। ইনসমনিয়া হল পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব বা এমন একটা ঘুম যা গাঢ় নয়। এই ধরনের ঘুমের ফলে শরীর তরতাজা হতে পারে না। বহু শারীরিক সমস্যার উৎস এই ইনসমনিয়া।

প্রশ্ন: কী করে বোঝা যাবে কেউ অনিদ্রার শিকার হচ্ছেন?

উত্তর: দু’সপ্তাহের রেকর্ড দেখলেই এটা বোঝা যাবে। মানসিক চাপ থেকেও অনেক সময় অনিদ্রা হতে পারে। তবে তা কেটে গেলে অনিদ্রাও চলে যায়।

প্রশ্ন: দুপুরের ঘুম কি স্বাস্থ্যসম্মত?

উত্তর: দিনে ঘুমনোর অভ্যাস থাকলেও তা বেশিক্ষণ না হওয়ায় উচিত। অন্তত তিনটের পরে আর ঘুমনো উচিত নয়। এর প্রভাব রাতের ঘুমে পড়তে পারে।

প্রশ্ন: সুস্থ ভাবে ঘুমনোর জন্য আমাদের কী করা উচিত?

উত্তর:কিছু নির্দিষ্ট জীবনশৈলী এবং কৌশলের মাধ্যমে সুস্থ ভাবে ঘুমনো যেতে পারে। যেমন, তখনই ঘুমোতে যাওয়া উচিত, যখন সত্যিই ঘুম পেয়েছে বা ক্লান্ত লাগছে। ঘুম আসবে বলে বিছানায় জেগে শুয়ে থাকা উচিত নয়। ঘুমোতে যাওয়ার পরে ১৫-২০ মিনিটেও ঘুম না এলে, বিছানা ছেড়ে উঠে কিছু কাজ করুন, যেমন বই পড়া বা গানশোনা। তবে নেটসার্ফিং বা কোনও ফোনে নিজেকে জড়ানো উচিত নয়। স্মার্টফোন আসার পরে বিছানায় শুয়ে ঘুম আসার আগে পর্যন্ত স্মার্টফোন ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা খুব খারাপ অভ্যাস। এটা ছেড়ে দেওয়া দরকার। ঘুমানোর ৪-৫ ঘণ্টা আগে থেকে কোন নেশার দ্রব্য গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ঘুমের ঘণ্টাখানেক আগে স্নান করলে বা ঘুমোতে যাওয়ার আগে গরম দুধ বা দুগ্ধজাত কিছু খেলে ভাল ঘুম হয়। সকালে নিয়মিত ব্যায়াম করুন। শারীরিক পরিশ্রম মস্তিষ্কে ঘুমের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হতে সাহায্য করে। তাই এটা খুব জরুরি। তবে ঘুমানোর আগে ভারী ধরনের ব্যায়াম করা উচিত নয়। শোওয়ার ঘর গুছিয়ে রাখুন। ঘুমনোর জন্য এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিছানা এবং শোওয়ার ঘর দু’টিই শান্ত এবং আরামপ্রদ থাকুক।

প্রশ্ন: অনেক সময়েই শোনা যায়, সন্তান প্রসবের পর থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত বাচ্চা সামলাতে গিয়ে মায়েদের ঘুম কম হয়। এ ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?

উত্তর: দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে মায়েদের ঘুমানোর সুযোগ করে দিতে হবে পরিবারেরই কাউকে। ওই সময়টা বাচ্চাদের দেখভালের দায়িত্ব পরিবারের অন্য কাউকে নিতে হবে। একে পরিভাষায় বলা হয় ‘কেয়ারগিভার হলিডে’।

প্রশ্ন: ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখেনি এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। স্বপ্ন নিয়ে মানুষের কৌতূহলেরও অন্ত নেই। মানুষ স্বপ্ন কেন দেখে?

উত্তর:ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখা মানুষের জীবনে একটি অপরিহার্য প্রক্রিয়া। ঘুম একটি মানসিক অবস্থা, যে অবস্থায় মানুষের অবচেতন মন আগে ভাবনা চিন্তা করা বিষয়গুলি বা পুরনো ঘটে যাওয়া ঘটনাক্রম দেখে, এবং স্বপ্ন দেখার সময় তা আসল বলে মনে করে। গভীর ঘুমের সময় মানুষ স্বপ্ন দেখে না। গভীর ঘুমে যাওয়ার আগের সময়কে বলা হয় ‘রেইম স্লিপ’। এই সময়ই মানুষ মূলত স্বপ্ন দেখে। ঘুমের মাঝেও রেইম স্লিপ হয়।

প্রশ্ন: অনেক সময় ঘুমের মধ্যে হাত-পা ছোড়া, কথা বলা বা এমনকী উঠে হাঁটাহাঁটি করার কথাও শোনা যায়। এটা কেন হয়?

উত্তর: ঘুমের সময় মস্তিষ্ক এবং শরীর বিশ্রামে থাকে। কিন্তু অনেক সময় শরীর বিশ্রামে থাকলেও মস্তিষ্ক সক্রিয় হয়ে যায়, তখন এ ধরনের ঘটনা ঘটে। অবচেতন মনে এ ধরনের ঘটনা ঘটে বলে মানুষ সে সব মনে রাখতে পারে না।

প্রশ্ন: অনেকে আছে যারা অনেক গভীর রাতে ঘুমোতে যান এবং অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমোন। এতে কি কোনও ক্ষতি হতে পারে?

উত্তর: যদি আমাদের শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী ঘুম হয়ে যায়, তা হলে ক্ষতিটা অনেক কম হয়। তবুও ক্ষতি হতেই পারে। আমাদের শরীরে একটা বায়োলজিক্যাল ক্লক রয়েছে। এই ক্লক নিয়ন্ত্রিত হয় দিন-রাতের উপরে। আমরা যখন নিজেরা ঘুমের সময় পরিবর্তন করছি, তার অর্থ শরীরের বায়োলজিক্যাল ক্লকটা আমরা নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করছি। এর জন্য শরীরে একটা খারাপ প্রভাব
তো পড়বেই।

প্রশ্ন: ধ্যান করলে কি ঘুম ভাল হয়?

উত্তর: অবশ্যই ঘুমের সঙ্গে ধ্যানের সম্পর্ক রয়েছে। ধ্যান করলে মন শান্ত হয়। শান্ত মনে ঘুম ভাল হয়। এ ক্ষেত্রে হালকা ভাবে শান্ত
গান চালিয়ে ঘুমোতে গেলে ঘুম ভাল হয়।

প্রশ্ন: স্কুলপড়ুয়া বা তাদের অভিভাবকদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?

উত্তর: ছেলে-মেয়েকে ঘুমোতে দিন ভাল করে। তাতে আখেরে তাদের লাভই হবে। অন্য কোনও কিছু বাদ দিয়ে, তা হতে পারে টিভি
দেখা, পার্টিতে যাওয়া বা এমনকী টিউশন বাদ দিয়ে পড়াশোনার জন্য সময় করে দিন, কিন্তু কখনই ঘুম বাদ দিয়ে বাচ্চাদের পড়ার জন্য চাপ নয়।

প্রশ্ন: কী ধরনের খাবার খেলে ঘুম ভাল হয়?

উত্তর: এ ব্যাপারে আগেই বলেছি দুধ বা দুগ্ধজাত কোন জিনিস খেলে ঘুম ভাল হয়। কারণ, এতে ট্রিপটোফ্যান থাকে। পান্তা ভাতেও ট্রিপটোফ্যান খুব বেশি থাকে। তাই পান্তা খেলেও ঘুম ভাল হয়। এ ছাড়া প্রোটিন জাতীয় জিনিস খেলেও ঘুম ভাল হয়। তবে ঘুমের জন্য কখনই নেশা করা উচিত নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন