উত্তরবঙ্গে এনসেফ্যালাইটিস ছড়ানোর খবর সঠিক সময়ে জানানো হয়নি বলে কড়া শাস্তি হয়েছে সেখানকার স্বাস্থ্যকর্তাদের। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, গত দু’বছর ধরে লাগাতার উত্তরবঙ্গে এনসেফ্যালাইটিক ফিভারে মৃত্যু-মিছিল চলার পরেও স্বাস্থ্য ভবন কেন সেখানে রোগ মোকাবিলার পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারেনি? প্রতি বছর যে সেখানে মৃত্যু হচ্ছে, এটা স্বাস্থ্য দফতরের অজানা ছিল না। তা সত্ত্বেও তথ্য সংগ্রহও ও তা রিপোর্ট করার নড়বড়ে ব্যবস্থা শোধরানোর কথা কেন মনে হয়নি স্বাস্থ্য ভবনের শীর্ষকর্তাদের? তাঁরাও কি সমান দোষের ভাগী নন? প্রশ্নটা উঠছে।
২০১২-এ এনসেফ্যালাইটিসে উত্তরবঙ্গে মারা যান ১০৮ জন, তার মধ্যে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস (জে-ই) হয় ৩৮ জনের। ২০১৩ সালে উত্তরবঙ্গে এনসেফ্যালাইটিক ফিভারে মৃত্যু হয় ১১৫ জনের, তার মধ্যে ৫৩ জনের জে-ই হয়েছিল। স্বাস্থ্য কর্তাদের একাংশের আফশোস, তার পরেও উত্তরবঙ্গে জে-ই মোকাবিলার পরিকাঠামো তৈরি হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গের কোনও জেলায় এখনও কোনও সরকারি পতঙ্গবিদ নেই। সম্প্রতি স্বাস্থ্য ভবনে চুক্তির ভিত্তিতে মাত্র দু’জনকে নিয়োগ করা হয়েছে। অর্থাৎ গোটা রাজ্যের ভার এই দু’জনের উপরে! কলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনে এক সময়ে এন্টেমোলজি বিভাগ ছিল। সেখানে পরীক্ষার জন্য মশা ধরে এনে কলোনি তৈরি করে রাখা হতো। সেই বিভাগ কার্যত বিলুপ্ত। ট্রপিক্যালের পুরনো এন্টেমোলজি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান হিরন্ময় মুখোপাধ্যায় জানান, দশ বছর আগেও উত্তরবঙ্গের জে-ই প্রবণ এলাকার গ্রামগুলিতে, বিশেষত শুয়োরের খামার সংলগ্ন এলাকায় নিয়মিত মুরগি-সহ অন্যান্য পাখি, শুয়োরের রক্ত পরীক্ষা করা হতো। ভাইরাস বাড়ছে কি না, তার আগাম আভাস সেখান থেকে মিলত। সেই সব পরীক্ষা আর হয় না। কারণ যাঁরা সেটা করতেন সেই পতঙ্গ বিশেষজ্ঞ এখন আরল কেউ নেই।
ট্রপিক্যালের প্রাক্তন পতঙ্গ বিশেষজ্ঞ অমিয়কুমার হাটির মতে, মশা কতটা বাড়ছে, তারা কতটা ভাইরাস বহন করছে, মশাদের প্রজনন পদ্ধতি বদলাচ্ছে কি না, তাদের কোনও জিনগত পরিবর্তন হয়েছে কি না, কোনও ওষুধে তাদের দেহে প্রতিরোধ তৈরি হয়েছে কি না, জানা না-থাকলে আগাম মোকাবিলা অসম্ভব। নির্দিষ্ট কর্মসুচি ও কর্মী ছাড়া এ কাজ হয় না।
বেশ কয়েক বছর যাবৎ রাজ্যে কোনও ব্লক স্যানিটরি ইন্সপেক্টর ও স্যানিটরি ইন্সপেক্টর নেই। রোগবাহী মশা নিয়ন্ত্রণের কাজ অনেকটাই এঁরা করতেন। এঁদের তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্যকর্মীরা মশার আঁতুড়ঘর চিহ্নিত করে তা নষ্ট করা, কোথাও রোগবাহী মশা বাড়লে তা রিপোর্ট করা, কোথাও রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে রোগ প্রতিরোধ নিয়ে প্রচার ইত্যাদি করতেন। সেই সব কাজ বন্ধ হয়ে রয়েছে। পতঙ্গবাহী রোগ প্রতিরোধের নীতি যাঁরা তৈরি করবেন, রাজ্যে সেই পদগুলিও ফাঁকা। যেমন জনস্বাস্থ্য অধিকর্তা, অতিরিক্ত স্বাস্থ্য অধিকর্তা (এন্টেমোলজি), অতিরিক্ত স্বাস্থ্য অধিকর্তা (এপিডেমিওলজি)। ফলে পতঙ্গ দমন কর্মসূচি কেমন হবে তা ঠিক করা যায় না।
এ রাজ্যে ব্লকে-ব্লকে পতঙ্গবাহী রোগে আক্রান্ত লোক খুঁজে বার করা, রক্ত পরীক্ষা, জে-ই আটকাতে কোন সময় মশারির ভিতর থাকা উচিত বা বাড়ি থেকে কত দূরে শুয়োর রাখা হবে, এ সব নিয়ে সচেতনতা অভিযান চালানোর মূল কাজ করার কথা স্বাস্থ্যকর্মী (পুরুষ)-দের। রাজ্যে এই কর্মীদের স্থায়ী পদ ১০৩৫৬টি, কিন্তু রয়েছেন তিন হাজারেরও কম। অস্থায়ী স্বাস্থ্যকর্মী (পুরুষ) পদের সংখ্যা ৫০০। রয়েছেন ৩৯৯ জন। অনিয়মিত বেতন ও চাকরির অনিশ্চয়তায় এই অস্থায়ী কর্মীরা নিজেদের কাজ মন দিয়ে করেন না বলে অভিযোগ। এই রকম একাধিক কর্মীর কথায়, “নিয়মিত বেতন না পাওয়ায় মোটরবাইকের তেল কিনতে পারি না। ফলে উত্তরবঙ্গের অনেক প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছি। কোথাও এনসেফ্যালাইটিস ছড়াচ্ছে শুনলেও যতক্ষণ না বাড়াবাড়ি হয়, দৌড়ঝাঁপ করি না।”
মোকাবিলা দলও তাই নিধিরাম।