অটিজমে অন্তরায় অবহেলা

ডাকলে সাড়া দেয় না। দৃষ্টি ঘোলাটে। যে কোনও গোলাকার জিনিস নিয়ে দিনভর এক জায়গাতে বসেই ঘোরাতে থাকে। ছেলে কি তা হলে কানে শুনতে পায় না?

Advertisement

দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৮ ০১:৫৯
Share:

আজ, বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। কৃষ্ণনগরের ‘উন্মেষ’-এ চলছে বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতা আছে এমন শিশুদের থেরাপি। রবিবার। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

প্রথম দিকে ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু ছবিটা পাল্টাতে শুরু করল শিশুর বয়স দু’বছর পেরোনোর পর থেকেই। বাচ্চাটি যা এক-আধটু শব্দ করত, তাও বন্ধ হয়ে গেল। ডাকলে সাড়া দেয় না। দৃষ্টি ঘোলাটে। যে কোনও গোলাকার জিনিস নিয়ে দিনভর এক জায়গাতে বসেই ঘোরাতে থাকে। ছেলে কি তা হলে কানে শুনতে পায় না? অথচ, গান গাইলে তো দিব্যি সে চুপ করে শোনে। ছড়া বললে শান্ত হয়ে মায়ের কোলে চুপটি করে এসে বসে। তা হলে সমস্যাটা কোথায়?

Advertisement

আত্মীয়রা বোঝান, ‘‘কানে যখন শুনতে পায় কথা ঠিকই বলবে। হয়তো কিছুটা দেরি হবে। এমন তো কতই হয়!’’ আশায় আশায় পেরিয়ে যায় বেশ কয়েকটি বছর। এ দিকে, সমস্যা কমা তো দূরের কথা, বরং বেড়েই চলে। কথা বলতে না পারার সঙ্গে সঙ্গে আরও সমস্যা জুড়ে বসে। তার বয়সী অন্য বাচ্চারা যখন হইহই করে স্কুলে যায়, খেলা করে। তাকে দিয়ে কিছু করানো তো দূরঅস্ত্, এক জায়গায় বসিয়ে রাখাটাই যেন একটা যুদ্ধ। ছেলেকে নিয়ে নদিয়ার সুমিত্রা দত্ত শেষ পর্যন্ত ছুটলেন জেলা হাসপাতালে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বললেন—‘ওর তো অটিজম আছে!’

অটিজম! সেটা আবার কী?

Advertisement

বিশেষজ্ঞ বোঝালেন, অটিজম রোগ নয়, এক ধরনের বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতা। সুমিত্রার মনের মধ্যে তখন ঝড় উঠেছে। তিনি ভাবছেন, ‘‘ছেলে কি কোনও দিনও সুস্থ হবে না? এর কি কোনও ওষুধ নেই? ছেলে স্বাবলম্বী না হলে আমাদের অবর্তমানে ও কী করবে? কে দেখবে ওকে?’’

এখানেই শুরু হয় দ্বন্দ্ব। বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতা আছে এমন শিশুদের নিয়ে কাজ করছে কল্যাণীর একটি সংস্থা। সেই সংস্থার অন্যতম কর্তা সিদ্ধার্থশঙ্কর মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এই পর্বটা পেরোতে পারলে বাকি রাস্তাটা সহজ। প্রাথমিক ভাবে কোনও অভিভাবক বাচ্চার প্রতিবন্ধকতার কথা মানতে পারেন না। কিন্তু বিষয়টি তাঁরা মেনে নিলে আর দেরি করি না। সেই বাচ্চার থেরাপি শুরু করি।’’

• দেরিতে কথা বলা

• অন্য শিশুর সঙ্গে মেলামেশায় অনীহা

• স্বাভাবিক খেলাধুলা না-করা

• ইশারা বুঝতে না-পারা

• চোখের দিকে না-তাকানো

• থেরাপিস্টের পরামর্শ নিন

• সাইকোমেট্রি পরীক্ষা করান

• প্রশিক্ষণ দেয় এমন সংগঠনে কথা বলুন

• সন্তানকে সময় দিন

• প্রশিক্ষকের সাহায্য নিন

সমীক্ষা বলছে, বিশ্বে প্রতি ৬৮ জনের মধ্যে এক জন বাচ্চার অটিজম আছে। অথচ এই সম্পর্কে অনেকেই নানা রকম ভুল ধারণা পোষণ করেন। অটিজমকে ‘পাগলামি’ বলেও ধরে নেন। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, নির্দিষ্ট কিছু থেরাপির মাধ্যমে দৈনন্দিন কাজ, পড়াশোনা শিখতে পারবে বাচ্চাটি। তার সমস্যাও অনেকটাই সামাল দেওয়া সম্ভব। হাসপাতাল তো মনস্তাত্বিক পরীক্ষার রিপোর্ট জানিয়ে খালাস। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে নদিয়ার সীমান্ত ঘেঁষা পিয়ালি বিশ্বাস ভোর রাতে ট্রেনে উঠে বছর চারেকের মেয়েকে নিয়ে ছোটেন কলকাতায়। সারাদিন নানা প্রান্তে স্পিচ থেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পেশাল এডুকেটরের কাছে ছুটতে থাকেন।

নদিয়ার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তাপস রায় ও মুর্শিদাবাদের সুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক নিরুপম বিশ্বাস বলছেন, ‘‘এ বিষয়ে আশা, অঙ্গনওয়াড়ি ও স্বাস্থ্যকর্মীদের দায়িত্ব দেওয়া রয়েছে। টিকা দেওয়ার পাশাপাশি বাচ্চাদের বিকাশগত মূল্যায়নের কথা তাঁদের। স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে, এমন কোনও শিশুর সন্ধান পেলেই তাঁরা সেই শিশুর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে হাসপাতালে নিয়ে আসেন।’’

অথচ বাস্তবে তেমনটা হচ্ছে না বলেই অভিযোগ। জঙ্গিপুরের বছর পাঁচেকের জিশান শেখ, ধুলিয়ানের বছর তিনেকের সাহিল আনসারির বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। কিন্তু অভিভাবকেরা তা জানতে পারেন পরে। আজ ২ এপ্রিল, বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। এই দিনটিতে রঙিন শোভাযাত্রা, অঙ্কন প্রতিযোগিতা হয়। কিন্তু অবহেলার ছবিটা বদলায় না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন