World Post Day

World Post Day: ডাক বিভাগকে রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন কত মাশুল দিয়েছেন?

রবীন্দ্রনাথের চিঠি তাই রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো, কখনও বা গানের মতো। নিছক গদ্যময়তা নেই। কবির দর্শন, কবির কাব্যানুভূতি, কবির চিত্রকল্প কবির চিঠিতে ব্যক্ত হয়েছে।

Advertisement

অভ্র ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২১ ১৪:৩৬
Share:

‘কবিতায় কখনও মিথ্যা কথা বলি নে— সেই আমার জীবনে সমস্ত গভীর সত্যের একমাত্র আশ্রয়স্থান।’

রবীন্দ্রশতবর্ষে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ‘বাক্‌পতি বিশ্বমনা’। স্মরণযোগ্য এই বিশেষণ। বি‌শ্বের কোনও কবি বা সাহিত্যিক বোধ হয় এত কথা লেখেননি। তাঁর রচনাবলির কথা বাদ দিচ্ছি। শুধু চিঠিই লিখেছেন পাঁচ হাজারের বেশি। ইংরেজি চিঠির সংখ্যা ধরলে ন’-দশ হাজার তো হবেই। প্রমথ চৌধুরীকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘রীতিমতো ভালো চিঠি লেখা খুব একটা দুরূহ কাজ। প্রবন্ধ লেখা সহজ— খুব একটা মোটা বিষয় নিয়ে অনর্গল কলম ছুটিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু চিঠিতে এমন সকল আভাস ইঙ্গিত নিয়ে ফলাতে হয় কেবল ভাবের চিকিমিকিগুলি মাত্র— যে, সে প্রায় কবিতা লেখার সামিল বললেই হয়। কিন্তু সে রকম চিঠি লেখার দিন কি আর আছে? এক সময় ছিল যখন চিঠি লেখাতেই একটা আনন্দ পেতুম এবং বোধ হয় চিঠি লিখে আনন্দ দিতেও পারতুম।’

চিঠি লিখে যে আনন্দ পেতেন, তার অজস্র প্রমাণের মধ্যে ‘ছিন্নপত্রাবলী’, ‘পথে ও পথের প্রান্তে’, ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’ কিংবা হেমন্তবালাদেবীর কাছে লেখা চিঠির কথা অবশ্যই মনে পড়বে। ‘ছিন্নপত্র’-এ চিঠির প্রাপক ছিলেন ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাদেবী। ‘পথে ও পথের প্রান্তে’র চিঠিগুলি লিখেছেন নির্মলকুমারী মহলানবিশকে এবং স্নেহাস্পদ রাণুকে লেখা চিঠির সংগ্রহ ‘ভানুসিংহের পত্রালী’। যৌবনে ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডায়ারি’ কিংবা পরিণত বয়সে লেখা ‘পশ্চিম যাত্রীর ডায়ারি’ও তো অজস্র চিঠির সমষ্টি। ১৯৩০-এ লেখা ‘রাশিয়ার চিঠি’ও তা-ই। এ সব ছা়ড়া আছে বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত উনিশ খণ্ডে চিঠিপত্র। তার বাইরেও রয়েছে ভূরি পরিমাণ চিঠি— সংকলিত ও অসংকলিত।

কেজো চিঠির কথা বলছি না, চিঠি লেখার নেশায় যখন চিঠি লিখছেন রবীন্দ্রনাথ, তখন কিন্তু তাঁর পাত্রবিচার ছিল। ইন্দিরা, রানি (নির্মলকুমারী), হেমন্তবালা, রাণুকে রসজ্ঞ মনে করতেন বলেই তাঁদের কাছে নিজেকে উজাড় করে চিঠি লেখা। এ বিষয়ে কবি নিজেই এক বার রানিকে চিঠিতে লিখেছিলেন। ‘দেনা-পাওনার কোনও প্রত্যাশা না করেই এত দিন আমার চিঠিতে আমি নিজের মনের ঝোঁকে বকে গিয়েছি। বকবার সুযোগ পেলেই আমি বকি, এবং বকতে পারলেই আমি নিজের মনকে চিনি এবং তার বোঝা লাঘব করি— সাহিত্যিক মানুষের এইটেই হচ্ছে ধর্ম। কিন্তু বকতে পারা একান্ত আমার নিজের গুণ তা নয়— শ্রোতার পক্ষে, বকুনি আদায় করে নেবার শক্তি থাকা চাই।’

Advertisement

‘ঈশ্বর সাকার এবং নিরাকার দুইই। ... এ সকল মতামত লইয়া বাদবিবাদ করিতে চাহি না। তাহাকে রূপে এবং ভাবে আকারে এবং নিরাকারে কর্মে ও প্রেমে সকল রকমেই ভজনা করিতে হইবে। আকারও আমাদের কল্পনা নহে, আকার তো তাঁহারই।’

রবীন্দ্রনাথের চিঠি তাই রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো, কখনও বা গানের মতো। নিছক গদ্যময়তা নয়। কবির দর্শন, কবির কাব্যানুভূতি, কবির চিত্রকল্প কবির চিঠিতে ব্যক্ত হয়েছে। এমনকি, কবি জীবনের সত্যও ধরা পড়ে তাঁর পত্রাবলিতে। হেমন্তবালার কাছে লেখা চিঠিগুলি তো তারই সাক্ষ্য। আর ১৮৯৩ সালে শিলাইদহ থেকে ইন্দিরাদেবীকেও রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘কবিতা আমার বহুকালের প্রেয়সী। বোধ হয় যখন আমার রথীর মতো বয়স ছিল তখন থেকে আমার সঙ্গে বাক্‌দত্তা হয়েছিল। ... জীবনে জ্ঞান এবং অজ্ঞাতসারে অনেক মিথ্যাচরণ করা যায়, কিন্তু কবিতায় কখনও মিথ্যা কথা বলি নে— সেই আমার জীবনে সমস্ত গভীর সত্যের একমাত্র আশ্রয়স্থান।’

ব্রহ্মচর্যাশ্রম আর বিশ্বভারতীর ইতিহাস জানতে হলেও রবীন্দ্রনাথের অজস্র চিঠিই ভরসা। তাঁর লেখা প্রবন্ধ-ভাষণ যেমন গুরুত্বময় এ ক্ষেত্রে, চিঠিপত্র তার চাইতে কম ওজনদার নয়। বস্তুত কালানুক্রমিক ভাবে নানা জনের কাছে লেখা চিঠিগুলিতেই কবির শিক্ষাচিন্তা পরতে পরতে মূর্ত হয়েছে। শিক্ষার দর্শন ও বিশ্বভারতীর গঠনতন্ত্রের ইতিহাস জানতে হলে কবির চিঠিই প্রধান ভরসা।

নানা ধরনের রসের বিস্তারও ঘটেছে কবির পত্রাবলিতে। রাণুর কাছে লেখা চিঠিগুলিতে তার ক্রমিক বিস্তার। এই যে বিশ্বভারতীর কথা বলছিলাম, তার একটি শাখা ছিল শ্রীনিকেতন। সেখানে ম্যালেরিয়া নিবারণের জন্য এক বড় প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯২৪ সালে অ্যান্টি ম্যালেরিয়া সোসাইটির এক অধিবেশনে বক্তৃতা করে এসে রসজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ রাণুকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘ম্যালেরিয়া সভায় বক্তৃতা করে এসেছি যে, ম্যালেরিয়া রোগটা ভাল জিনিষ নয়— ওর সঙ্গে প্রেমের সম্বন্ধ পাতিয়ে শ্রীমতী ম্যালেরিয়াকে অর্ধাঙ্গিনী করবার চেষ্টা করলে ও দেখতে দেখতে দেখতে সর্বাঙ্গিনী হয়ে ওঠে। সাধারণত প্রেয়সীরা হৃৎকমল স্থান গ্রহণ করে থাকেন কিন্তু শ্রীমতী ম্যালেরিয়া হচ্ছেন যকৃৎবাসিনী, প্লীহাবিনোদিনী। কবিরা বলে থাকেন প্রেয়সীর আবির্ভাবে হৃদয়ে ঘন ঘন স্পন্দন উপজাত হয়, কিন্তু ম্যালেরিয়ার আবির্ভাবে সর্ব্বাঙ্গ মুহুর্মুহু স্পন্দিত হতে থাকে। অবশেষে তিক্ত উপায়ে তার বিচ্ছেদ ঘটাতে হয়। কিন্তু তার সঙ্গে এক বার মিলন হলে বারে বারে সে ফিরে আসে।’

এই রসজ্ঞ ব্যক্তিটিই আবার সারা জীবন অধ্যাত্মতত্ত্বে নিমগ্ন ছিলেন। এক সময়ে আদি ব্রাহ্মসমাজের আচার্য ছিলেন বটে, কিন্তু সেটা পারিবারিক কর্তব্যবোধ, পিতার আদেশ পালনার্থে। কিন্তু ব্রাহ্ম পরিচয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি আপত্তিই জানিয়েছিলেন। আসলে তাঁর আস্থা ও বিশ্বাস ছিল ‘মানুষের ধর্মে’। ‘নৈবেদ্য’-র কাল থেকে ‘মানুষের ধর্ম’-এর কাল পর্যন্ত কাদম্বিনীদেবীকে লেখা চিঠিগুলিতে (১৯০২-১৯৩১) রবীন্দ্রনাথ বার বার জানাচ্ছেন, ‘সাকার নিরাকার একটা কথার কথা মাত্র। ঈশ্বর সাকার এবং নিরাকার দুইই। ... আমি এ সকল মতামত লইয়া বাদবিবাদ করিতে চাহি না। তাহাকে রূপে এবং ভাবে আকারে এবং নিরাকারে কর্মে ও প্রেমে সকল রকমেই ভজনা করিতে হইবে। আকারও আমাদের কল্পনা নহে, আকার তো তাঁহারই।’

Advertisement

‘আমার ভগবান মানুষের যা শ্রেষ্ঠ তাই নিয়ে। তিনি মানুষের স্বর্গেই বাস করেন।’

কাদম্বিনীদেবীকে আর এক চিঠিতে লিখছেন, ‘আমাকে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের লোকেরা বিশেষ শ্রদ্ধা করেন না। তাঁহারা আমাকে পুরা ব্রাহ্ম বলিয়াই গণ্য করেন না।’ আমাদের মনে পড়ে যায় ১৯২১ সালে যুবব্রাহ্মদলের নেতা সকুমার রায়-প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশদের সেই আন্দোলনের কথা। তাঁরা কবিকে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সাম্মানিক সভ্যপদ দিতে চেয়েছিলেন। প্রবীণ ব্রাহ্মরা ঘোর আপত্তি তুলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ভোট নেওয়া হয়। যুব ব্রাহ্মরা ভোটে জিতে কবিকে সম্মান জানান। সুকুমার রায়েরা রবীন্দ্রনাথকে সম্মান জানাতে চেয়েছিলেন তাঁকে ব্রাহ্ম নেতা বানানোর জন্য নয়, তাঁর মানবতাবাদকে আবাহন করার জন্য। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের লেখা পুস্তিকা ‘কেন রবীন্দ্রনাথকে চাই’ পড়লেই সে কথা বোঝা যাবে। হেমন্তবালাদেবীকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘...কিন্তু আমার ভগবান মানুষের যা শ্রেষ্ঠ তাই নিয়ে। তিনি মানুষের স্বর্গেই বাস করেন।... ভগবান অসীম বলেই তাঁকে সব কিছুতেই আরোপ করলে চলে এ কথা আমি মানতে রাজি নই। যেখানে জ্ঞানে ভাবে কর্মে পরিপূর্ণ শ্রেষ্ঠতা সেইখানেই। তাকে উপলব্ধি না করলে ঠকতে হবে।’

রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রে প্রকৃতি, পরিবেশ, নন্দনতত্ত্ব, সৌন্দর্যতত্ত্ব, কাব্যতত্ত্ব, শিক্ষা, ধর্ম, রাজনীতি, সমাজ, গ্রামগঠন— সমস্ত বিষয়েই কথাবার্তা আছে। আছে ব্যক্তিগত দুঃখবোধ, মৃত্যুচিন্তা, আনন্দ-হর্ষ, মুগ্ধতা, প্রেম, বাৎসল্য— সব কিছুই। কিন্তু কবির মৃত্যুর ৮০ বছর পেরোবার পরও তাঁর সমস্ত চিঠির হদিশ আমরা জানি না। অথচ বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের মতো একটি বড়সড় প্রতিষ্ঠান রয়েছে— তারা কি পারে না চিঠিপত্রের বাকি খণ্ডগুলি তৈরি করতে!

শেষে একটি কথা পরিহাসচ্ছলে বলি, প্রশান্তকুমার পাল ঠাকুরবাড়ির হিসাবের খাতা ব্যবহার ও বিশ্লেষণ করে বহু অজানা তথ্যের সন্ধান দিয়েছেন। বিশ্ব ডাক দিবসে আমরা কি দাবি জানাতে পারি না যে, কবি সারা জীবনে পাঁচ-দশ হাজার চিঠি লিখে ডাক-তার বিভাগকে কত মাশুল জুগিয়েছেন— তার হিসাব নির্মাণের!

(লেখক অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন