২০০৯-এর পরে সোয়াইন ফ্লু ফিরে এসেছে ২০১৫-য়। এবং ছ’বছর আগের ভুল আবার করছে রাজ্য সরকার। একই ভুল বারবার কেন করছে রাজ্য, কৈফিয়ত চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। ভুলটার তিনটে মুখ।
• ওই মারণ রোগের সূচনাতেই পর্যাপ্ত প্রচার চালিয়ে সতর্কতা ও সচেতনতার ব্যবস্থা করেনি সরকার।
• রোগ মোকাবিলায় প্রতিষেধক ও পরিকাঠামোর বন্দোবস্ত না-করে প্রায় উদাসীন থেকেছে।
• আগের বারের ভুল থেকে কোনও শিক্ষাই নেয়নি।
চলতি বছরে সোয়াইন ফ্লু মোকাবিলায় তৃণমূল সরকার যে-ভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে, তাতে কেন্দ্রের কাছে এটা স্পষ্ট যে, রাজ্য সময়মতো তৎপর হয়নি। ২০০৯ সালে এমনটাই হয়েছিল। তখনও শুরুতে বিষয়টা ধামাচাপা দেওয়ার ব্যাপারেই বেশি তৎপরতা দেখিয়েছিলেন স্বাস্থ্যকর্তারা। সোয়াইন ফ্লুয়ে পরপর দু’জনের আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়ার পরেও রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর প্রতিরোধমূলক কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। কোনও সচেতনতা অভিযান শুরু করেনি। চুপচাপ বসে ছিল। সেই নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ার পরেও স্বাস্থ্যকর্তাদের বিশেষ হেলদোল দেখা যায়নি। এমনকী যে-দু’টি জেলার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, সেখানকার স্বাস্থ্যকর্তাদেরও স্বাস্থ্য দফতর থেকে কিছু জানানো হয়নি। কোনও নির্দেশ যায়নি। ফলে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা চালু করা যায়নি ওই দুই জেলায়। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই সেখান থেকে যখন একের পর এক রোগী আসতে শুরু করে, তখন টনক নড়ে স্বাস্থ্যকর্তাদের।
ছ’বছর আগেকার সেই বিলম্বের মাসুল দিতে হয়েছিল রাজ্যকেই। কিন্তু তা থেকে যে সরকার কোনও শিক্ষাই নেয়নি, এ বার সতর্কতা-সচেতনতার প্রচারের অভাবে রোগ-পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠাটাই তার প্রমাণ। এবং কেন্দ্র যে বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখছে না, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক শীর্ষ কর্তার বক্তব্যে তা স্পষ্ট। ওই কেন্দ্রীয় কর্তা বলেন, “অতীত থেকে কোনও শিক্ষাই নেননি এ রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা। তাই এ বারেও বিষয়টা হাতের বাইরে চলে যেতে বসেছিল। কেন এ বারেও শুরু থেকেই প্রচার হয়নি, প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং মাস্ক মজুত রাখা হল না কেন, জেলার স্বাস্থ্যকর্তাদের ডেকে বৈঠক করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশই বা দেওয়া হয়নি কেন, তা জানতে চাওয়া হচ্ছে রাজ্যের কাছে।”
রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা অবশ্য এই ধরনের অভিযোগ মানতে চাননি। উল্টে আমজনতার মধ্যে প্রচারে না-নামার সমর্থনে যুক্তি সাজাচ্ছেন তাঁরা। ওই দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, “সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচারের চেয়ে ডাক্তারদের মধ্যে রোগের উপসর্গ নিয়ে প্রচারটা অনেক বেশি জরুরি। আমরা গোড়া থেকেই সেটা করেছি।” সেই সঙ্গেই তাঁর দাবি, কোনও হাসপাতালেই ওষুধের ঘাটতি নেই। যখন যেখান থেকে কারও আক্রান্ত হওয়ার খবর এসেছে, তখনই সেখানে ওষুধ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগাম ওষুধ পাঠালে নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে। যথেষ্ট কারণ না-থাকা সত্ত্বেও ওই ওষুধ খেলে ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হতে পারে। “কেন্দ্র জানতে চাইলে এগুলোও স্পষ্ট ভাবে জানাব,” বলছেন ওই স্বাস্থ্যকর্তা।
শুক্রবারেও কলকাতায় সোয়াইন ফ্লুয়ে এক মহিলার মৃত্যু হয়েছে। বিজয়দেবী দাগা (৫২) নামে ওই মহিলা মুম্বই থেকে বেড়াতে এসে এইচ১এন১ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর অবস্থা কয়েক দিন ধরেই আশঙ্কাজনক ছিল বলে স্বাস্থ্যকর্তারা জানান। স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে-র হিসেব, এ-পর্যন্ত রাজ্যে এই রোগে ন’জনের মৃত্যু হয়েছে। এ দিন আরও আট জনের থুতু পরীক্ষা করে সোয়াইন ফ্লু ধরা পড়েছে। আক্রান্ত মোট ১৮৯ জন।
রোগ-পরিস্থিতি এত ঘোরালো হওয়ার পিছনে প্রচার, প্রস্তুতি ও পরিকাঠামোর অভাব তো আছেই। আছে আরও কয়েকটি কারণ। যেমন, এত দিন পর্যন্ত শুধু বেলেঘাটার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজেজ (নাইসেড)-এই সোয়াইন ফ্লু নির্ণয়ের পরীক্ষা হত। ফলে রোগীর চাপ সামলাতে থুতু পরীক্ষার ক্ষেত্রেও কার্যত রেশনিং ব্যবস্থা চালু করেছিল স্বাস্থ্য দফতর। উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও শুধু হাসপাতালে ভর্তি নন, এই অজুহাতে অনেককেই পরীক্ষা না-করে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে বহু ক্ষেত্রেই রোগ ধরা পড়েছে দেরিতে। তার জেরে অনেক সময়েই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে বলে ডাক্তারদের একাংশের অভিমত।
বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল একাধিক বার আবেদন করা সত্ত্বেও তাদের এই রোগ নির্ণয়ে নমুনা পরীক্ষার অনুমোদন দেয়নি স্বাস্থ্য দফতর। নিজেরা একক ভাবে যে-কাজ সুষ্ঠু ভাবে করতে পারছে না, তাতে অন্যদেরও যুক্ত করা হবে না কেন, সেই প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে। সমালোচনার মুখে পড়ে গত সপ্তাহে পিয়ারলেস হাসপাতালকে ওই রোগ পরীক্ষার ছাড়পত্র দেওয়া হয়। পিয়ারলেসের মেডিক্যাল ডিরেক্টর সুদীপ্ত মিত্র জানান, প্রতিদিন তাঁদের হাসপাতাল এবং অন্য হাসপাতালে ভর্তি বেশ কিছু রোগীর থুতুর নমুনা তাঁদের কেন্দ্রে পরীক্ষা করা হচ্ছে। তাঁরা নমুনা পরীক্ষার কিছু ক্ষণের মধ্যেই রিপোর্ট দিয়ে দিচ্ছেন।
রোগ পরীক্ষার পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও অন্য হাসপাতালগুলিকেও এই অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না কেন?
স্বাস্থ্যকর্তারা জানান, ধাপে ধাপে অনুমতি দেওয়া হবে। অ্যাপোলো গ্লেনেগ্লস হাসপাতালের সিইও রূপালি বসু জানান, তাঁরা বেশ কিছু দিন আগেই আবেদন করেছেন। আগামী সপ্তাহে ভাইরোলজিস্টদের একটি দল তাঁদের পরিকাঠামো পরিদর্শনে আসবে। সব ঠিকঠাক থাকলে ওই হাসপাতালকেও অনুমতি দেওয়া হবে বলে স্বাস্থ্যকর্তারা জানান।
প্রশ্ন উঠেছে, সোয়াইন ফ্লু-র দাপটের মুখে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হল না কেন? তাপমাত্রা বাড়লে ভাইরাস ক্রমশ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এখন গরম বাড়ছে। বিজ্ঞানীদের আশা, অল্প কিছু দিনের মধ্যেই রোগের দাপট কমে আসবে।
তা হলে কি তৎপরতার বদলে প্রাকৃতিক পরিস্থিতির আনুকূল্যের আশায় বসে আছে স্বাস্থ্য দফতর? প্রশ্ন তুলছে চিকিৎসক শিবিরই। আবার তাদেরই একাংশের কটাক্ষ, ব্যাপারটা কি শেষ পর্যন্ত রোগ পালালে বুদ্ধি বেড়ে যাওয়ার মতো হয়ে দাঁড়াচ্ছে না!