আজও যক্ষ্মা রোগীদের দেখে মুখ ফেরায় সেলুন

সংস্কার মুক্তি সহজ নয়। চিকিৎসার উন্নতি হয়েছে। সচেতন হয়েছেন মানুষ। কিন্তু যক্ষ্মা আক্রান্তকে এখনও ব্রাত্যই করে রেখেছে সমাজ। তেমনই এক ঘরে হয়ে পড়ে রয়েছে নদিয়ার ধুবুলিয়ার বিধানচন্দ্র রায় যক্ষ্মা নিবাস। সোমবার বিশ্ব যক্ষ্মা দিবসে সে কথাটা কখনও খোলাখুলি কখনও কিঞ্চিৎ আড়াল রেখে জানিয়ে দিচ্ছেন, ধুবুলিয়ার ওই হাসপাতালের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখগুলি।

Advertisement

মনিরুল শেখ

ধুবুলিয়া শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৪ ০২:০৮
Share:

বিধানচন্দ্র রায় যক্ষ্মা নিবাসে আবাসিকেরা। —নিজস্ব চিত্র।

সংস্কার মুক্তি সহজ নয়।

Advertisement

চিকিৎসার উন্নতি হয়েছে। সচেতন হয়েছেন মানুষ। কিন্তু যক্ষ্মা আক্রান্তকে এখনও ব্রাত্যই করে রেখেছে সমাজ। তেমনই এক ঘরে হয়ে পড়ে রয়েছে নদিয়ার ধুবুলিয়ার বিধানচন্দ্র রায় যক্ষ্মা নিবাস।

সোমবার বিশ্ব যক্ষ্মা দিবসে সে কথাটা কখনও খোলাখুলি কখনও কিঞ্চিৎ আড়াল রেখে জানিয়ে দিচ্ছেন, ধুবুলিয়ার ওই হাসপাতালের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখগুলি। হাজার বিঘা জমির উপরে ওই হতশ্রী হাসপাতাল এক সময় রোগীর চাপে গমগম করত। মহিলা ও পুরুষ বিভাগ মিলিয়ে প্রায় হাজার দু’য়েক রোগী থাকতেন। এখন সেখানে ভাঙা জানালা, ছিন্ন বিছানা টিমটিমে আলোয় সাকুল্যে একুশ জন রোগী।

Advertisement

তাঁদেরই এক জন উত্তম সাহা। দীর্ঘদিন ধরে এই যক্ষ্মা হাসপাতালই তাঁর ঠিকানা। প্রায় মাস আটেক ধরে যক্ষ্মা নিবাসের অন্ধকার ঘরে রয়েছেন কাটোয়ার ওই বাসিন্দা। উত্তমবাবু বললেন, ‘‘জানেন স্থানীয় বাসিন্দারা এখনও হাসপাতালের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে নাকে রুমাল চাপা দেন। দোকানে চা খেতে গেলে অন্তত পাঁচ-সাত হাত দূরে দাঁড়িয়ে অর্ডার দিতে হয়।’’

মীরা-পলাশির বক্সার আলি দফাদারের অভিজ্ঞতা বলছে--‘‘ওয়ার্ড থেকে খানিক দূরেই পিচ রাস্তা বিকেলের দিকে একটু গায়ে হাওয়া লাগাতে ওদিকে গেলেই লোকজন রে রে করে ওঠেন। আমাদের ওই রাস্তা দিয়ে হাঁটাই বারণ।’’ মুর্শিদাবাদের রেজিনগরের মিন্টু শেখ বলেন, “কোনও সেলুনেই চুল কাটতে চায় না আমাদের।”

অথচ রোগটা কী এমনই ছোঁয়াচে?

যক্ষ্মায় যখন পৃথিবী উজাড় করে মারা যাচ্ছেন মানুষ, কাশি হলেই মা তাঁর শিশুকে আতঙ্কে আঁকড়ে ধরছেন, ইওরোপ থেকে এশিয়া কিংবা আফ্রিকা মহাদেশ জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রায় বিনা চিকিৎসায় হারাচ্ছেন প্রাণ সেই সময়ে ১৮৮২ সালে যক্ষ্মার প্রতিষেধক আবিষ্কার করেন রবার্ট কক। ওই বছরের ২৪ মার্চ আনুষ্ঠানিক ভাবে ওই প্রতিষেধকের সাফল্য ঘোষণা করেছিলেন তিনি। সেই থেকে এ দিনটি আন্তর্জাতিক যক্ষ্মা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। পৃথিবী জুড়েই এই দিনে নানা সচেতনতা কর্মসূচি নেওয়া হয়।

ধুবুলিয়া হাসপাতালে অবশ্য সে সবের কোনও বালাই নেই। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা শুধু ভরসা জোগাচ্ছেন, ‘‘যক্ষ্মা রাজরোগ ছিল বটে এক সময়ে। এখন অত ভয়ের কী আছে! বিশ্রাম ও পুষ্টিকর খাবার পেলে এই রোগ মাস কয়েকেই সেরে যেতে পারে। যাঁরা সেটুকু জোগাড় করতে পারছেন না তাঁদেরই এই যক্ষ্মা নিবাসে ঠিকানা।”

তবে এই হাসপাতালের ‘ঠিকানা’য় তাঁরা কতটা চিকিৎসা পাচ্ছেন তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আবাসিকেরা সমস্বরে জানাচ্ছেন, ‘‘হাসপাতাল থেকে সিরিঞ্জ দেওয়া হয় না। অনেক সময় ইঞ্জেকশনও মজুত থাকে না। আমরা গাঁটের পয়সা খরচ করে সিরিঞ্জ ও ইঞ্জেকশন কিনে রাখি।’’ শুধু তাই নয় রোগীদের কাশির সিরাপ ও প্রয়োজনীয় ট্যাবলেটও কিনতে হয় পকেটের পয়সা খরচ করেই। এমনই অভিজ্ঞতা অনেকের। রোগীদের অভিযোগ, দিন কয়েক আগে, মদনপুরের বাসিন্দা বছর তিরিশের যুবক বিকাশ রায়ের রক্তবমি হতে শুরু করলে হাসপাতালে কোনও সিরিঞ্জ মেলেনি। ছটফট করেই মারা যান তিনি। সোম, বুধ, শুক্রতিন দিন ছাড়া হাসপাতালে দেখা মেলে না চিকিৎসকেরও। হাসপাতালের সুপার, নির্মলচন্দ্র সাহা কদাচিৎ হাসপাতালে আসেন বলে অভিযোগ। এ দিন তাঁর সঙ্গে বহুবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। অনর্গল বেজে গিয়েছে তাঁর ফোন। জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অধীপকুমার ঘোষ বলেন, “ওই যক্ষ্মা হাসপাতাল সরাসরি স্বাস্থ্য ভবন থেকে পরিচালিত হয়। ওই হাসপাতালের ব্যাপারে কোনও কিছুই আমার জানা নেই।”

যক্ষ্মা দিবসে তাই আর পাঁচটা অন্ধকার দিনের মতোই অন্ধকারে ডুবে থেকেছেন উত্তমবাবুরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন