কনে সাজানোয় দাঁড়ি টানতে তৎপর এমসিআই

চিকিৎসার দামি সরঞ্জাম থেকে শুরু করে ল্যাবরেটরির খুঁটিনাটি। লাইব্রেরির বই। এমনকী, ডাক্তার-নার্স-রোগী, মায় চেয়ার-টেবিল-আলমারিও। সবই পরস্মৈপদী! মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই)-র পরিদর্শনের সময়ে বাইরে থেকে এ ভাবে পরিকাঠামো ধার করে আনাটাকে পুরোদস্তুর অভ্যেসে পরিণত করে ফেলেছে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৪ ০৩:৩৬
Share:

চিকিৎসার দামি সরঞ্জাম থেকে শুরু করে ল্যাবরেটরির খুঁটিনাটি। লাইব্রেরির বই। এমনকী, ডাক্তার-নার্স-রোগী, মায় চেয়ার-টেবিল-আলমারিও। সবই পরস্মৈপদী!

Advertisement

মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই)-র পরিদর্শনের সময়ে বাইরে থেকে এ ভাবে পরিকাঠামো ধার করে আনাটাকে পুরোদস্তুর অভ্যেসে পরিণত করে ফেলেছে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ। অনুমোদনলাভের তাগিদে তাদের এই ‘কনে সাজানো’র খেলায় এ বার পাকাপাকি ভাবে দাঁড়ি টানার চেষ্টা হচ্ছে। এমসিআই স্থির করেছে, তারা এখন থেকে কলেজ-কর্তৃপক্ষকে না-জানিয়ে আচমকা পরিদর্শন চালাবে। শুধু তা-ই নয়, পরিদর্শন-প্রক্রিয়ার পুরোটা ভিডিও রেকর্ডিংও করে রাখবে। পরে হঠাৎ পরিদর্শনে গিয়ে ফের ভিডিও তোলা হবে। দুই রেকর্ডিং মিলিয়ে যাচাই করা হবে, আদতে ওখানে পরিকাঠামোর হাল কেমন। আর তার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত হবে, প্রতিষ্ঠানটি আদৌ মেডিক্যাল কলেজের তকমা পাওয়া যোগ্য কি না।

এমসিআইয়ের এ হেন পরিকল্পনা ভাঁজ ফেলে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য-কর্তাদের কপালে। বস্তুত এ রাজ্যের জেলায় জেলায় তো বটেই, খাস কলকাতার বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের বিরুদ্ধেও এমসিআই’কে ‘কনে দেখানো’র অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। বার বার বলেও স্বভাব পাল্টানো যায়নি। কারণ প্রমাণ করা যায়নি যে, পরিকাঠামো সব ধার করে আনা। ফলে এই অনিয়মই চলে আসছে। লোকদেখানো ডাক্তার-নার্স, সাজ-সরঞ্জামের দৌলতে অনুমতি আনিয়ে কিংবা আসনসংখ্যা বাড়িয়ে দিব্যি চলছে মেডিক্যাল কলেজ। অন্য দিকে পড়ুয়ারা ভুগছেন। পরিকাঠামোর অভাবে পাঠ্যসূচি শেষ হচ্ছে না। হবু ডাক্তারেরা সিলেবাস সামলাচ্ছেন বাইরের কোচিং নিয়ে। উপযুক্ত চিকিৎসায় বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরাও।

Advertisement

পরিদর্শনের ‘প্রহসন’ বন্ধ করতে এমসিআই উঠে-পড়ে লেগেছে। নতুন নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, আগাম জানিয়ে পরিদর্শনের দিন শেষ। সবটাই হবে আচমকা (সারপ্রাইজ ভিজিট)। পরিদর্শকেরা কাজ শুরু করার মুহূর্ত থেকে আরম্ভ করে প্রতিটি দৃশ্য ভিডিও ক্যামেরায় বন্দি থাকবে। এ জন্য স্থানীয় কোনও ভিডিও ফোটোগ্রাফার বা স্টুডিও-র সঙ্গে কথা বলে রাখা হবে। ক’দিন বাদে পরিদর্শকেরা আবার হঠাৎ সেখানে গিয়ে ফের ভিডিওগ্রাফি করাবেন।

সবিস্তার...

আর দুইয়ের মধ্যে ফারাক পেলে আসল ছবিটা পরিষ্কার হবে বলে এমসিআই মনে করছে। কাউন্সিলের উদ্যোগের প্রেক্ষাপটে অবশ্য রয়েছে একটি মামলা। সম্প্রতি রায়পুর ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস বনাম কেন্দ্রীয় সরকারের ওই মামলার রায়ে দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি ভি কে জৈন বলেছেন, বহু মেডিক্যাল কলেজে পরিকাঠামো নিয়ে মিথ্যাচার চলে। ডাক্তার, সরঞ্জাম, এমনকী রোগীও ধার করে আনা হয়। তাই আচমকা পরিদর্শন বাধ্যতামূলক করা দরকার। পাশাপাশি বিতর্ক-বিভ্রান্তি এড়াতে পুরো পরিদর্শন পর্বের ভিডিও রেকর্ডিংও দরকার বলে আদালত মত প্রকাশ করেছে।

এখন তা হলে কী হবে?

রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তারা জানিয়েছেন, নতুন মেডিক্যাল কলেজের ছাড়পত্র পাওয়া এবং পুরনোগুলোয় আসন বাড়ানোর জন্য পরের পর এমসিআই-পরিদর্শন শুরু হওয়ার কথা ক’দিনের মধ্যে। এখন তাই তাঁদেরও হুঁশিয়ার থাকতে হবে। যদিও রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, “ধার করে কে কলেজ সাজায় না? অনেক রাজ্যেই এমন হয়।” তাঁর এ-ও দাবি, “নতুন নিয়ম চালু করে আলাদা কিছু লাভ বা ক্ষতি হবে না। কারণ এমসিআই-ও বোঝে, ওদের সব দাবি বাস্তবসম্মত নয়। তা ছাড়া দেশে যে আরও মেডিক্যাল কলেজ দরকার, সেটা তো কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না!”

তবে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তাঁরা সতর্ক থাকবেন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য-অধিকর্তাও। পাশাপাশি স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ আধিকারিকের পর্যবেক্ষণ, “এতে এমসিআই-পরিদর্শকদের একাংশের দুর্নীতিও বন্ধ করা যাবে।” কী রকম?

তাঁর ব্যাখ্যা, “পরিদর্শক এসে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে টাকা চাইছেন, এমন নজির বিস্তর। টাকা না-পেলে খারাপ রিপোর্ট দেওয়ার প্রমাণও মিলেছে। ভিডিও রেকর্ডিং থাকলে এ সব বন্ধ করা যাবে।” কাউন্সিলেরও আশা, ব্যক্তিগত আক্রোশবশে কোনও পরিদর্শক যদি কলেজের বিরুদ্ধে মিথ্যে রিপোর্ট দেন, নতুন পদ্ধতিতে তা ধরা পড়তে দেরি হবে না।

এই মুহূর্তে ভারতে মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে ৩৮১টি। সম্প্রতি ৫৮টি নতুন কলেজ ছাড়পত্র পেয়েছে, যার চারটে পশ্চিমবঙ্গে। প্রতিটায় একশো জন ভর্তি হতে পারবেন। অর্থাৎ আরও প্রায় ছ’হাজার ডাক্তার তৈরির সুযোগ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন