জেনেরিক নামে অনীহা, সমীক্ষায় শীর্ষ স্থানে ন্যাশনাল ও বারাসত

সরকারি নির্দেশ মেনে প্রেসক্রিপশনে জেনেরিক ওষুধ লেখার ‘পরীক্ষা’য় সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও বারাসত জেলা হাসপাতাল। স্বাস্থ্যকর্তারাই স্বীকার করছেন, ওই দুই হাসপাতালে চিকিৎসকেরা ব্র্যান্ডেড ওষুধ লেখার উপরে লাগাম টানছেন না। বরং এমন অনেক ওষুধ লিখছেন, যা হাসপাতালের ফার্মেসি বা ন্যায্যমূল্যের দোকানে পাওয়া যাচ্ছে না। বাইরের দোকান থেকে অনেক টাকা দিয়ে রোগীকে কিনতে হচ্ছে।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:০৬
Share:

সরকারি নির্দেশ মেনে প্রেসক্রিপশনে জেনেরিক ওষুধ লেখার ‘পরীক্ষা’য় সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও বারাসত জেলা হাসপাতাল। স্বাস্থ্যকর্তারাই স্বীকার করছেন, ওই দুই হাসপাতালে চিকিৎসকেরা ব্র্যান্ডেড ওষুধ লেখার উপরে লাগাম টানছেন না। বরং এমন অনেক ওষুধ লিখছেন, যা হাসপাতালের ফার্মেসি বা ন্যায্যমূল্যের দোকানে পাওয়া যাচ্ছে না। বাইরের দোকান থেকে অনেক টাকা দিয়ে রোগীকে কিনতে হচ্ছে।

Advertisement

বিভিন্ন হাসপাতালে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান চালু এবং সরকারি চিকিৎসকদের জেনেরিক ওষুধ লেখা বাধ্যতামূলক হওয়ার পরে কোন হাসপাতালে এই নিয়ম কতটা মানা হচ্ছে দেখার জন্য একটি সমীক্ষা করিয়েছিল রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। এর জন্য বাছাই করা হয় রাজ্যের এমন ৯টি হাসপাতাল, যেগুলিতে সর্বপ্রথম ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান চালু হয়েছিল। সমীক্ষা করার ভার দেয়া হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও বেথুন কলেজের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপকদের।

প্রায় সাত মাস ধরে ওই অধ্যাপকেরা বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ, এসএসকেএম, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বারাসত জেলা হাসপাতাল, বালুরঘাট হাসপাতাল, বারুইপুর মহকুমা হাসপাতাল, বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ, জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতাল এবং কৃষ্ণনগর জেলা হাসপাতালে সমীক্ষা চালান। এই ন’টি হাসপাতালে মেডিসিন, সার্জারি, চক্ষু, হৃদ্রোগ এবং অস্থিরোগ বিভাগের চিকিৎসকদের লেখা প্রেসক্রিপশন খতিয়ে দেখে রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন তাঁরা। গত ১৯ জানুয়ারি তাঁদের রিপোর্ট স্বাস্থ্য দফতরে জমা পড়েছে।

Advertisement

প্রধান সমীক্ষক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপিকা অরিজিতা দত্ত জানান, প্রথমত সব জেনেরিক ওষুধ লেখা হয়েছে এমন প্রেসক্রিপশন সবচেয়ে কম পাওয়া গিয়েছে ন্যাশনাল মেডিক্যাল ও বারাসত হাসপাতালে। ন্যাশনালে মাত্র ৩ শতাংশ এবং বারাসতে মাত্র

৬ শতাংশ এমন প্রেসক্রিপশন মিলেছে। বাকি সব প্রেসক্রিপশনে জেনেরিকের পাশাপাশি একাধিক ব্র্যান্ডেড ওষুধ লিখেছেন চিকিৎসকেরা। অথচ বারুইপুর হাসপাতালের ৩২ শতাংশ প্রেসক্রিপশন, বর্ধমানে ৪৩ শতাংশ প্রেসক্রিপশন, পিজিতে ২০ শতাংশ প্রেসক্রিপশনে সব জেনেরিক ওষুধ লেখা হয়েছে। সমীক্ষায় ৯টি হাসপাতালের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল ন্যাশনাল ও বারাসতের।

দ্বিতীয়ত, রোজ ওই হাসপাতালগুলির সংশ্লিষ্ট পাঁচটি বিভাগে যত ওষুধ লেখা হচ্ছে, তার মধ্যে জেনেরিক ওষুধ সবচেয়ে কম লেখা হচ্ছে ন্যাশনাল ও বারাসতে (ন্যাশনালে মাত্র ৫১ শতাংশ আর বারাসতে মাত্র ৪৭ শতাংশ)। সেই তুলনায় এসএসকেএমে যত ওষুধ লেখা হচ্ছে তার ৭২ শতাংশ, বর্ধমান মেডিক্যালে ৭৫ শতাংশ , বারুইপুর মহকুমা হাসপাতালে ৬৪ শতাংশ, বালুরঘাটে ৬৩ শতাংশ জেনেরিক ওষুধ লিখছেন চিকিৎসকেরা। স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর কথায়, “বিষয়টি উদ্বেগজনক। তা ছাড়া, রিপোর্টে দেখা গিয়েছে ওই ৯টি হাসপাতালের প্রত্যেকটিতে এমন বেশ কিছু প্রেসক্রিপশন মিলেছে যাতে একটিও জেনেরিক ওষুধ লেখা নেই। এটাও আমাদের ভাবাচ্ছে।”

এ ব্যাপারে বারাসত হাসপাতালের সুপার অমিতাভ সাহা বলেন, “প্রত্যেক বিভাগে জেনেরিক ওষুধ লেখার ব্যাপারে আমরা আরও এক বার নির্দেশ পাঠিয়ে দিয়েছি। তবে মনে হয়, একমাত্র ‘কম্বিনেশন ড্রাগ’-এর ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। এই ধরনের ওষুধে কয়েকটি আলাদা-আলাদা মলিকিউলের নাম জেনেরিকে লেখা যায় না। তখন ব্র্যান্ডেড নাম লিখতেই হয়।”

একই দাবি করেছেন ন্যাশনালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান পার্থপ্রতিম মুখোপাধ্যায়, চক্ষু বিভাগের প্রধান জ্যোতির্ময় দত্ত, অস্থি বিভাগের অলয়জ্যোতি কুণ্ডু অথবা সার্জারি বিভাগের কাজি রহমান। তাঁদেরও বক্তব্য, কম্বিনেশন ড্রাগ ছাড়া তাঁরা ব্র্যান্ডেড ওষুধ লেখেন না। তবে এ কথা মানেননি সমীক্ষকেরা। অরিজিতা বলেন, “কম্বিনেশন নয় এমন অনেক ড্রাগ ব্র্যান্ডেড লেখা হয়েছে, তা-ও ন্যাশনাল আর বারাসতে পেয়েছি আমরা।” তাঁর আরও বক্তব্য, “সমীক্ষায় এটাও দেখা গিয়েছে, মাত্রাতিরিক্ত কম্বিনেশন ড্রাগ লেখা হচ্ছে।”

ওই দুই হাসপাতালের কড়া সমালোচনা করেছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর যুক্তি, “যদি কম্বিনেশন ড্রাগের প্রসঙ্গ তুলে ব্র্যান্ডেড ড্রাগ লেখার কথা বলা হয়, তা হলে আমরা জানতে চাই, অন্য ৭টি হাসপাতাল বিশেষত এসএসকেএমের মতো সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের চিকিৎসকদের সে ক্ষেত্রে কম্বিনেশন ড্রাগ বেশি লেখার দরকার পড়ছে না কেন? কী করে এত জেনেরিক ওষুধ লিখছেন তাঁরা?” সুশান্তবাবু আরও জানান, ইচ্ছাকৃত ভাবে ব্র্যান্ডেড ড্রাগ লেখার জন্য অনেক চিকিৎসক বেশি সংখ্যায় কম্বিনেশন ড্রাগ লিখছেন। তাই স্বাস্থ্য দফতর বৃহস্পতিবার, ২৯ জানুয়ারি নির্দেশ জারি করেছে, কম্বিনেশন ড্রাগে দু’টি পর্যন্ত মলিকিউল থাকলে তা এ বার থেকে জেনেরিকেই লিখতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন