রোদ ঠেকাতে শিলিগুড়িতে।—নিজস্ব চিত্র।
রাতে ঘুমোতে না পেরে কারও মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা, দিনভর কিছু না খেয়ে কারও রক্তচাপ হু হু করে নেমে গিয়েছে। রাস্তার পাশের কাটা ফল খেয়ে কেউ পেটের ব্যথায় কাতরাচ্ছেন, আবার তেল-মশলাদার খাবার খেয়ে কেউ বা ডায়েরিয়ার সংক্রমণ বাঁধিয়েছেন। মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতালের বহির্বিভাগে যত রোগী এসেছেন, তাঁদের সিংহভাগের এমনই নানা উপসর্গ দেখা গিয়েছে। চিকিৎসকদের কথায়, এ সবই ‘টেম্পারেচার এফেক্ট’ অর্থাৎ তাপমাত্রা জনিত প্রভাব। গত কয়েকদিন ধরেই শিলিগুড়ি সহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় তীব্র দাবদাহ চলছে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এক লাফে ৫ ডিগ্রিরও বেশি বেড়ে গিয়েছে। ভোর থেকেই রোদের তাপে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের তথ্য অনুযায়ী, বর্ষার সময়ে এমন চরম আবহাওয়া উত্তরবঙ্গে গত দশ বছরের নিরিখে রেকর্ড। দিনের বেলাতে তো বটেই, রাতেও উষ্ণতা কয়েক ডিগ্রি বেড়ে গিয়েছে। সোমবার রাতভর শিলিগুড়ির তাপমাত্রা ২৯ থেকে ৩১ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করেছে। তীব্র গরমে বাড়ছে রোগ সংক্রমণও। রোগীদের ভিড় বেড়েছে বেসরকারি ক্লিনিকেও।
মঙ্গলবার সকালে চার বছরের শিশুকন্যাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলেন চয়নপাড়ার বাসিন্দা প্রতিমা ঘোষ। জানালেন, গরমের কারণে সারা রাত ঘুমোতে পারেননি। সকাল থেকে শুরু হয়েছে মাথাব্যথা, মাঝে মধ্যে মাথা ঘুরছে বলেও মনে হচ্ছে। তিনি বললেন, ‘‘রাতের বেলায় মনে হচ্ছিল সিলিং ফ্যান থেকে গরমের হলকা নামছে। বাচ্চা মেয়েটাও পাশে শুয়ে ছটফট করেছে। সকালের দিকে ও ঘুমোলেও, আমি পারিনি। সকাল থেকে মাথাব্যথায় স্থির থাকতে পারছি না, তাই চিকিৎসককে দেখাতে এসেছি।’’
একটি হার্ডওয়ার সংস্থার বিক্রয় বিভাগে কাজ করেন আশরফ আলি। পেটের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালের বহির্বিভাগে এসেছিলেন। চিকিৎসক তাঁকে ভর্তি হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘সোমবার সারা দিন রোদে ঘুরেছি। গরমে অস্বস্তি শুরু হওয়ায় গতকাল হাসপাতালের সামনে থেকেই কিছু কাটাফল খেয়েছিলাম। তার পর থেকেই পেটে ব্যথা শুরু হয়েছে। অন্য কিছু খেতেও ইচ্ছে করছে না।’’ গরমে খাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে গৃহবধূ সুমিতা রায়ের। হাকিমপাড়ার বাসিন্দা সুমিতাদেবীকে হাসপাতালের বহির্বিভাগের চিকিৎসক দেখে জানিয়েছেন, তাঁর রক্তচাপ কমে গিয়েছে। সুমিতাদেবী বললেন, ‘‘গরমে কিছুই মুখে দিতে পারছি না। আবার খুব দুর্বল লাগছে। কাজ করতে করতে সব সময় মনে হচ্ছে, এই বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাব।’’
শিলিগুড়ি হাসপাতালের অন্তর্বিভাগও রোগীর ভিড়ে ঠাসা। ডায়েরিয়া ওয়ার্ডে কোনও শয্যা খালি নেই। গত ৪৮ ঘণ্টায় ১০ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। পুরুষদের সাধারণ ওয়ার্ডে গাদাগাদি করে রোগীরা রয়েছেন। ওয়ার্ডের মেঝেতে চাদর-গদি বিছিয়ে শোয়ানো হয়েছে রোগীদের। হাসপাতাল সূত্রে জানানো হয়েছে, বেশিরভাগেরই জ্বর, মাথাব্যথা, পেটের রোগ, দুর্বলতার মতো রোগে আক্রান্ত। হাসপাতালের বহির্বিভাগে পুরুষ সাধারণ বিভাগে মঙ্গলবার রোগী দেখেছেন চিকিৎসক অঙ্কণ সিমলান্দী। তিনি বলেন, ‘‘সকাল সোয়া ৯টা থেকে সোয়া বারোটা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় অন্তত ১১১ জন রোগী এসেছিলেন। ৮০ জনই জ্বর, পেটের রোগ, মাথা ব্যথার মতো রোগের উপসর্গ নিয়ে এসেছেন। অন্তত চল্লিশ জনকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার বা পর্যবেক্ষণে থাকার পরামর্শ দিতে হয়েছে।’’
শিলিগুড়ি হাসপাতালের সুপার অমিতাভ মণ্ডল বলেন, ‘‘মূলত ডায়েরিয়া, জ্বরের রোগীরাই বেশই আসছেন। চিকিৎসার সব রকম ব্যবস্থা করা হয়েছে।’’ একই চিত্র পাশের শহর জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালেও। জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ডেও রোগীরা গাদাগাদি করে রয়েছেন। সেখানেও মেঝেতে বিছানা পাতা হয়েছে। হাসপাতালের সুপার পার্থ দে অবশ্য বলেছেন, ‘‘সানস্ট্রোকের কোনও রোগী এখনও হাসপাতালে আসেননি। গরম বলে নয়, এমনিই এই সময়ে রোগীর সংখ্যা বেশিই আছে।’’ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তাপমাত্রা বাড়লে রোগ সংক্রমণও বাড়বে।