হাওড়া

পরিচিতদের ‘সুবিধা’ দিয়ে প্রশ্নের মুখে স্বাস্থ্যকর্তাই

ওয়ার্ক-অর্ডার এবং দরপত্র ছাড়াই লক্ষ-লক্ষ টাকার নির্মাণকাজ হয়েছে সরকারি হাসপাতালে। অন্য কোনও জেলার ঠিকাদারদের ওই জেলার স্বাস্থ্য দফতরের ওই দরপত্রে অংশ নিতে দেওয়া হচ্ছে না। হাসপাতালের বাতিল জিনিসপত্র যে দামে বিক্রির কথা, আদতে তা বিক্রি করা হচ্ছে অনেক কম টাকায়।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:৫০
Share:

ওয়ার্ক-অর্ডার এবং দরপত্র ছাড়াই লক্ষ-লক্ষ টাকার নির্মাণকাজ হয়েছে সরকারি হাসপাতালে।

Advertisement

অন্য কোনও জেলার ঠিকাদারদের ওই জেলার স্বাস্থ্য দফতরের ওই দরপত্রে অংশ নিতে দেওয়া হচ্ছে না।

হাসপাতালের বাতিল জিনিসপত্র যে দামে বিক্রির কথা, আদতে তা বিক্রি করা হচ্ছে অনেক কম টাকায়।

Advertisement

একাধিক হাসপাতালে সরকারি জেনারেটর বিকল হয়ে পড়ে। সেগুলি না-সারিয়ে কোটি-কোটি টাকা ব্যয়ে জেনারেটর ভাড়া করা হচ্ছে।

এমন অনেক অনিয়মের ব্যাপারে অভিযোগের আঙুল উঠেছে হাওড়া জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা (সিএমওএইচ) দেবাশিস রায়ের বিরুদ্ধে। ওই জেলারই একাধিক সরকারি হাসপাতালের কয়েক জন চিকিৎসক সম্প্রতি এ ব্যাপারে লিখিত চিঠি পাঠিয়েছেন নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কার্যালয়ে। অভিযোগ পাঠানো হয়েছে রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তার কাছেও। স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “অভিযোগ সম্পর্কে আমি পুঙ্খানুপুঙ্খ খোঁজ নিতে নির্দেশ দিয়েছি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তি থেকে কেউ বাদ পড়বেন না।”

লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য দফতরের নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হাওড়ার মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা নির্দেশ জারি করেছেন একমাত্র হাওড়া জেলায় ট্রেড লাইসেন্স রয়েছে এবং হাওড়া জেলা পরিষদে নাম নথিভুক্ত রয়েছে, এমন ঠিকাদাররাই হাওড়ার স্বাস্থ্য দফতরের দরপত্রে অংশ নিতে পারবেন।

অভিযোগকারী চিকিৎসকদের দাবি, স্বাস্থ্য দফতরের নিয়মের পরোয়া না-করে সিএমওএইচ তাঁর কাছের কিছু ঠিকাদারকে বরাত দিতেই এই নিয়ম করেছেন। সিএমওএইচ দেবাশিস রায়ের জবাব, “হ্যাঁ, আমি ওই নিয়ম করেছি এবং আমি মনে করি ঠিক করেছি। এতে বরং দুর্নীতি কমছে।” যা শুনে রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তার বক্তব্য, “কোনও সিএমওএইচ এমন কাজ করতে পারেন না। এটা সম্পূর্ণ আইনবিরুদ্ধ। দরপত্রে যে কোনও জায়গার ঠিকাদার বা নির্মাণসংস্থা অংশ নিতে পারবে। আমি এর শেষ পর্যন্ত দেখব।”

আরও অভিযোগ উঠেছে, বছরখানেক আগে এক ঠিকাদার সংস্থাকে দিয়ে আমতা হাসপাতালে পাঁচিল দেওয়ার কাজ শুরু হয়। কিন্তু কাজ চলাকালীন তিন ইঞ্চির জায়গায় পাঁচিল পাঁচ ইঞ্চি পুরু করতে বলেন সিএমওএইচ। পাশাপাশি ইমার্জেন্সি অবজার্ভেশন ওয়ার্ড, ডাক্তারদের বসার জায়গা-র মতো এমন কিছু কাজ করানো হয়, যার উল্লেখ দরপত্রে আগে ছিল না। ওয়ার্ক-অর্ডারও ছিল না। এর জন্য অতিরিক্ত প্রায় ২০ লক্ষ টাকা বিল হয়। বিভিন্ন খাত থেকে সেই টাকা ঠিকাদার সংস্থাকে মেটানো হচ্ছে।

যা শুনে বিস্মিত স্বাস্থ্য অধিকর্তা বলেন, “যদি দেখা যায়, অতিরিক্ত কাজ করাতে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে, তবে নতুন করে দরপত্র ডেকে নতুন রেট ঠিক করে বরাত দিতে হবে। এ ভাবে ইচ্ছামতো কী করে চলছে, আমি বুঝতে পারছি না।” দেবাশিসবাবুর উত্তর, “আমতা হাসপাতালের রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান তথা বিধানসভার স্বাস্থ্যবিষয়ক পরিষদীয় নেতা নির্মল মাজি চেয়েছিলেন বলে তাঁর অনুরোধেই এটা করেছিলাম।” আর নির্মল মাজির মন্তব্য, “যাঁরা আমাদের ভাল কাজ দেখতে পারেন না, তাঁরাই এ সব অভিযোগ করছেন। ভাল কাজে অত নিয়ম দেখলে হয় না। আমরা এই কাজগুলি করিয়েছিলাম বলে আমতা হাসপাতাল থেকে রোগী ফিরিয়ে দেওয়া এখন কতটা কমে গিয়েছে, হাসপাতাল কতটা ভাল হয়েছে, সেটা দেখুন।”

এখানেই শেষ নয়। ২০১২ সালে স্বাস্থ্য দফতরের এক নির্দেশিকায় (H/TDE/1007/58-24/05) হাওড়া জেলার সরকারি হাসপাতালগুলি থেকে যে সব ব্যবহৃত এক্স-রে ফিল্ম এবং এক্স-রে প্লেট ধোয়ার হাইপো-সলিউশন বিক্রি করা হবে, তার রেট ঠিক করে দেওয়া হয়। ঠিক হয়, হাইপো-সলিউশন প্রতি গ্যালন ৫০০ টাকায় এবং ব্যবহৃত এক্স-রে ফিল্ম প্রতি কিলো ১৯৫ টাকায় বিক্রি হবে। কিন্তু অভিযোগ, ২০১৪ সালের ৩১ মার্চ হাওড়ার সিএমওএইচ একটি সংস্থার কাছে হাইপো-সলিউশন প্রতি গ্যালন মাত্র ১৯৫ টাকায় এবং ব্যবহৃত এক্স-রে ফিল্ম প্রতি কিলো মাত্র ১১৫ টাকায় বিক্রির অর্ডার করেন। অভিযোগকারীদের কথায়, নিজের পরিচিত সংস্থা যাতে কম দামে জিনিসগুলি কিনতে পারে, তার জন্য সিএমওএইচ ওই অর্ডার করেন। সিএমওএইচ-এর বক্তব্য, “অর্ডারের কথা আমার ঠিক মনে পড়ছে না।”

অন্য দিকে, হাওড়ার চারটি স্টেট জেনারেল হাসপাতাল, দু’টি মহকুমা হাসপাতাল এবং একাধিক গ্রামীণ হাসপাতালে স্বাস্থ্য দফতরের কেনা জেনারেটরগুলি মাসের পর মাস খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে। সেগুলি না-সারিয়ে কিছু ঠিকাদার সংস্থার থেকে ভাড়া করে জেনারেটর চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ। এর জন্য স্বাস্থ্য দফতরকে প্রতিদিন ৯০০-১৫০০ টাকা ভাড়া গুনতে হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, ঘনিষ্ঠ কিছু ঠিকাদারকে সুবিধা করে দিতেই সিএমওএইচ তাঁদের থেকে জেনারেটর ভাড়া নিচ্ছেন।

সিএমওএইচ দেবাশিসবাবু অবশ্য অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে জানান, দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোডের্র নির্দেশানুযায়ী হাসপাতালে দূষণ রুখতে শুধুমাত্র গ্রিন জেনারেটর চালানোর কথা। তিনি স্বাস্থ্য অধিকর্তাকে অনেক বার এ বিষয়ে লিখেছেন। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতর নতুন গ্রিন জেনারেটর কিনবে বলে পুরনোগুলি সারাচ্ছে না, আবার নতুন কিনছেও না। তাই বাধ্য হয়ে ভাড়া করা জেনারেটর চালাতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিকর্তার বক্তব্য, “যখন ভাড়াই করা হচ্ছে, তখন সিএমওএইচ কেন জেলা পূর্ত দফতরের বাছাই করা সংস্থা থেকে গ্রিন জেনারেটর ভাড়া করবেন না? স্বাস্থ্য দফতর থেকে তো সে রকম নির্দেশই জেলাগুলিকে দেওয়া হয়েছে। কেন তিনি সাধারণ জেনারেটর ভাড়া নেবেন?” দেবাশিসবাবুর জবাব, “এ ব্যাপারে আমি স্বাস্থ্য অধিকর্তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলে নেব।”

অভিযোগ উঠেছে আরও কিছু বিষয় নিয়ে। যেমন হাওড়া জেলা হাসপাতালে ‘সি-আর্ম’ যন্ত্র গত প্রায় এক বছর ধরে খারাপ। যার জন্য হাড়ের কোনও বড় অস্ত্রোপচার হচ্ছে না। সব রোগী রেফার করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সিএমওএইচ সেই যন্ত্র সারানোর ব্যবস্থা করছেন না। অভিযোগকারী ডাক্তারদের কথায়, আশপাশের কিছু বেসরকারি হাসপাতালকে সুবিধা করে দিতে ইচ্ছাকৃত ভাবে যন্ত্র সারানো হচ্ছে না। কিন্তু দেবাশিসবাবুর জবাব, “যন্ত্র সারাতে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ১৪ লক্ষ টাকা চাইছে। এত বেশি টাকা দেওয়া সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য দফতরকে জানিয়েছি, কিন্তু সমস্যা মেটেনি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন