মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা নিয়ে সংশয়

ফ্রি কিন্তু ফ্রি নয়, বলছে হাসপাতালের অভিজ্ঞতা

এম আর বাঙুর হাসপাতাল। বার্ন ইউনিটে ভর্তি রোগী সাত মাস পর হাসপাতাল থেকে যখন ছাড়া পেলেন, তত দিনে তাঁর পরিবারের খরচের পরিমাণ দেড় লক্ষ টাকা। অথচ জেলা হাসপাতাল হিসেবে এখানে ফ্রি চিকিৎসা পাওয়ার কথা তাঁর।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:২৫
Share:

এম আর বাঙুর হাসপাতাল। বার্ন ইউনিটে ভর্তি রোগী সাত মাস পর হাসপাতাল থেকে যখন ছাড়া পেলেন, তত দিনে তাঁর পরিবারের খরচের পরিমাণ দেড় লক্ষ টাকা। অথচ জেলা হাসপাতাল হিসেবে এখানে ফ্রি চিকিৎসা পাওয়ার কথা তাঁর। কিন্তু বাস্তব ঘটনা হল, দামি অ্যান্টিবায়োটিক জোগান দিতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই জমিজমা বিক্রি করতে হল রোগীর পরিবারকে!

Advertisement

পুরুলিয়ার দেবেন মাহাতো হাসপাতাল। স্ত্রী-রোগ বিভাগে ভর্তি এক রোগিণীর জরায়ুর একটি অস্ত্রোপচার প্রয়োজন ছিল। ওষুধ এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ মিলিয়ে খরচ হল আট হাজার টাকা!

কার্শিয়াং মহকুমা হাসপাতাল। ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত এক তরুণকে ২৫ বোতল স্যালাইন দিতে হয়েছিল। তিন বোতল দেওয়ার পরে হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন, স্যালাইন বাড়ন্ত। বাইরে থেকে কিনতে হবে। শুধু স্যালাইন নয়, কিনতে হয়েছিল জরুরি কিছু ওষুধপত্রও।

Advertisement

জেলা হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসায় কোনও খরচ লাগবে না বলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত বছর অক্টোবর মাসে ঘোষণা করেছিলেন। স্বাস্থ্যভবন থেকে নির্দেশিকাও বেরিয়ে গিয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে। জেলা হাসপাতালগুলিতে কার্যকর হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সেই নির্দেশ। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, শুধু শয্যা এবং তার সঙ্গে মল-মুত্র পরীক্ষা আর সাধারণ কিছু ওষুধ ফ্রি। বাকি সব কিছুর জন্যই খরচ লাগবে! বাঙুর হাসপাতালের বার্ন ইউনিট থেকে ছাড়া পাওয়া ওই রোগীর এক আত্মীয়ের মন্তব্য, ‘‘ফ্রি ব্যাপারটা আসলে সোনার পাথরবাটি! আমরা তো প্রায় নিঃস্ব হয়ে গেলাম!’’

এই অবস্থায় সোমবার মুখ্যমন্ত্রী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলিতেও বিনামূল্যে চিকিৎসার যে ঘোষণা করেছেন, তার সুফল একটু জটিল রোগে ভর্তি রোগীর আত্মীয়েরা কতটা পাবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। স্বাস্থ্য কর্তাদের একটা বড় অংশ এমন সংশয়ও প্রকাশ করেছেন, এর ফলে সরকারি হাসপাতালে এখন যতটুকু পরিষেবা মেলে, তা-ও লাটে উঠবে!

কেন?

স্বাস্থ্যভবনের এক কর্তার কথায়, ‘‘আগে যখন বিপিএল-দের জন্য সরকারি হাসপাতালে ফ্রি বেড ছিল, তখনও শয্যার খরচ, কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ, ছোটখাটো অস্ত্রোপচারের খরচ এবং নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ ফ্রি ছিল। অন্য সব আনুষঙ্গিক খরচ রোগীর আত্মীয়দেরই মেটাতে হতো।’’ স্বাস্থ্যভবন সূত্রের খবর, অনেক সময় দেখা গিয়েছে, সরকারি হাসপাতালে গজ, ব্যান্ডেজ সরবরাহ হচ্ছে না। সেই খরচও সেই ক্ষেত্রে ফ্রি বেডের রোগীর পরিবারের থেকেই নেওয়া হতো। এমনকী ইমার্জেন্সি বিভাগে গুরুতর আহতকে নিয়ে আসার পরে ক্ষতস্থানে সেলাইয়ের সুতোও কিনে দিতে হয়েছে বাড়ির লোককে! হাসপাতালে ওষুধ মজুত না থাকলে সেই ওষুধও রোগীর পরিবারকে বাইরে থেকে কিনে এনে দিতে হতো। এখনও তাই হচ্ছে। ‘‘ভবিষ্যতেও এটাই হবে’’— জানিয়ে দিয়েছেন স্বাস্থ্যভবনের কর্তাটি।

কলকাতার এক সরকারি হাসপাতালের এক ডেপুটি সুপারের মন্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণায় কাজের কাজ কিন্তু কিছু হবে না। সরকারি হাসপাতালে সব বেড ফ্রি করার নামে সরকারি কোষাগার থেকে বিপুল ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেই সুবিধা আদতে কেউ পাবেন কি না, সন্দেহ। যাঁদের সত্যি সত্যি ভর্তুকি দরকার, তাঁরা তা পুরোপুরি পাবেন না। উল্টো দিকে যাঁদের হাসপাতালের খরচ মেটানোর সামর্থ্য আছে, তাঁরাও কিছু সুবিধা নিয়ে যাবেন। সরকারি হাসপাতাল তো ভিড়ে উপচে পড়বে।’’ রাজ্য সরকারের এক অবসরপ্রাপ্ত আমলার কথায়, ‘‘এ যেন জনগণের করের টাকায় তেলা মাথায় তেল দেওয়ার পরিকল্পনা! এই চটকদারি সিদ্ধান্তে ভোট বাক্সে শাসক দলের পক্ষে কিছু অতিরিক্ত ভোট পড়তে পারে মাত্র।’’

স্বাস্থ্য দফতরের অডিট বিভাগে কাজ করা এক অবসরপ্রাপ্ত আমলার মন্তব্য, ‘‘রাজ্য সরকারের উচিত ছিল যাঁরা হাসপাতালের পরিষেবার মূল্য দিতে সক্ষম, তাঁদের থেকে বেশি করে ফি সংগ্রহ করা। সেই টাকায় যাঁদের সত্যিই ভর্তুকি দরকার তাঁদের সব কিছু নিখরচায় করে দেওয়া যেত। এতে সরকারের কোষাগারে যেমন হাত দেওয়ার প্রয়োজন হতো না, তেমনই গরিব মানুষেরও উপকার হতো। ওই সব রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অস্ত্রোপচারের সরঞ্জাম, দামি ওষুধ সবই বিনা পয়সায় সরবরাহ করতে পারত রাজ্য সরকার।’’ ওই অবসরপ্রাপ্ত আমলার কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা কিংবা স্বাস্থ্যভবনের নির্দেশিকা— সব মাথায় রেখেই বলছি, ফ্রি কিন্তু আসলে ফ্রি নয়! আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচ মিলিয়ে এখন ফ্রি বেডের রোগীকে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি যেতে পকেট থেকে যে টাকা খরচ করতে হয়, তা পেয়িং বেডে থাকার চেয়ে খুব একটা কম নয়। পেয়িং বেড উঠে গিয়ে সব ফ্রি হয়ে গেলেও এমনটাই কিন্তু হবে। এটা রোগীর আত্মীয়দের মাথায় রাখতে হবে।’’

সোমবার মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কর্তারা উদ্বিগ্ন। তাঁদের আশঙ্কা, ‘ফ্রি’-এর আসল সংজ্ঞাটা মানুষের কাছে স্পষ্ট না হলে হাসপাতালে গোলমাল অবশ্যম্ভাবী। কারণ, গত অক্টোবরে জেলা হাসপাতাল স্তর পর্যন্ত শয্যা থেকে শুরু করে সব খরচ মকুবের সিদ্ধান্ত যখন হল, তার পর থেকেই বিভিন্ন হাসপাতালে গোলমাল লেগে রয়েছে। যে যে খাতে রোগীদের নিজেদের খরচ করতে হচ্ছে, সেখানেই সমস্যা বাধছে। রোগীর আত্মীয়েরা প্রশ্ন তুলছেন, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরেও কেন তাঁদের থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে?

এ ভাবে আগুপিছু বিবেচনা না করে মুখ্যমন্ত্রীর এমন ঘোষণায় কি হিতে বিপরীত হবে না? রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘একেবারেই হবে না। বরং সাধারণ মানুষের আশীর্বাদ থাকবে। এখন সবারই চিকিৎসা ফ্রি-তে করব। খুঁত খুঁজে লাভ নেই!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন