এক বছরের বেশি হয়ে গেল কলকাতার একাধিক ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানে স্বাস্থ্য দফতর মা ও শিশুর ওষুধ তথা চিকিৎসা-সামগ্রীর প্রায় ৩৪ লক্ষ টাকা বাকি রেখে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ অন্য বেসরকারি ওষুধের দোকানেও সরকারের বাকির পরিমাণ প্রায় ১ কোটি টাকা ছুঁইছুই। শুধু কলকাতা মেডিক্যাল কলেজই বেসরকারি ওষুধের দোকানে এখনও ৮০ লক্ষ টাকা বাকি রেখেছে!
জননী শিশু সুরক্ষা যোজনায় (জেএসএসকে) বরাদ্দ অর্থ থেকেই এই টাকা মেটানোর কথা। স্বাস্থ্য দফতরের ভাঁড়ারে এই যোজনায় টাকাও যথেষ্ট পরিমাণ মজুত। তা হলে এত টাকা বকেয়া রাখা হয়েছে কেন? এই প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, গোটা বিষয়ের জন্য দায়ী বোঝাবুঝির ভুল। এপ্রিল মাসে নতুন অর্থবর্ষের শুরুতেই ভুল শুধরে নেওয়া হবে।
তার আগেই গত এক বছর টাকা মেটানো নিয়ে টালবাহানার জেরে নিখরচায় ওষুধ কিনতে গিয়ে অসুস্থ মা ও শিশুর বাড়ির লোক হেনস্থা হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কারণ এত দিন টাকা না-পেয়ে অধিকাংশ দোকানই জননী শিশু সুরক্ষা যোজনায় ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী দেওয়ার ব্যাপারে বেঁকে বসছে বলে অভিযোগ। বেশ কিছু ন্যায্য মূল্যের দোকান ও চুক্তিবদ্ধ বেসরকারি দোকান প্রয়োজনীয় দামি ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী রাখা কমিয়ে দিয়েছে বা থাকলেও ‘নেই’ বলে দিচ্ছে। বাধ্য হয়ে অনেক সদ্যপ্রসূতি বা সদ্যোজাতের জন্যই পরিবারের লোক নগদ টাকা দিয়ে ওষুধ কিনছেন। কলকাতার একাধিক মেডিক্যাল কলেজের ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানের দায়িত্বে থাকা অম্বরীশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “আমরা এক বার রোগীকে নিখরচায় ওষুধ দিয়ে দেওয়ার পরে বুঝতে পারছি না আদৌ কত দিনে সরকার তা শোধ করবে। অন্তত তিন মাসে এক বার তো টাকা দেওয়া উচিত। কত দিন এ ভাবে বিনা পয়সায় ওষুধ দেওয়া যায়?”
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রেরই খবর, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ন্যায্য মূল্যের দোকানে বকেয়া রয়েছে প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা, এসএসকেএমের ন্যায্য মূল্যের দোকানে প্রায় ১০ লক্ষ, নীলরতনের প্রায় ৬ লক্ষ টাকা বাকি। আরজিকর-এর ন্যায্য মূল্যের দোকানে অবিনাশ দত্ত মেটারনিটি হাসপাতাল বাকি রেখেছে প্রায় ৩ লক্ষ টাকা। এসএসকেএমের ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানে চিত্তরঞ্জন সেবাসদনের তরফে বাকি রয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা।
জেএসএসকে যোজনায় অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকে শিশুর বয়স এক বছর হওয়া পর্যন্ত মা ও শিশুর চিকিৎসার যাবতীয় ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী সরকারি হাসপাতাল বা চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে নিখরচায় দেওয়ার কথা। সরকারি তালিকার বাইরের কোনও ওষুধ প্রয়োজন হলে তা রোগীকে হাসপাতালের ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান থেকে নিতে বলা হয়। সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল তার টাকা মেটায়। কোনও কারণে সেখানেও না-পাওয়া গেলে হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ নিকটস্থ বেসরকারি দোকান থেকে তা কিনতে হয়। সেখানেও টাকা মেটানোর কথা সরকারের। কিন্তু সেটাই মাসের পর মাস মেটানো হচ্ছে না।
মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি মাস ছয়েকের নেহা দেওরামের একটি দামি ক্যাথিটার দরকার ছিল, পেডিয়াট্রিক নেবুলাইজার দরকার ছিল নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পুতুল কাহালির। আবার রক্তের বিশেষ পরীক্ষার জন্য একটা সলিউশন প্যাক প্রয়োজন ছিল এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি আট মাসের সাজন দিনকরের। সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর্সের তালিকায় এই চিকিৎসাসামগ্রী অন্তর্ভুক্ত নেই। চিকিৎসকেরাই বলেছিলেন ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানে যেতে। অভিযোগ, দোকানে বলে দেওয়া হয়, জেএসএসকে-র এত বিপুল টাকা বাকি পড়েছে যে এই সব দামি চিকিৎসাসামগ্রী দোকানে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে রোগীর বাড়ির লোককে নগদ টাকা দিয়ে সেগুলি কিনতে হয়।
রাজ্য পরিবারকল্যাণ আধিকারিক শিখা অধিকারী বলেন, “এত দিন কোন হাসপাতালে কত শিশু জন্মাচ্ছে, তার নিরিখে জেএসএসকে-র টাকা বরাদ্দ করা হত। হাসপাতালের নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট (নিকু) বা সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিটের (এসএনসিইউ) এক বছরের কম বয়সী শিশুদের হিসেবে ধরা হয়নি। অথচ, এরাও জেএসএসকে-র মধ্যে পড়ে এবং এদের এক-এক জনের জন্য দিনে হাজার তিনেক টাকা খরচ হয়।”
শিখাদেবীর কথায়, “নিকু বা এসএনসিইউ-এ শিশুদেরই সব চেয়ে বেশি এমন সব অ্যান্টিবায়োটিক, ইমিউনোগ্লোবিউলিন বা চিকিৎসার সামগ্রী লাগে, যা সরকারি ক্যাটালগে থাকে না। বাইরে থেকে কিনতে হয়।”