ভাগের রক্তে টান, দুর্ভোগে দিন-রাত একাকার

প্লেটলেটের জন্য স্লিপ নিয়ে কাউন্টারে জমা দিয়েছেন বেলা সাড়ে এগারোটায়। সাড়ে বারোটায় কানন বিশ্বাস জানতে পারলেন, ব্লাড ব্যাঙ্কে প্লেটলেট মজুতই নেই! মাঝে গড়িয়ে গেল মহার্ঘ একটা ঘণ্টা। উলুবেড়িয়ার বাসিন্দা ওই প্রৌঢ়ার যুবক ছেলে সঞ্জিত লিম্ফোটিক লিউকোমিয়ার শিকার।

Advertisement

দীক্ষা ভুঁইয়া ও বিদীপ্তা বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৪ ০২:৫৯
Share:

প্রতীক্ষা অন্তহীন। মানিকতলা ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্ত প্রত্যাশীদের ভিড়ে কাননদেবীও। ছবি: দেবস্মিতা চক্রবর্তী।

প্লেটলেটের জন্য স্লিপ নিয়ে কাউন্টারে জমা দিয়েছেন বেলা সাড়ে এগারোটায়। সাড়ে বারোটায় কানন বিশ্বাস জানতে পারলেন, ব্লাড ব্যাঙ্কে প্লেটলেট মজুতই নেই! মাঝে গড়িয়ে গেল মহার্ঘ একটা ঘণ্টা।

Advertisement

উলুবেড়িয়ার বাসিন্দা ওই প্রৌঢ়ার যুবক ছেলে সঞ্জিত লিম্ফোটিক লিউকোমিয়ার শিকার। পার্ক স্ট্রিটের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি। স্বামী হৃদ্রোগী। বিড়ি বেঁধে, সুতোর কারখানায় দিনমজুরি করে কাননদেবী কোনওক্রমে সংসার চালান। গত ক’দিন সব কাজকর্ম ছেড়ে হাসপাতালে পড়ে রয়েছেন। ডাক্তারবাবুরা বলে দিয়েছেন, রোজ ছ’ইউনিট প্লেটলেট (অর্থাৎ অনুচক্রিকা) না-পেলে ছেলে বাঁচবে না।

তাই এখন কাননদেবীর রোজকার ডিউটি সকালে হাসপাতালের ‘রিকুইজিশন স্লিপ’ নিয়ে মানিকতলার সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কে হাজিরা দেওয়া। আর প্লেটলেট জোগাড় হলেই পড়িমড়ি করে হাসপাতালে দৌড়। সে দিন বিস্তর চেষ্টা-চরিত্র করে রাত ন’টায় হাতে পেলেন সাকুল্যে দু’ইউনিট।

Advertisement

একই হাল আমডাঙার ইনায়েত ইসলামের। জানা গেল, তাঁর থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত ভাই আচমকা অসুস্থ হয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি। ডাক্তারবাবুরা বলেছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দু’ইউনিট আরবিসি (অর্থাৎ লোহিত রক্তকণিকা) লাগবে। মেডিক্যালের ব্লাড ব্যাঙ্কে সন্ধে পর্যন্ত হত্যে দিয়েও মেলেনি। শেষমেশ মানিকতলায় এসে রাত দশটায় এক ইউনিট আরবিসি জুটল ইনায়েতের বরাতে। ভাঙড়ের শেখ ইসরায়েলেরও তা-ই। বৃদ্ধ বাবা পড়ে গিয়ে গুরুতর চোট পেয়েছেন। মেডিক্যাল কলেজে অপারেশন হবে, তাই দু’ইউনিট আরবিসি দরকার। হাসপাতালই ওঁকে মানিকতলায় পাঠিয়েছে। সন্ধে সাতটায় লাইন দিয়ে রাত একটা নাগাদ এক ইউনিট নিয়ে হাসপাতালে ছুটলেন ইসরায়েল।

কাননদেবী-ইনায়েত-ইসরায়েলের মতো হাজারো মানুষ এ ভাবে নিত্য ভুগছেন। সাধারণ রক্ত (হোল ব্লাড) তা-ও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু রক্তের বিশেষ কোনও উপাদান (আরবিসি, ডব্লিউবিসি, প্লেটলেটস বা প্লাজমা) দরকার হলে তা জোগাড় করতে নাভিশ্বাস উঠছে রোগীর পরিজনের। অথচ আধুনিক চিকিৎসা-বিজ্ঞান বলছে, রোগীর শরীরে রক্তের ঠিক যে উপাদানটি প্রয়োজন, সেটাই দেওয়া উচিত। হোল ব্লাড দিলে অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিও হতে পারে। তাই যত দিন যাচ্ছে, রক্ত-উপাদানের চাহিদারেখা ঊর্ধ্বমুখী।

সাধারণ রক্তের জোগান মোটামুটি পর্যাপ্ত থাকলেও উপাদান পেতে এত হয়রানি কেন?

মূল কারণ, পরিকাঠামোয় ঘাটতি। সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্ক সূত্রের খবর: উপাদানগুলোকে আলাদা ভাবে মজুত করতে হলে সংগ্রহের চার ঘণ্টার মধ্যে রক্তের উপাদান পৃথকীকরণ (কম্পোনেট সেপারেশন) ও তার সংরক্ষণের প্রক্রিয়া সেরে ফেলা চাই। ঘটনা হল, বিভিন্ন রক্তদান শিবিরে সংগৃহীত রক্ত অত তাড়াতাড়ি নিয়ে আসার মতো যথেষ্ট গাড়ি মানিকতলায় নেই। অভাব টেকনিশিয়ানেরও। ফলে দিনে এক বারের বেশি উপাদান পৃথকীকরণ হয় না। উপরন্তু সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কের কার্যনির্বাহী অধিকর্তা পরমার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “সব হোল ব্লাড থেকে সব উপাদান তৈরি করা যায় না। যাবে কিনা, সেটা নির্ভর করে রক্তের গুণগত মানের উপরে।”

এই শর্তটিও উপাদানের জোগানে একটা প্রতিবন্ধক। এ তো গেল কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্কের কথা। পাশাপাশি এসএসকেএম, এনআরএস, কলকাতা মেডিক্যাল এবং আরজিকরে কম্পোনেন্ট সেপারেশনের যন্ত্র থাকলেও চাহিদা মতো কাজ হয় না বলে অভিযোগ। এমনকী, ‘সুপার স্পেশ্যালিটি’ হাসপাতাল এসএসকেএমে-ও রক্তের কম্পোনেন্ট সেপারেশন হয় সপ্তাহে শুধু এক দিন রবিবার।

খাস কলকাতার সরকারি হাসপাতালে যখন এই অবস্থা, তখন জেলার ছবিটা সহজেই অনুমেয়। পরিণামে কার্যত সারা রাজ্যের সরকারি হাসপাতাল থেকে রক্ত-উপাদানের ‘রিক্যুইজিশন’ নিয়ে মানুষের ঢল নামছে মানিকতলায়। অন্য দিকে রক্তদান অভিযানে জড়িত একাধিক শিবির উদ্যোক্তার দাবি: বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কে কম্পোনেন্ট সেপারেশনের যন্ত্র তুলনায় কম থাকলেও সেখানে হোল ব্লাড ও উপাদানের জোগান বেশি। কারণ হিসেবে ওঁদের ব্যাখ্যা, অনেক বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক দু’-তিন ঘণ্টা অন্তর গাড়ি পাঠিয়ে রক্তদান শিবির থেকে রক্ত সংগ্রহ করে আনে। সঙ্গে সঙ্গে উপাদান আলাদা করে সংরক্ষণও হয়ে যায়।

অথচ যন্ত্র থাকা সত্ত্বেও যন্ত্রী বা গাড়ির অভাবে সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক কার্যত ঠুঁটো হয়ে রয়েছে। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের তথ্য বলছে, কলকাতায় প্রতি দিন সাধারণ রক্তের (হোল ব্লাড) গড় চাহিদা ৬৫০ ইউনিট। প্লেটলেটের চাহিদা প্রায় সমান ৫০০-৬০০ ইউনিট। মানিকতলা-সহ কলকাতার সব সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক মিলিয়ে এর বড়জোর ২৫% মেটাতে পারে। কলকাতায় আরবিসি’র দৈনিক গড় চাহিদা সাড়ে তিনশো-চারশো ইউনিট। যার ৩০%-৩৫% তৈরি হয় সরকারি ভাবে।

চাহিদা-জোগানের এই বিপুল ফারাক কি থেকেই যাবে? কর্তাদের কী বক্তব্য?

রক্ত-উপাদানের জোগান যে যারপরনাই কম, রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী তা মেনে নিয়েছেন। “সরকারি হাসপাতালে রক্তের উপাদান আলাদা করার যন্ত্র রয়েছে। কিন্তু টেকনিশিয়ানের অভাবে রোজ কাজে লাগানো যাচ্ছে না।” বলছেন তিনি। অধিকর্তার আশ্বাস, লোকসভা নির্বাচনের পরে সমস্যাটির দিকে নজর দেওয়া হবে।

তত দিন হন্যে হয়ে এখান থেকে ওখানে ছোটাই ভবিতব্য কাননদেবী-ইনায়েত-ইসরায়েলদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন