মাঝপথেই বন্ধ চিকিৎসা, জটিল হচ্ছে যক্ষ্মারোগ

যক্ষ্মার চিকিৎসা সম্পূর্ণ না করে ‘উধাও’ হয়ে গিয়েছেন জেলার অন্তত হাজারখানেক রোগী। যার ফলে আরও জটিল ধরনের যক্ষ্মায় তাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন। তখন ওষুধ খাওয়ালেও কাজ হচ্ছে না। তাঁদের থেকে অন্যদের মধ্যে যখন রোগ ছড়াচ্ছে, তখন সেই জটিল ‘মাল্টি ড্রাগ রেসিস্ট্যান্ট’ যক্ষ্মাই ছড়াচ্ছে।

Advertisement

পীযূষ নন্দী

আরামবাগ শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:৩১
Share:

যক্ষ্মার চিকিৎসা সম্পূর্ণ না করে ‘উধাও’ হয়ে গিয়েছেন জেলার অন্তত হাজারখানেক রোগী। যার ফলে আরও জটিল ধরনের যক্ষ্মায় তাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন। তখন ওষুধ খাওয়ালেও কাজ হচ্ছে না। তাঁদের থেকে অন্যদের মধ্যে যখন রোগ ছড়াচ্ছে, তখন সেই জটিল ‘মাল্টি ড্রাগ রেসিস্ট্যান্ট’ যক্ষ্মাই ছড়াচ্ছে।

Advertisement

কেন মাঝপথেই ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দিচ্ছেন রোগীরা? গোঘাটের ভাদুর গ্রামের কার্তিক মুদি গত ১৮ জুলাই ওষুধ খাওয়া শুরু করেছিলেন। ১২ অক্টোবর শেষবার ওষুধ খেয়ে আর হাসপাতালমুখো হননি। স্বাস্থ্যকর্মীরা তাঁর বাড়িতে ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে বারবার ফিরে আসছেন। প্রতিবারই তিনি লুকিয়ে পড়ছেন, পালাচ্ছেন। কেন? প্রশ্ন করতে বছর উনপঞ্চাশের কার্তিকবাবু বলেন, “ওষুধ খেলে দুর্বল লাগে, কাজ করতে পারি না। আবার কাজ না করলে খাব কী? স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি এসে বোঝায় ঠিকই। কিন্তু তাঁরা কি আমার সংসার চালাবে?’’

একই বক্তব্য গোঘাটের গোবিন্দপুর গ্রামের যুবক সুদন সরেন (২৬), আরামবাগের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের লালমোহন অধিকারী (৫৮), আরামবাগের মিঞাপাড়ার বছর চল্লিশের শেখ বাপনের। সকলেই জানালেন, খালি পেটে সব ওষুধ খেতে হয়। ওষুধ খাওয়ার পরও বাড়িতে ভাল খাবার জোটে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোজগার শুরু করার তাড়াতেই তাঁরা ওষুধ বন্ধ করে দিচ্ছেন। জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, সরকারি চিকিৎসাধীন যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার। এঁদের ৯৯ শতাংশই দুঃস্থ। এঁদের পাঁচজনে একজনই মাঝপথে ওষুধ বন্ধ করে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছেন।

Advertisement

অথচ যক্ষ্মার চিকিৎসা চলাকালীন যাতে গরিব রোগীদের খাদ্যাভাব না হয়, তার ব্যবস্থা রয়েছে। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে বলা হয়েছে, চিকিৎসাধীন রোগীর খাদ্যের নিশ্চয়তা দেবে পঞ্চায়েতগুলি। স্বাস্থ্য আধিকারিকরা বলছেন, ওষুধ চলাকালীন রোগীরা অন্তত তিন-চার মাস কাজ করতে পারেন না। তাঁদের মধ্যে অনেকেই সংসারের একমাত্র উপার্জনশীল সদস্য। রোগী ও তাঁর পরিবার যাতে সরকারি সাহায্য পান, সেই দায়িত্ব পঞ্চায়েতকে নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু স্বাস্থ্য আধিকারিকদের অভিযোগ, সুপারিশ পাঠানো হলেও অধিকাংশ পঞ্চায়েত রোগীদের প্রতি উদাসীন।

হুগলি জেলা যক্ষ্মা আধিকারিক প্রকাশ বাগ বলেন, ‘‘আমরা পঞ্চায়েতগুলিকে এই কর্মসূচিতে উদ্যোগী করার চেষ্টা করছি। কয়েকবার বৈঠকের পর কয়েকটি পঞ্চায়েত কাজ শুরু করেছে। ক্রমশ সব পঞ্চায়েতই দায়িত্বশীল হবে বলে আশা করছি।” তবে হুগলি জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যাচ্ছে, চিত্রটা খুবই নিরাশাজনক। জেলার ২০৭টি পঞ্চায়েতের মধ্যে মাত্র ১৪টি পঞ্চায়েত থেকে যক্ষ্মা রোগীদের খাবার দেওয়া শুরু হয়েছে।

২০০৯ সালে ৩১ অগস্ট রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারে সুপারিশ অনুয়ায়ী যক্ষ্মা রোগীদের খাদ্যের নিরাপত্তার বিষয়টা নিয়ে জেলাশাসকদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। সেই চিঠি বিভিন্ন ব্লক হয়ে পঞ্চায়েগুলিতে পৌঁছয়। কিন্তু পঞ্চায়েতগুলি কোন সাড়া দেয়নি বলে অভিযোগ। ফের ২০১০ সালের ১৯ জুলাই জেলাশাসক সব বিডিওদের চিঠি পাঠান। বিডিওরা সেই কর্মসূচি রূপায়ণের জন্য পঞ্চায়েতগুলিতে নির্দেশ পাঠায়, পঞ্চায়েতগুলি তাকেও গুরুত্ব দেয়নি বলে অভিযোগ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পঞ্চায়েত প্রধানদের বক্তব্য, যক্ষ্মা রোগীদের জন্য সরকার আলাদা করে টাকা বরাদ্দ করে না। ত্রয়োদশ অর্থ কমিশন বা তৃতীয় রাজ্য অর্থ কমিশনের তহবিলে যে টাকা মেলে, তা খুবই কম। সমাজকল্যাণ তহবিলও যথেষ্ট নয়। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলি থেকেই যক্ষ্মারোগীদের খাবার দেওয়া হোক, প্রস্তাব দিচ্ছেন প্রধানরা।

পঞ্চায়েত, জেলা প্রশাসন, রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর এবং কেন্দ্রের মধ্যে টানাপড়েনে যক্ষ্মার চিকিৎসা থমকে যাচ্ছে মাঝপথে। যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আরামবাগ ইউনিটের স্বাস্থ্যকর্মী সুনীল দাসের মতো অনেকেই জানালেন, রোগীদের বাড়িতে বারবার গিয়েও দুর্ব্যবহার পেয়ে ফিরে আসছেন। চিকিৎসায় ফেরার ব্যাপারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাহায্য চাইলে খুব কম সাড়া পাওয়া যায়।

এক দিকে দারিদ্র, অন্য দিকে উদাসীনতা, দু’য়ের সুযোগে অবাধে ছড়াচ্ছে জটিলতর, কঠিনতর যক্ষ্মা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন